১৫ অক্টোবর ২০২৪, ৩০ আশ্বিন ১৪৩১, ১১ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

সিন্ডিকেটের কারসাজি

ঢাকার পাইকারি বাজারে ডিম বিক্রি বন্ধ
সিন্ডিকেটের কারসাজি -


ডিমের বাজার নিয়ে সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সরকারি দামে ডিম কিনতে না পারা, রসিদ না দেয়া ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে জরিমানার অজুহাতে ডিম বিক্রি বন্ধ রেখেছেন রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের আড়তদাররা। এতে দেশের গ্রাহকরা ডিম ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তেজগাঁওয়ের ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে তাদের ডিম কিনতে হচ্ছে। কিন্তু কেনা দামের ভিত্তিতে তা বিক্রি করতে পারছেন না। সরকার নির্ধারিত দাম নিশ্চিত করতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। তাই ভোক্তা অধিদফতরের অভিযান ও জরিমানার ভয়ে তারা মুরগির ডিম বিক্রি বন্ধ রেখেছেন। ফলে গতকাল রাতে তেজগাঁওয়ে ডিমের কোনো গাড়ি আসেনি; কোনো ডিমও বিক্রি হয়নি।
গতকাল রাজধানীর তেঁজগাও ডিমের আড়তে গিয়েদেখা যায় রোববার রাতে ডিমের আড়তে কাক্সিক্ষত বেচা-কেনা হয়নি। অনেক আড়তই বন্ধ ছিল। এই সুযোগে ডিমের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন মহল্লার খুচরা ব্যবসায়ীরা। তারা ক্রেতাদের কাছে এক হালি ডিম ৬৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছেন। ডজন বিক্রি করছেন ১৯০ টাকা পর্যন্ত।

রাজধানীতে ডিম বিক্রির অন্যতম বড় পাইকারি বাজার হচ্ছে তেজগাঁও আড়ত। দেশের বিভিন্ন স্থানের খামার থেকে ট্রাকে করে এখানে ডিম আসে। এর পর তেজগাঁও থেকে ঢাকার বিভিন্ন খুচরা বাজার ও পাড়া-মহল্লায় ডিম সরবরাহ হয়। ফলে তেজগাঁওয়ে ডিম বিক্রি বন্ধ রাখলে সাধারণত খুচরা বাজারে তার প্রভাব পড়ে।
রাজধানীর কয়েকটি খুচরা বাজারে গতকাল খোঁজ নিয়ে দেখা যায় এসব বাজারে ফার্মের মুরগির এক ডজন বাদামি ডিম ১৮০ টাকা ও সাদা ডিম ১৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ডিমের সরবরাহ তুলনামূলক কম বলেও জানান বিক্রেতারা। এ দিকে ডিমের বাজার স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত ডিম সংগ্রহ ও বিপণন বন্ধ রাখার কথা বলছেন ব্যবসায়ী নেতারা।

তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আমানত উল্লাহ আমান বলেছেন, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সরকারিভাবে একটা রেট বেঁধে দিয়েছেন। কিন্তু আমরা নির্ধারিত দামে ডিম কিনতে পারছি না। এই পরিস্থিতিতে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আমরা গাড়ি বন্ধ করে রেখেছি। তিনি বলেন তেজগাঁওয়ে দৈনিক ১৪-১৫ লাখ ডিম আসে। ঢাকায় ডিমের চাহিদা এক কোটি। তেজগাঁওয়ের বাইরে কিছু জায়গায় অনেকে ঠিকই উচ্চ দামে ডিম বিক্রি করছেন। কিন্তু বাড়তি দামে কেনাবেচার কারণে শুধু তাদের দায়ি করা হচ্ছে, অভিযান চালানো হচ্ছে। এ জন্য ডিম বিক্রি বন্ধ রেখেছেন তারা।
ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি বলেন, সরকারের নিয়ম না মানলে জরিমানা ও শাস্তি হতে পারে। তাই এখন বিক্রি বন্ধ রেখে কী করা যায়, সে উপায় খুঁজছেন। গতকাল সকালে ভোক্তা অধিদফতরের কার্যালয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তবে সেখানে সভা থাকায় কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। বিকেলে আবার কথা বলতে যাবেন বলে তিনি জানান।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিমের চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়া এখন বাজারে সব ধরনের শাকসবজির দাম চড়া। ফলে চাপ পড়েছে ডিমের ওপর। তবে প্রান্তিক খামারিদের অভিযোগ, অসাধু ব্যবসায়ীরা ডিমের দাম বাড়াচ্ছেন। করপোরেট গ্রুপ ও তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ীদের আধিপত্যের কারণে ডিমের বাজারে এই অস্থিরতা।

বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, ঢাকা কেন্দ্রিক একে গোষ্ঠী সিন্ডিকেট করে ডিমের দাম বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু এর সুফল প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা পায় না। ক্রেতাদের বাড়তি দামে ডিম খেতে হয়। বাড়তি মুনাফার টাকা যায় সিন্ডিকেটের পকেটে।
সরকারের নজরদারি এবং আমদানির খবরে ডিমের দাম কিছুটা কমলেও তা খুব একটা স্থায়ী হবে না বলছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন ডিমের দাম এখন কিছুটা কমে আসলে আবারও বেড়ে যাবে। সরকারের উচিত উৎপাদন পর্যায়ে খরচ কমিয়ে আনতে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া। এর পাশাপাশি অসাধু সিন্ডিকেট ভাঙতে কঠোর হওয়ার পরামর্শ তাদের। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিমের দাম বাড়ার সঙ্গে দেশের বিভিন্ন জেলায় সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বন্যা একটি বড় কারণ। বন্যার কারণে ডিমের সরবরাহ কমেছে বলে তারা মনে করছেন।

বাংলাদেশ এগ প্রোডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তাহের আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ডিম উৎপাদনে পরিপূরক খাদ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। ডিমের উৎপাদন খরচ না কমলে ডিমের দাম কমবে না। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যে দেখা যায় ২০২২ এর শুরুর দিকে ডিমের ডজন বাজারে ছিল ৮০ থেকে ১১০ টাকার মধ্যে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর কয়েক মাসের ব্যবধানে তা গিয়ে ঠেকে ১২৫ থেকে ১৩৫ টাকায়। ২০২৩ সালে ডিসেম্বরে এই ডিমের দাম দেড়শ’ টাকা পার হয়। এরপর আর দাম তেমন একটা কমেনি। সবশেষ চলতি সপ্তাহের শুরুতে ডিম ১৮০-১৯০ টাকা ডজনে গিয়ে ঠেকে।
এ দিকে ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রামেও ডিম বিক্রি বন্ধ রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। তারাও একই রকম দাবিতেই মূলত ডিম বিক্রি বন্ধ রেখেছেন। আড়তে গিয়ে দোকানগুলোও বন্ধ রয়েছে। তবে ভোক্তাদের দাবি ব্যবসায়ীরা ইচ্ছা করেই বিক্রি বন্ধ করে রেখেছেন। আড়তের ভেতরে প্রচুর ডিম মজুদ করে রেখে কৃত্রিম এই সঙ্কট তৈরি করে রাখা হয়েছে বলেও অভিযোগ তাদের।

চট্টগ্রামে ডিম বিক্রি করছে না পাহাড়তলির আড়তদাররা
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রামে সরকারের বেঁধে দেয়া দামে ডিম বিক্রি করতে না পারায় গত দুই দিন ধরে বন্ধ রয়েছে চট্টগ্রাম নগরের অন্যতম পাহাড়তলি বাজারের ডিমের আড়ত। ফলে খুচরা বাজারে বাড়ছে ডিমের দাম।
পাহাড়তলি পাইকারি ডিমের ১৫টি আড়তের রয়েছে। সেখানে গত দুই দিন ধরে ঝুলছে তালা। নগরের বিভিন্ন স্থান থেকে খুচরা ব্যবসায়ীরা ডিম কিনতে এসে ফেরত যাচ্ছেন খালি হাতে। আবার স্থানীয় খুচরা ব্যবসায়ীরাও বাধ্য হয়ে বন্ধ রেখেছেন দোকান।
পাহাড়তলি ডিম আড়তদার সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল শুক্কুর লিটন বলেন, গত সেপ্টেম্বর মাসে ডিমের দাম নির্ধারণ করে দেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কিন্তু সরকারের নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে সরবরাহকারী মধ্যস্থভোগী ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো বাড়তি দামে ডিম সরবরাহ করছে। এ জন্য আমরাও বাড়তি দামে ডিম বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। কিন্তু এর মধ্যে সরকারের বেঁধে দেয়া দামে ডিম বিক্রি না করার কারণে আমাদেরকে জরিমানা করা হচ্ছে। তাই বাধ্য হয়েই আমরা দোকান বন্ধ রেখেছি। তিনি বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত সরবরাহকারীরা সরকারের নির্ধারিত মূল্যে ডিম সরবরাহ করবে না আমাদের আড়তও ততদিন বন্ধ থাকবে। এর আগে গত সেপ্টেম্বরে খুচরা পর্যায়ে প্রতি পিস ডিমের দাম ১১ টাকা ৮৭ পয়সা দাম বেঁধে দেয় সরকার। সে হিসাবে প্রতি ডজন ডিমের দাম ১৪২ টাকা। তবে প্রশাসনের নির্দেশনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বর্তমানে প্রতিটি ডিম সরবরাহ করছে ১২টা ২০ পয়সায়। ফলে অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় চলে যায় ডিমের দাম।
ভোক্তা অধিকার সংরণ অধিদফতর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ফয়েজ উল্যাহ বলেন, ‘আমরা খবর পাওয়ার পর আমাদের একটি প্রতিনিধিদল পাহাড়তলি বাজারে আড়তে যান। আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement