১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১ কার্তিক ১৪৩০, ১৩ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

হারিছ চৌধুরীর পরিচয় নিশ্চিতে ৩ বছর পর লাশ উত্তোলন

-

হাইকোর্টের নির্দেশে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীর লাশ গতকাল বুধবার সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের শ্যামপুরের জামিয়া খাতামুন্নাবিয়্যীন ঢাকার মাদরাসা প্রাঙ্গণের কবর থেকে উত্তোলন করা হয়েছে। তার লাশের ডিএনএ টেস্ট করা হবে। পরিচয় নিশ্চিত হলে তার ইচ্ছা অনুযায়ী হারিছ চৌধুরীর লাশ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কানাইঘাটের দর্পনগর গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে পিতা-মাতার কবরে শায়িত করা হবে বলে জানিয়েছেন তার মেয়ে সামিরা।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ একাধিক মামলার অন্যতম আসামি ছিলেন ওই সময়ের প্রভাবশালী নেতা সিলেটের হারিছ চৌধুরী। ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পর হারিছ চৌধুরী গা-ঢাকা দেন। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের অত্যাচারে হারিছ চৌধুরী দীর্ঘ ১৪ বছর আত্মগোপনে থাকেন। বিদেশে চলে গেছেন বলে প্রচার করা হলেও তিনি বাংলাদেশের ভেতরেই ছিলেন এবং ঢাকাতেই বেশির ভাগ সময় কাটান। ১/১১ এর সরকারের সময় কিছুদিন সিলেটে অবস্থান করেন। এরপর ঢাকায় এসে তিনি নাম বদল করে জাতীয় পরিচয়পত্র নেন মাহমুদুর রহমান নামে। পরিচয় দিতেন একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক হিসেবে। ঢাকার পান্থপথে প্রায় ১১ বছর কাটিয়ে দেন এই পরিচয়ে। এই সময় তিনি মাহমুদুর রহমান নামে একটি পাসপোর্টও নেন। ঠিকানা দেন শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার। বাবার নাম আবদুল হাফিজ। ২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে এই পাসপোর্ট ইস্যু হয়। পাসপোর্টে দেয়া ছবিতে দেখা যায় ওই সময় তার চেহারায় অনেক পরিবর্তন। সাদা লম্বা দাড়ি। চুলের রঙ একদম সাদা। তার এনআইডি নম্বর হচ্ছে ১৯৫৮৩৩৯৫০৭।

২০২২ সালের ১৫ জানুয়ারি গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, হারিছ চৌধুরী করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মারা গেছেন। প্রবাসী মেয়ে ব্যারিস্টার সামিরা চৌধুরী তখন জানান, তার বাবা ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে মারা গেছেন। প্রফেসর মাহমুদুর রহমান পরিচয়ে দাফন করা হলেও তার মেয়ে ও পরিবারের দাবি ছিল ওই ব্যক্তিই প্রকৃত পক্ষে হারিছ চৌধুরী। কিন্তু তৎকালীন সরকার তার প্রকৃত পরিচয় অনুযায়ী কোনো মৃত্যুসনদ দেয়নি।
দাফন হওয়া ব্যক্তি হারিছ চৌধুরী কি না বিতর্ক উঠলে তার মেয়ে ব্যারিস্টার সামিরা তানজিন চৌধুরী আদালতে হারিছ চৌধুরীর অবশিষ্ট (লাশ) যা আছে, তা তুলে ডিএনএ পরীক্ষা করে তার প্রকৃত পরিচয় নির্ধারণ এবং তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধার প্রাপ্য সম্মানসহ নিজ জেলা সিলেটে দাফন করার প্রার্থনার কথা জানিয়ে রিট করেন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি মুহম্মদ মাহবুব-উল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ৫ সেপ্টেম্বর লাশ তুলে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত পরিচয় শনাক্তে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিচালককে এ নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী গতকাল সকালে সাভার উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এস এম রাশেদুল ইসলাম নূর-এর উপস্থিতিতে ৩ বছর ১ মাস ১২ দিন পর লাশ দুপুরে উত্তোলন করা হয়। এরপর নমুনা সংগ্রহ করে সিআইডি। পরে লাশটি সংরক্ষণের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করা হয়।

হারিছ চৌধুরীর মেয়ে সামিরা চৌধুরী বলেন, অনেকেই বলছে, হারিছ চৌধুরী মারা যাননি। পালিয়ে আছেন, গা ঢাকা দিয়ে আছেন। যাচ্ছে তাই বলা হচ্ছে। একটা সৎ ভালো মানুষকে ক্রিমিনাল সাজানো হয়েছে। সত্যি লুকিয়ে রাখা যায় না। এখন এটা একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে। তার সম্মান সে ফিরে পাচ্ছে। আব্বুর যে শেষ ইচ্ছা ছিল, সে অনুযায়ী তার দাফন হবে। আদালত যেভাবে বলবে সেভাবেই তৎপরতা নেয়া হবে। জামিয়া খাতামুন্নাবিয়্যীনের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ মাওলানা আশিকুর রহমান কাসিমি পীর বলেন, ২০২১ সালে ৩ সেপ্টেম্বর প্রফেসর মাহমুদুর রহমান নামে এক ব্যক্তিকে মাদরাসায় দাফন করা হয়। সে সময় তার জাতীয় পরিচয়পত্রে প্রফেসর মাহমুদুর রহমান নামেই দিয়েছিল। এরপরে হঠাৎ একটি পত্রিকার খবরে জানতে পারি সে হারিছ চৌধুরী। যে কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে তার শ্যালক জাফর ইকবাল মাসুমের মা ফলুর নেসার নামে ছিল। আর জাফর ইকবাল মাসুম ওই মাদরাসার শূরা সদস্য ছিল। ওই সময় কবরে দাফন বাবদ ছদকায়ে জারিয়া হিসেবে পাঁচ লাখ টাকা অনুদান দেয়া হয়। লাশের জানাজাও পড়ান তিনি।
মেয়ে ব্যারিস্টার সামিরা তানজিন বলেন, আব্বা মারা যাওয়ার সময় আমি খুব ভয়ভীতির মধ্যে ছিলাম। ১৫ বছর আমার পরিবারের ওপর অনেক অত্যাচার চলেছে এবং আরো অত্যাচারের সম্ভাবনা ছিল। সে সময় আমি বিদেশে থেকেই দাফন করার জন্য পাগলের মতো একটি জায়গা খুঁজতে থাকি। পরে আমার নানুর জন্য বড় মামা এই মাদরাসাতে জমি নিয়েছিলেন। সেখানেই দাফন করা হয় আমার বাবাকে।

ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার আহম্মদ মুঈদ বলেন, হারিছ চৌধুরীর মেয়ের করা এক রিটে প্রফেসর মাহমুদুর রহমান নামে দাফন করা সেই ব্যক্তিই হারিছ চৌধুরী, তার পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য ডিএনএ টেস্ট করা হবে। তিনি আরো জানান, আজ (বুধবার) বিভিন্ন সংস্থার ৫টি বিভাগ ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।
সাভার উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এস এম রাসেল ইসলাম নূর বলেন, হারিছ চৌধুরীর পরিচয় নিশ্চিত হলে তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা জানিয়ে দাফন করা হবে।
এ দিকে সূত্র জানায়, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার পর ২০১৫ সালে হারিছ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারি হয়। ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ওই মামলায় হারিছ চৌধুরীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। সে বছরের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় তাকে ৭ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এ ছাড়াও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলায়ও তিনি আসামি ছিলেন।


আরো সংবাদ



premium cement