উৎপাদক ও ভোক্তার মূল্যে বিস্তর ব্যবধান
- শাহ আলম
- ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:২৭
দেশজুড়ে অব্যাহত বৃষ্টি এবং গ্রীষ্মকালীন ফসল শেষ হয়ে যাওয়ায় দেশের সব জায়গাতেই চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে শাক-সবজি। তবে প্রাকৃতিক কারণ ছাড়াও সঠিক তদারকির অভাব এবং পাইকারি বিক্রেতাদের কারসাজিও বাজারে সবজির দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। সরকারি হিসেবেই গত ১০ দিনে ঢাকার বাজারগুলোতে সব ধরনের সবজির দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কোনো কোনো সবজির দাম তিনগুণের বেশি বেড়েছে বলে জানানো হয়েছে।
এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) জানিয়েছে, আগস্ট মাসে পূর্বাঞ্চলে বন্যার পানিতে প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমির শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ময়মনসিংহ ও রংপুর অঞ্চলে সাম্প্রতিক বন্যায় প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমির সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে সবজির বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা মনে করছেন।
গতকাল ঢাকার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায় প্রতি কেজি আলু আগের মূল্য ৬০ টাকায় বিক্রি হলেও প্রতি কেজি পটোল এর দাম বেড়ে ৮০ থেকে ৯০ টাকা, বেগুন প্রতি কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকা, মুলা ৯০ থেকে ১০০ টাকা, করলা ১১০ থেকে ১২০ টাকা, ঢেঁড়স ৯০-১০০ টাকা, পেঁপে ৫০ থেকে ৬০ টাকা, পেঁয়াজ ১১৫ থেকে ১২০ টাকা, কাঁচামরিচ ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, বরবটি ১২০ থেকে ১৫০ টাকা এবং আগাম শীতকালীন সবজি দেশী শিম ২৮০-৩২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
ঢাকার কাওরানবাজার এবং যাত্রাবাড়ীর বেশ কয়েকজন আড়তদার ও পাইকারি বিক্রেতার সাথে কথা বলে জানা যায় খুচরার চেয়ে পাইকারি বাজারদর ২০ থেকে ৩৫ শতাংশ কম। আর কৃষক পর্যায়ে শতকরা ৬০ থেকে ৭০ কম।
বগুড়া জেলার অন্যতম বড় পাইকারি মোকাম মহাস্থান হাট। এখান থেকে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন শহর ও এলাকায় সবজি সরবরাহ করা হয়। গতকাল এখানে আগাম কাটা দেশী শিম পাইকারি বাজারে বিক্রি হয়েছে ২৪০-২৬০ টাকা কেজি দরে, করলা ৮০ থেকে ৯০ টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৫০ টাকা। এভাবে প্রতি কেজি বেগুন ও কাঁকরোলের দাম ৩০ টাকা থেকে বেড়ে ৮০ টাকায়, পটোল ২৫ টাকা থেকে বেড়ে ৬০ টাকায়, শসা ৩০-৪০ টাকা থেকে ৫০ থেকে ৬০ টাকায় উঠেছে। ঢেঁড়স, পেঁপে, মিষ্টিকুমড়া, কচুমুখী, মুলাসহ অন্যান্য সবজির দামও আগের চেয়ে কেজিতে ১০ থেকে ৩৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এই পাইকারি হাটে সপ্তাহের ব্যবধানে কাঁচামরিচের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। অর্থাৎ গতকাল প্রতি কেজি কাঁচামরিচ ২৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
মহাস্থান হাটের পাইকারি সবজি ব্যবসায়ীরা বলছেন বৃষ্টিতে অনেক ক্ষেতের সবজি নষ্ট হয়ে গেছে। এ কারণে হাটে সবজির সরবরাহ কম। অন্যান্য বছর এ সময় শীতকালীন আগাম সবজিতে হাট ভরে যেত। এবার মুলা ও লাউ ছাড়া শীতকালীন অন্যান্য সবজির তেমন সরবরাহ নেই। এসব কারণে সবজির দাম বাড়ছে বলে তারা জানান।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সবজি বিক্রেতা মহসিন আলী বলেন, গত সপ্তাহে পাইকারি বাজারে সবজির দাম ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়েছে। গ্রীষ্মকালীন ফসলের মজুদ শেষ হওয়ার পর সীমিত সংখ্যক পাইকার সবজি নিয়ে আসার কারণে সরবরাহও কমে গেছে। এতে সবজির বাজার ঊর্ধ্বমুখী বলে তিনি জানান।
ময়মনসিংহ মিন্টু কলেজ রেলগেট বাজারের সবজি বিক্রেতা মফিদুল নয়া দিগন্তকে বলেন কৃষকের ক্ষেত থেকে কেনা সবজি প্রথমে স্থানীয় বাজারে বেচাকেনা হয়। যে সবজি ক্ষেতে ২০ টাকা কেজি সেই সবজি স্থানীয় বাজারে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আড়তে সেই সবজি ৬০ থেকে ৭০ টাকা দরে বিক্রি হয় এবং ক্রেতা পর্যায়ে এসে ৯০ থেকে ১০০ টাকা দরে বিক্রি হয়ে থাকে।
কাওরানবাজারে ইমরান আলী নামে এক আড়তদার বলেন চলতি বছর আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় দেশের বাজারে সব ধরনের সবজির দাম বাড়ছে। তাছাড়া চলতি বছরের কয়েক দফা বন্যার কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনেক ফসলি জমি নষ্ট হয়েছে। কৃষক মাঠ থেকে ফসল তুলে আনার সময় তা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় জোগান কমেছে। ফলে সব ধরনের সবজির দাম এখন আকাশচুম্বী।
মিরপুর-১ নম্বর এলাকার সবজির পাইকারি ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, গ্রীষ্মের শেষে সবজির দাম কিছুটা বেশি থাকে। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। পরপর দু’বার ভয়াবহ বন্যা ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে সবজির সরবরাহ কম হচ্ছে। প্রত্যন্ত এলাকার মোকামগুলোতে এখন সবজির দাম বেশি। এর প্রভাব রাজধানীর বাজারে পড়বে এটা খুবই স্বাভাবিক বলে তিনি মনে করেন।
তবে বাজারে আসা ভোক্তারা বলছেন, ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল করে তুলেছে। মিরপুর রূপনগর এলাকার বাসিন্দা আব্দুল হালিম বলেন, আমরা বড় এক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এ সময় দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও টালমাটাল। আমাদের মতো চাকুরেরা বাজার করতে এসে নি¤œ ও মধ্যম আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে বলে তিনি জানান।
কৃষি বিপণন বিভাগের (ডিএএম) সহকারী পরিচালক টি এম রাশেদ খান নয়া দিগন্তকে বলেন, বর্তমানে গ্রাম পর্যায়ে এবং শহরের খুচরা বাজারের মধ্যে মূল্যের ১০০ থেকে ২৫০ শতাংশের ব্যবধান রয়েছে। সবজির দাম বৃদ্ধির জন্য এটি বড় ভূমিকা পালন করছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, যদিও গ্রামে সবজির দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে শহরের খুচরা বাজারে সে তুলনায় দাম অনেক বেশি।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ও কৃষি ব্যবসা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক গোলাম হাফিজ কেনেডি বলেন, শহরের পাইকারি বাজারে বেশ কিছু ব্যবসায়ী রয়েছে যারা বাজারকে অস্থিতিশীল করছে। এসব ব্যবসায়ীর অধিকাংশেরই পূর্ববর্তী সরকারের সাথে যোগসূত্র রয়েছে এবং তারা কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করছে।
তিনি বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে শহরের সব পাইকারি সবজি বিক্রেতাদের একটি তালিকা থাকা উচিত। এবং তাদের নিয়মিত মনিটরিংয়ের আওতায় আনা উচিত যা কেবলমাত্র বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে ভূমিকা রাখতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা