১৬ অক্টোবর ২০২৪, ৩১ আশ্বিন ১৪৩০, ১২ রবিউস সানি ১৪৪৬
`
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস

আরো ১ বছর চাপে থাকবে অর্থনীতি

এবার প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশ, পরের বছর সাড়ে ৫ শতাংশ
-

বাংলাদেশের অর্থনীতি আরো এক বছর চাপে থাকবে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলছে, সরকারের সামনে অর্থনীতিতে এই মুহূর্তে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বহিঃ খাতের চাপ, আর্থিক খাতের দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। এসব কারণে প্রবৃদ্ধি খুব বেশি বাড়বে না। এছাড়া বাংলাদেশে কর্মের বাজারে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ব্যবধান রয়েছে। সেটি একটি বড় সমস্যা। প্রতিবেদনে বলছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) কমে ৪ শতাংশ হবে। তবে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এটি বেড়ে সাড়ে ৫ শতাংশ হতে পারে। তবে চলমান অর্থবছরের বাজেটে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বিশ্বব্যাংকের কার্যালয়ে গতকাল বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে অনলাইনে ওয়াশিংটন থেকে বক্তব্য রাখেন- বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদৌলায়ে সেক। এ সময় উপস্থিত ছিলেন- বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ইকোনমিস্ট ধ্রুব শর্মা, ইকোনমিস্ট নাজমুস খান এবং বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র যোগাযোগ কর্মকর্তা মেহেরিন এ মাহবুব।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কেননা এখনো ৮৪ দশমিক ৯ শতাংশ কর্মসংস্থান অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। এটি অত্যন্ত উচ্চ সংখ্যা। ২০১৬ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে কর্মসংস্থান কমেছে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ হারে। আর্থিক খাত নিয়ে বলতে গিয়ে বলা হয়েছে, ব্যাংকিং খাতে নানা ধরনের সঙ্কট রয়েছে। বিশেষ করে খেলাপি ঋণ অনেক বেশি। সরকারের অনেক প্রচেষ্টার পরও সেটি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এছাড়া মূল্যস্ফীতি কমাতে ঋণের সুদহার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বেসরকারি খাতে ঋণ গ্রহণ কমেছে। যেহেতু বিদেশী মুদ্রার মজুদ কম থাকার সম্ভাবনা আছে, তাই আমদানি বিধিনিষেধ অব্যাহত থাকবে এবং বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিপরীতে, সরকারি বিনিয়োগ স্থিতিশীল থাকবে বলে অনুমান করছে বিশ্বব্যাংক।
প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে ৩ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ৫ দশমিক ২ শতাংশের মধ্যে থাকবে। মধ্যবর্তী পয়েন্ট হবে ৪ শতাংশ। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বিশ্বব্যাংক এপ্রিলে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল। আর চলমান অর্থবছরের বাজেটে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। সেই হিসাবে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস সরকারি লক্ষ্যের চেয়ে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ কম হবে। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী কমে গেলে তা হবে কোভিড মহামারীর পর সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। চলতি অর্থবছরের পূর্বাভাস কমানোর পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলনও কমিয়ে ৫ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়েছে। গত অর্থবছরের জন্য সরকারের সাময়িক প্রাক্কলন ছিল ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ।
কর্মসংস্থান প্রসঙ্গে বিশ^ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে কর্মের বাজারে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ব্যবধান রয়েছে। সেটি একটি বড় সমস্যা। এক্ষেত্রে রফতানি বহুমুখীকরণ, বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। দক্ষতার সাথে বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষার মিস ম্যাচ আছে। প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান বাড়াতে এসব বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ের পরিস্থিতি খারাপ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আয় বৈষম্যের একটি পরিমাপ ০.৫০ থেকে ০.৫৩ পর্যন্ত প্রায় তিন পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিবেদনে জরুরি এবং সাহসী সংস্কারগুলো তুলে ধরা হয়েছে। যা দেশকে শক্তিশালী, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই প্রবৃদ্ধির পথে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করার জন্য প্রয়োজনীয়। গত ২০১৬ এবং ২০২২ এর মধ্যে সামগ্রিক বেকারত্বের হার হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও তরুণরা উল্লেখযোগ্যভাবে উচ্চ বেকারত্বের হারের সম্মুখীন। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে। শহুরে শিক্ষিত যুবকদের জন্য কাজের প্রাপ্যতা হ্রাস পেয়েছে। তৈরী পোশাক খাতের মতো বড় শিল্পে কর্মসংস্থান স্থবির হয়ে পড়েছে। ২০১৬ সাল থেকে, যখন ঢাকায় আরো কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, তিনটি বিভাগ-চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং সিলেট উল্লেখযোগ্য নেট কর্মসংস্থান ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
আর বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদৌলায়ে সেক বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারেনি। অথচ প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তরুণ কর্মের বাজারে প্রবেশ করছে। বিশেষ করে শিক্ষিত ও শহুরে বেকার বৃদ্ধি পাওয়াটা একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের জন্য অন্যতম একটি চ্যালেঞ্জ। নানা উদ্যোগ নিয়েও এটি কমানো যাচ্ছে না। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি। যা সাধারণ মানুষের জীবনমানকে নিচে নামাচ্ছে। পাশাপাশি বৈষম্যও বাড়ছে বাংলাদেশে। এক্ষেত্রে বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ দরকার। অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি এবং আর্থিক খাতে বিভিন্ন সংস্কার দ্রুত করতে হবে।
বিশ^ব্যাংকের এই আবাসিক প্রধান বলেন, বাংলাদেশ প্রতিকূলতার মুখে অসাধারণ স্থিতিস্থাপকতা ও দৃঢ়তা দেখিয়েছে। আমি আত্মবিশ্বাসী যে অর্থনৈতিক ও আর্থিক শাসনব্যবস্থা উন্নত করতে, ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নতির জন্য জরুরি এবং সাহসী সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার যুবকদের লাখ লাখ কর্মসংস্থানসহ একটি শক্তিশালী এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির পথে ফিরে আসতে পারে। তিনি বলেন, উচ্চ খাদ্য ও শক্তির মূল্য দ্বারা চালিত মুদ্রাস্ফীতি, গড় ৯.৭ শতাংশ। জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে এবং আগস্টে কমছে। নিকটবর্তী মেয়াদে এটি উচ্চতর থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে সরবরাহ-সদৃশ সমস্যাগুলো স্থিতিশীল হলে এবং বিচক্ষণ আর্থিক ও রাজস্বনীতি বজায় থাকলে মধ্য মেয়াদে ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে।


আরো সংবাদ



premium cement