২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৬ পৌষ ১৪৩১, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ইসরাইলের সামরিক ঘাঁটিতে হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা

-

- নতুন শীর্ষ কমান্ড গঠন হিজবুল্লাহর, দীর্ঘ যুদ্ধের প্রস্তুতি
- লেবাননের ২২ গ্রাম-শহরের বাসিন্দাদের সতর্কতা ইসরাইলের
- ২৪ ঘণ্টায় বিমান হামলায় নিহত আরো ৬০ লেবানিজ
- লেবানন ছেড়ে সিরিয়ায় পালিয়েছে ৪ লক্ষাধিক মানুষ

দখলদার ইসরাইলের বন্দর নগরী হাইফায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে লেবাননের শক্তিশালী প্রতিরোধ সংগঠন হিজবুল্লাহ। দলটি জানিয়েছে, গতকাল শনিবার তারা ইসরাইলের বন্দর নগরী হাইফার উপকূলের দক্ষিণে অবস্থিত একটি সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে। তবে ইসরাইলি সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে, হাইফায় কোনো হামলা বা সতর্কতামূলক সাইরেনের শব্দ শোনা যায়নি। হাইফার হামলার কথা স্বীকার না করলেও উত্তরাঞ্চলীয় বেশ কয়কটি অবৈধ বসতিতে হামলার তথ্য নিশ্চিত করেছে দখলদার ইসরাইল। খবর : আলজাজিরা, এএফপি ও টাইমস অব ইসরাইল।

ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরাইল জানিয়েছে, সাফেদ, রোস পিনা, মাখানাইম, বিরিয়েহ, হাৎজোর হাগলিলিট, কাদিতা, আমুকা, তাহার শিল্প জোন, বার ইয়োচাই এবং ডালটনে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সাইরেন বাজতে শোনা গেছে। এর কিছুক্ষণ পর দখলদার ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানায়, হিজবুল্লাহর ছোড়া অন্তত ৩০টি রকেট ইসরাইলে প্রবেশ করছে। এর মধ্যে কিছু রকেট মাঝ আকাশেই ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। বাকিগুলো কোনো বাড়ি বা অবকাঠামোতে আঘাত হেনেছে কি না; এ বিষয়টি স্পষ্ট করেনি তারা। এদিকে ইসরাইলের উত্তরাঞ্চলের অবৈধ বসতির বাসিন্দাদের নিজবাড়ি থেকে দূরে থাকতে সতর্র্কবার্তা দিয়েছে হিজবুল্লাহ। প্রতিরোধ সংগঠনটি এক বিবৃতিতে বলেছে, উত্তরাঞ্চলের সাধারণ মানুষের বাড়িগুলোকে সামরিক কাজে ব্যবহার করছে ইসরাইলি সেনারা। ফলে এসব জায়গায় ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হবে। হিজবুল্লাহ সাধারণ ইসরাইলিদের উদ্দেশে বলেছে, নিজেদের জীবন রক্ষায় এসব বাড়িতে যেন তারা না আসেন।

হিজবুল্লাহ তাদের সর্বশেষ সতর্কতায় আরো বলেছে, এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে সেগুলো তাদের কাছে থাকা মজুদের খুবই সামান্য পরিমাণ। যদি ইসরাইলিরা হামলা বন্ধ না করে তাহলে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া অব্যাহত থাকবে বলেও জানিয়েছে তারা।
নতুন শীর্ষ কমান্ড হিজবুল্লাহর : এদিকে ইসরাইলের হামলায় শীর্ষ নেতাদের হারিয়ে হিজবুল্লাহ দক্ষিণ লেবাননে দীর্ঘ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ ছাড়া হিজবুল্লাহ শীর্ষ কমান্ড গঠনের কাজও শুরু করেছে দলটি। হিজবুল্লাহর কার্যক্রমের সাথে পরিচিত দু’টি সূত্র বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এসব তথ্য জানিয়েছে। হিজবুল্লাহর এক শীর্ষস্থানীয় কমান্ডার জানিয়েছেন, হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হওয়ার তিন দিনের মধ্যে নতুন একটি কমান্ড সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। ১ অক্টোবর থেকে সেটি কার্যকরও রয়েছে।

এদিকে গত মাসে হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় সংগঠনটির বহু স্থাপনা। তবে হিজবুল্লাহ-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ইসরাইলের হামলার পরও সংগঠনটির হাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অস্ত্র রয়েছে। নিজেদের সবচেয়ে শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্রগুলো এখনো ব্যবহার করেনি তারা। এ ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। ইসরাইলের থিংকট্যাঙ্ক সংস্থা আলমার বিশ্লেষক ও কর্মকর্তা আভরাহাম লেভিন রয়টার্সকে বলেন, ‘আইডিএফের হামলায় শুধু হিজবুল্লাহর হাইকমান্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, গোষ্ঠীটির অস্ত্রগ্রন্ডার, যোদ্ধাবাহিনী ও অন্যান্য সক্ষমতায় কিন্তু এ অভিযানের তেমন প্রভাব পড়েনি।’ হিজবুল্লাহ দক্ষিণ লেবাননে দীর্ঘ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ ছাড়া নতুন এ সামরিক কমান্ড দিয়েই ইসরাইলে রকেট হামলা ও স্থলযুদ্ধের নির্দেশনা দিচ্ছে ইরানপন্থী প্রতিরোধ যোদ্ধাদলটি। এ ছাড়া হিজবুল্লাহর নতুন নেতৃত্ব গোপনে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির একজন কমান্ডার। তবে সদস্যদের সাথে নতুন নেতারা কীভাবে যোগাযোগ করছেন বা নেতৃত্বে কারা রয়েছেন, সে বিষয়ে কিছুই বলেননি তিনি। নাসরুল্লাহর মৃত্যুর পর হাসেম সাফিউদ্দিন তার স্থলাভিষিক্ত হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছিল। তবে তিনিও পরে ইসরাইলের হামলায় নিহত হন। গত ১ অক্টোবর থেকে নতুন কমান্ড গঠনের পর নাসরুল্লাহর স্থলাভিষিক্ত কে হয়েছেন তা নিয়েই এখন জোর আলোচনা চলছে।

লেবাননের বাসিন্দাদের সতর্কবার্তা : অন্য দিকে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী দক্ষিণ লেবাননের আরো ২২টি শহর ও গ্রামের বাসিন্দাদের অবিলম্বে সরে যেতে বা নিহত হওয়ার ঝুঁকির কথা বলে সতর্কবার্তা দিয়েছে। ইসরাইলি সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র এক্স-এ বলেছেন, আপনাদের দক্ষিণে যেতে নিষেধ করা হয়েছে এবং দক্ষিণের দিকে যেকোনো চলাচল আপনার জীবনের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। বাসিন্দাদের অবশ্যই আল-আওয়ালি সাগরের উত্তরে যেতে হবে, বলেন ওই মুখপাত্র। তা ছাড়া ইসরাইলি সামরিক বাহিনী গতকাল শনিবার দক্ষিণ লেবাননের বাসিন্দাদের সতর্ক করে বাড়িতে ফিরে যেতেও নিষেধ করেছে।

ইসরাইলের সামরিক মুখপাত্র আভিচায় আদ্রেই বলেছেন, ‘ইসরাইলি বাহিনী আপনাদের গ্রাম বা এর আশপাশে হিজবুল্লাহর পোস্টগুলো লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে। নিজেদের সুরক্ষার জন্য পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বাড়িতে ফিরে যাবেন না। দক্ষিণে যাবেন না; দক্ষিণে গেলে জীবন ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।’ এ ছাড়া একটি আলাদা পোস্টে আদ্রেই দক্ষিণ লেবাননের স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসাদলের প্রতি আহ্বান জানান, যাতে তারা অ্যাম্বুল্যান্স ব্যবহার থেকে বিরত থাকে। তিনি দাবি করেন, হিজবুল্লাহ যোদ্ধারাও অ্যাম্বুল্যান্স ব্যবহার করে।
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা চিকিৎসাদলগুলোকে হিজবুল্লাহ সদস্যদের সাথে যোগাযোগ না করতে এবং তাদের সহযোগিতা থেকে বিরত থাকতে বলছি। যেকোনো ধরনের গাড়ি, যেটিতে সশস্ত্র ব্যক্তিরা থাকবে, তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ আদ্রেই শনিবার জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরের দক্ষিণে শেখ রাদওয়ান এলাকার বাসিন্দাদের সরিয়ে নেয়ার আহ্বানও জানান। ওই এলাকার বাসিন্দাদের গাজার দক্ষিণাঞ্চলের মানবিক অঞ্চলে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, ‘নির্দিষ্ট এলাকা ও এর আশ্রয়কেন্দ্রগুলো বিপজ্জনক যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত।’
২৪ ঘণ্টায় নিহত ৬০ : বার্তা সংস্থা এপির বরাত দিয়ে আলজাজিরা জানিয়েছে, লেবাননে গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলি বিমান হামলায় ৬০ জন নিহত এবং ১৬৮ জন আহত হয়েছেন। লেবাবনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শুক্রবার থেকে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। গত বছর থেকে ইসরাইল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে সঙ্ঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে বৈরুতে ইসরাইলি হামলায় এ পর্যন্ত দুই হাজার ২২৯ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এ ছাড়া আহত হয়েছে ১০ হাজার ৩৮০ জন।

গত ২৪ ঘণ্টায় দক্ষিণ লেবাননে ৫৭টি বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। বিশেষ করে বৈরুতের উপশহর এবং বেক্কা ভ্যালিকে লক্ষ্য করে এ হামলা চালানো হয়। এ দিকে দক্ষিণ লেবাননে ইসরাইলের স্থল অভিযানের ফলে এক হাজার ৩২টি কেন্দ্রে এক লাখ ৮৭ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। যার মধ্যে ৩৯ হাজার পরিবার রয়েছে। এসব আশ্রয় কেন্দ্রের মধ্যে ৮৩৭টি পূর্ণ হয়ে গেছে।

সিরিয়ায় পালিয়েছে চার লক্ষাধিক : এ দিকে ইসরাইলি হামলার মুখে চার লাখ ২০ হাজারের বেশি মানুষ লেবানন ছেড়ে সিরিয়ায় পালিয়েছে। তাদের অধিকাংশই সিরীয় নাগরিক। তুর্কি সংবাদমাধ্যম আনাদোলু এজেন্সির খবর অনুসারে, গত শুক্রবার জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসঙ্ঘের শরণার্থী সংস্থা এ তথ্য জানিয়েছে। খবরে বলা হয়, জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার সংস্থার মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি বলেছেন, ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত তিন লাখ ১০ হাজারের বেশি সিরীয় এবং এক লাখ ১০ হাজার লেবাননের নাগরিক সিরিয়ায় পাড়ি দিয়েছে।
ঘনবসতিপূর্ণ লেবাননের রাজধানী বৈরুত ক্রমবর্ধমানভাবে ইসরাইলি হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। রাভিনা বলেন, হামলায় শত শত মানুষ নিহত হয়েছেন এবং ১০ লাখের বেশি মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement