১৬ অক্টোবর ২০২৪, ৩১ আশ্বিন ১৪৩০, ১২ রবিউস সানি ১৪৪৬
`
বিশ্ব খাদ্য দিবস আজ

খাদ্যনিরাপত্তা হুমকিতে

২ দফা বন্যায় ১০-১২ লাখ টন চাল কম উৎপাদনের আশঙ্কা
-


চলতি বছর ভালো সময় যাচ্ছে না কৃষিতে। দেশের দুই অঞ্চলে দুই দফায় ভয়াবহ বন্যায় কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এর মধ্যে গত আগস্টে ফেনী, নোয়াখালীসহ ১১টি জেলায় ভয়াবহ বন্যায় আউশ-আমন ধানসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আর সেপ্টেম্বরে জামালপুর, শেরপুর, কুড়িগ্রামসহ আরো কয়েকটি জেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিভিন্ন ফসল। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভালো নেই কৃষি উৎপাদন। ধান থেকে শুরু করে শাক-সবজি-সব ধরনের ফসলেই এই দুর্যোগে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। যার কারণে বেড়েছে চালের দাম। অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে সবজিসহ সবধরনের কৃষিপণ্যের দাম। দেশের প্রধান খাদ্য চাল। আউশ-আমনে দুই দফা বন্যার কারণে কমপক্ষে ১০-১২ লাখ টন চাল কম হবে। এ অবস্থায় আগামীতে বোরো ধানেই গুরুত্ব দিচ্ছে কৃষি বিভাগ। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বর্তমানে সারের মজুদ রয়েছে ডিসেম্বর পর্যন্ত। তাই ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া সবচেয়ে বড় মৌসুম (বোরো ধান, সরিষা ও শীতকালীন সবজি) নিয়েও শঙ্কা রয়েই গেছে। এ তো গেল খাদ্য উৎপাদন নিয়ে শঙ্কার কথা। অন্যদিকে, মানুষের নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত হওয়া নিয়েও শঙ্কা রয়ে গেছে। লালশাক, বেগুন, পটোল, ঢেঁড়স, শিম, বাঁধাকপিসহ ৯ ধরনের সবজিতে ক্ষতিকর মাত্রায় ভারী ধাতু এবং লিচুসহ চারটি ফলে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে। নিয়মিত এই খাদ্যগুলো খেলে ক্যান্সারের মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশ ফুড সেফটি অথরিটি কয়েক বছর আগে বাজার থেকে ৪৭টি কীটনাশক ও সারের নমুনা সংগ্রহ করে তা একাধিক পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করেছে। পরীক্ষার ফলাফলে কীটনাশকগুলোতে সিসা, ক্যাডমিয়াম এবং ক্রোমিয়ামের মতো ভারী ধাতুগুলোর উপস্থিতি দেখা গেছে। যদিও সেই যৌগগুলোতে কোনো ভারী ধাতু থাকা উচিত নয়। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কীটনাশক ও সারের ভারী ধাতু মাটি, পানি ও ফসলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রবেশ করে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মকভাবে খাদ্য শৃঙ্খলকে দূষিত করে।
সরবরাহ চেইনের ধাপগুলো নিরাপদ করার উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতির মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ শুরু করলেও বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না বলে অভিযোগ। ফলে, ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর ভোক্তাদের মধ্যে ভেজালমুক্ত খাদ্য পাওয়ার যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, তা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে বলে মনে করা হচ্ছে।

এমতাবস্থায় আজ বুধবার ‘উন্নত জীবন ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য খাদ্যের অধিকার’ প্রতিপাদ্যে দেশে পালিত হচ্ছে বিশ^ খাদ্য দিবস। রাজধানীর বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) মিলনায়তনে অনুষ্ঠেয় খাদ্য দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন কৃষি উপদেষ্টা লে. জে. (অব:) মো: জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। কৃষিসচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিতব্য এ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি থাকবেন খাদ্যসচিব মো: মাসুদুল হাসান। থাকবেন খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের আমলে যে লুটপাট হয়েছে তাতে দেশের অর্থনীতি ভঙ্গুর অবস্থায়। পাচার হয়েছে অন্তত ১৮ লাখ কোটি টাকা। রিজার্ভ ঘাটতির কারণে ডলার সঙ্কটে ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে পারছে না। এতে কয়েক মাস ধরে বন্ধ আছে সার আমদানি। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমনিতেই গত আগস্টে ফেনী, নোয়াখালীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে বন্যায় আউশ ও আমন মিলে কমপক্ষে আট লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন কম হবে। এরপর সেপ্টেম্বরে জামালপুর, শেরপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাটসহ কয়েকটি জেলায় আরেকটি বন্যা দেখা দেয়। এতে ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত পরিসংখ্যান এখনো জানা না গেলেও আরো ২-৩ লাখ টন চাল কম উৎপাদন হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। সবমিলে ১০-১২ লাখ টন চাল এবার কম উৎপাদনের শঙ্কা রয়েছে। কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, যদি সময় মতো সার আমদানি করা না যায়, দেশে উৎপাদন বাড়ানো না যায়, তাহলে কৃষি উৎপাদনে বড় সমস্যা হবে। দেশের খাদ্যনিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আউশ-আমন ও বোরো মৌসুম মিলিয়ে গত অর্থবছরে চালের উৎপাদন ছিল তিন কোটি ৭০ লাখ টন। তবে, এবার চালের উৎপাদন ঘাটতি পড়ার শঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় আগামী বোরো আবাদকে গুরুত্ব দিচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয়। তবে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) থেকে এখনো সেভাবে মনিটরিং জোরদার পরিলক্ষিত হয়নি। ৫ আগস্ট পরবর্তী ডিএইতে রদবল হয়েছে। নতুন ডিজি নিয়োগ হয়েছে। তবে, এখনো পরিচালক সরেজমিন উইং পদটি খালি রয়েছে। এ পদটি পূরণ করে দ্রুত মাঠ পর্যায়ে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে ডিএইর ডিজি ছাইফুল আলমকে ফোন দিলেও পাওয়া যায়নি।
সম্প্রতি কৃষিসচিব মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান জানান, বোরো উৎপাদনে কোনো সমস্যা না হলে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে কোনো সঙ্কট হবে না। তাই এখন আমাদের টার্গেট, আগামী বোরো মৌসুমে ভালো উৎপাদন করা।
নিরাপদে চলছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ!

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) গত ২৩ সেপ্টেম্বর দু’টি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, লালশাক, বেগুন, পটোল, ঢেঁড়স, শিম, বাঁধাকপিসহ ৯ ধরনের সবজিতে ক্ষতিকর মাত্রায় ভারী ধাতু এবং লিচুসহ চারটি ফলে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে। নিয়মিত এই খাদ্যগুলো খেলে ক্যান্সারের মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিএফএসএ দ্রুত সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা মন্ত্রণালয়ের সাথে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেয়ার কথা। তবে বিএফএসের চেয়ারম্যান জাকারিয়া জানিয়েছেন, গবেষণাগুলো যারা করেছেন, তারাই দায়বদ্ধ। বিএফএসের সাথে এর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
এর আগে, ফুচকা, চটপটি, আখের রসসহ বিভিন্ন রাস্তার খাবারে ইকোলাইসহ নানা ধরনের ডায়রিয়ার জীবাণু পাওয়া গেছে, কিন্তু সেগুলো দূর করতে বিএফএসএ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এ ছাড়া, ডিম, মুরগি, মাছ, গোশত, আলু এমনকি চালের মধ্যেও ভারী ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া গেলেও সেটা দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি প্রতিষ্ঠানটিকে।

জানা যায়, এ বছরের এপ্রিল মাসে ভারতীয় ব্র্যান্ড এমডিএইচ এবং এভারেস্টের বিরুদ্ধে মসলার মিশ্রণে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী কীটনাশক ইথিলিন অক্সাইডের উপস্থিতির অভিযোগ ওঠে। ক্যান্সার সৃষ্টিকারী এই উপাদানের উচ্চমাত্রার উপস্থিতি পাওয়ায় হংকং এবং সিঙ্গাপুরে ব্র্যান্ড দুটি গুঁড়ো মসলা বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু বিএফএসএ চেয়ারম্যান মসলাগুলো পরীক্ষা করে পদক্ষেপ নেয়ার কথা বললেও, গত পাঁচ মাসে প্রতিষ্ঠানটি মসলাগুলো নিষিদ্ধ করা কিংবা এই বিষয়ে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জনগণকে সচেতন করার উদ্যোগ নেয়নি।

বিএফএসএর সাবেক সদস্য মো: মাহবুব কবির গণমাধ্যমকে বলেন, ‘খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে খাবার টেবিল পর্যন্ত নিরাপদ রাখতে যা করার দরকার, তা বিএফএসএকে করতে হবে। অথচ চাল, ডাল, আলু, শাকসবজি, মাছ, মাংস, ডিম, মুরগি, সবকিছুর মধ্যে মারাত্মক পরিমাণে ভারী ধাতু পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু বিএফএসএ সে বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।’ তিনি আরো বলেন, বিশ্বব্যাপী খাদ্যনিরাপত্তার মতো কর্তৃপক্ষ সাধারণত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে কিংবা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের অধীনে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিএফএসএ কাজ করছে। এই কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা থাকলেও মোবাইল কোর্ট ছাড়া সিলগালা, জব্দ করা বা জরিমানা আদায় করার ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয় না। বিএফএসএর কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির দুটো দুর্বল দিক স্পষ্ট। প্রথমত, খাদ্যদ্রব্য জব্দকরণ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া বিএফএসএ কর্মকর্তাদের জন্য সীমাবদ্ধ, যার জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে উদ্যোগ নিতে হবে। তবে এই বিষয়ে কেউ উদ্যোগী নয়। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর বাজারে মনিটরিং করছে, কিন্তু বিএফএসএ সে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। দ্বিতীয়ত, বিএফএসএ খাদ্য ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স প্রদানের ক্ষমতা চাইছে। ফুড সেইফটি লাইসেন্স ছাড়া কেউ যাতে খাদ্য ব্যবসা না করতে পারে, এবং লাইসেন্স দেয়ার আগে তাদের নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের সব শর্ত পূরণের বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে। আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের টেবিলে পড়ে রয়েছে। ২০২২ সালের ২২ মে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বিএফএসের আইন সংশোধনের বিষয়ে একটি সভা করে। সেই সভায় কিছু সংযোজন পরিমার্জনের নির্দেশ দেয়ার পর খাদ্য মন্ত্রণালয় সেটি বাস্তবায়ন করেনি।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আইন সংশোধন না হলে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকারী বা ব্যবসায়ীদের ওপর বিএফএসএ প্রকৃতপক্ষে মনিটরিং জোরদার করতে পারবে না। এজন্য প্রতিষ্ঠানগুলো বিএফএসএর নির্দেশনাগুলো গুরুত্ব সহকারে নেয় না। আইনটি সংশোধন হলে রফতানি খাদ্যপণ্যের সার্টিফিকেশন নিয়েও কাজ করতে পারে বিএফএসএ। প্রস্তাবনায় জরিমানা বাড়ানোর বা কমানোর প্রস্তাবও রয়েছে। বিএফএসএর চেয়ারম্যান জাকারিয়া গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের ফান্ডে চারটি গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর দায়ভার সম্পূর্ণ তাদের, বিএফএসের নয়। খাবারে ভারী ধাতুর প্রবেশ বন্ধ করতে হলে আরো গবেষণা দরকার, তবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি।’ আইন সংশোধনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আইনের কিছু সংশোধন বিএফএসএতে ফেরত এসেছে। সংশোধনগুলো করে আবার পাঠাতে হবে, প্রক্রিয়াটি জটিল হওয়ায় সময় লাগছে।’

 


আরো সংবাদ



premium cement