২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

লেবাননে জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষীদের ওপর ইসরাইলি হামলা : বিশ্বজুড়ে নিন্দা

-

- বৈরুতে বিমান হামলা, নিহত ২২ আহত শতাধিক
- পূর্ব সতর্কতা নিয়ে ইসরাইলের প্রতারণা

দক্ষিণ লেবাননে জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষীদের ব্যবহৃত একটি ওয়াচ টাওয়ারে (সদর দফতর) ইসরাইলি বাহিনী হামলা চালিয়েছে। এতে দুইজন জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্য আহত হয়েছেন। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। শান্তিরক্ষা মিশনের সদর দফতরে দখলদার বাহিনীর হামলার ঘটনায় ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েছে ইসরাইল।
লেবাননের ন্যাশনাল নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুসারে, দক্ষিণ লেবাননে জাতিসঙ্ঘের অন্তর্বর্তী বাহিনীর (ইউনিফিল) সদর দফতরকে লক্ষ্য করে ইসরাইলি হামলায় বেশ কয়েকজন শ্রীলঙ্কার শান্তিরক্ষী আহত হয়েছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি ইসরাইলি মেরকাভা ট্যাংক ইউনিফিলের একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ারকে লক্ষ্য করে হামলা চালালে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। টাওয়ারটি একটি লেবানিজ আর্মি চেকপয়েন্টের সামনে টায়ার থেকে নাকোরার সাথে সংযোগকারী প্রধান সড়কে অবস্থিত।
জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী বলেছে, নাকোরা শহরে তাদের কার্যালয়ের ওপর ইসরাইলি ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়েছে। একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে আঘাত হানা হয়েছে এবং দুইজন শান্তিরক্ষী আহত হয়েছেন। আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এক বিবৃতিতে ওই এলাকায় গোলাবর্ষণের কথা স্বীকার করেছে ইসরাইল। তাদের দাবি- হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা জাতিসঙ্ঘের ওই কার্যালয়ের কাছে তৎপরতা চালাচ্ছিল। ইসরাইলের সামরিক বাহিনী বলেছে, তারা ঘটনাটি খতিয়ে দেখছে।

লেবাননে নিয়োজিত জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা মিশন ইউনাইটেড নেশনস ইন্টারিম ফোর্স ইন লেবানন (ইউনিফিল) এক বিবৃতিতে বলেছে, তাদের কার্যালয় ও সংলগ্ন এলাকায় বারবার আঘাত হানা হচ্ছে। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী পার্শ্ববর্তী একটি বাংকারেও গুলি চালিয়েছে যেখানে শান্তিরক্ষীরা আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই গোলাবর্ষণের ফলে একাধিক গাড়ি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউনিফিল।
বিভিন্ন দেশের নিন্দা : লেবাননের তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী মিকাতি দক্ষিণ লেবাননে জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর ওপর ইসরাইলি হামলা একটি ঘৃণ্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মিকাতি ইসরাইলের সাথে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবিতে জাতিসঙ্ঘে একটি প্রস্তাবের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ইসরাইলকে বেসামরিক মানুষ ও আবাসিক এলাকায় হামলা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, গতকালের (বৃহস্পতিবার) হামলায় ১৩৯ জন নিহত হয়েছে। তারা সবাই বেসামরিক নাগরিক। এটা আর গ্রহণযোগ্য নয়। কোথায় মানবতা? আমরা কোন বাস্তবতায় বাস করছি?
যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, এই ধরনের হামলায় তারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। হোয়াইট হাউজ বলেছে, আমরা বুঝতে পারছি ইসরাইল হিজবুল্লাহর অবকাঠামো ধ্বংস করার জন্য ব্লু লাইনের কাছে টার্গেটেড অপারেশন চালাচ্ছে; তবে জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য তাদের হুমকি না হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ইতালির প্রতিরক্ষামন্ত্রী গুইডো ক্রসেটো জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর ওপর ইসরাইলি হামলাকে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ ও আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের অত্যন্ত গুরুতর লঙ্ঘনের ঘটনা হিসেবে নিন্দা করেছেন। তার মতে, ইসরাইলি বাহিনী লেবাননে জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষীদের ব্যবহৃত অবস্থানে গুলি চালিয়ে অবৈধ কাজ করেছে। এক সংবাদ সম্মেলনে গুইডো ক্রসেটো বলেন, এটি একটি ভুল এবং একটি দুর্ঘটনা ছিল না। ক্রসেটো বলেছেন, তিনি প্রতিবাদ করার জন্য তার ইসরাইলি প্রতিপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেছেন এবং একটি ব্যাখ্যা দাবি করার জন্য ইতালিতে ইসরাইলি রাষ্ট্রদূতকেও তলব করেছেন।
চীন এই ঘটনার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ ও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। লেবাননে জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর বরাত দিয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং বলেন, ইউনিফিলের অবস্থান ও পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর হামলার ঘটনায় চীন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং তীব্র নিন্দা জানায়। স্পেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা ইউনিফিল সদর দফতরে ইসরাইলি গোলাবর্ষণের তীব্র নিন্দা করছে। ইউরোপের এই দেশটি এই হামলাকে আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন বলেও অভিহিত করেছে। অন্য দিকে আইরিশ প্রধানমন্ত্রী সাইমন হ্যারিস বলেছেন, ইউনিফিল সৈন্য বা অবকাঠামোর আশপাশে যেকোনো গুলিবর্ষণ বেপরোয়া কাজ এবং এগুলো অবশ্যই বন্ধ করা উচিত। ইন্দোনেশিয়ার জাতিসঙ্ঘের রাষ্ট্রদূত হরি প্রাবোয়ো বলেছেন, শান্তিরক্ষীদের লক্ষ্য করে ইসরাইলি গোলাবর্ষণ স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে কিভাবে ইসরাইল নিজেদেরকে আন্তর্জাতিক আইনের ঊর্ধ্বে, দায়মুক্তির ঊর্ধ্বে এবং আমাদের শান্তির যৌথ মূল্যবোধের ঊর্ধ্বে অবস্থান করছে।
জাতিসঙ্ঘের নিন্দা : জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব লেবাননে জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষীদের লক্ষ্য করে ইসরাইলি গোলাবর্ষণের নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, তাদের (শান্তিরক্ষী) অবশ্যই রক্ষা করা উচিত। জাতিসঙ্ঘের প্রধান জোর দিয়ে বলেছেন, বিশ্ব মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্ঘাত বাড়ার সুযোগ দিতে পারে না; এটি বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি। গত বৃহস্পতিবার লেবাননে ইসরাইলি হামলায় দুই ইন্দোনেশিয়ান শান্তিরক্ষী আহত হওয়ার পর আবারো হামলার এই ঘটনা ঘটল।

বৈরুতে নিহত ২২ : এ দিকে লেবাননের রাজধানী বৈরুতের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা নুইরি এবং বাস্তার আবাসিক ভবনগুলোতে ভয়াবহ বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। এতে কমপক্ষে ২২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১১৭ জন। প্রতিরোধ সংগঠন হিজবুল্লাহর উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তাকে লক্ষ্য এই হামলা চালানো হয় বলে জানা গেছে। গতকাল শুক্রবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, সাংবাদিকরা দেশটির রাজধানীর ছোট শিয়া এলাকা বাচৌরাতে হামলার স্থান থেকে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান। পরে ঘটনাস্থলে উদ্ধারকর্মীদের ধ্বংসস্তূপে উদ্ধার তৎপরতা চালাতে দেখা গেছে। পরে অ্যাম্বুলেন্সগুলোতে করে অনেক আহত ব্যক্তিকে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বেশ কিছু মিডিয়া রিপোর্টে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, ইসরাইলের এই হামলার স্পষ্ট লক্ষ্য ছিল ওয়াফিক সাফা। তিনি নিহত হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহর শ্যালক এবং দলের একজন উচ্চপদস্থ নিরাপত্তা কর্মকর্তা। তবে হিজবুল্লাহর মিডিয়া অফিস এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। লেবাননের রাজধানীতে তুলনামূলকভাবে দু’দিন শান্ত থাকার পর হামলার এই ঘটনাটি ঘটেছে। হামলার বিষয়ে আগে থেকে কোনো সতর্কতা ছিল না এবং ইসরাইল প্রতিরক্ষা বাহিনীও (আইডিএফ) এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
ইসরাইলের সতর্কতা প্রতারণামূলক : মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আল মায়িদিনের খবর অনুসারে, ইসরাইলি বাহিনী দাবি করে আসছে যে লেবাননে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় অভিযান পরিচালনার আগে বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার আহ্বান জানায় তারা। তবে এটিকে অকার্যকর এবং প্রতারণমূলক বলে আখ্যা দিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। বৈরুতের দক্ষিণ শহরতলিতে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বড়সড় অভিযান চালাচ্ছে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী। অভিযোগ উঠেছে, ইসরাইলি হামলার লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে লেবাননের নিরীহ জনগণ।

অ্যামনেস্টি তাদের সাম্প্রতিক বিবৃতিতে বলেছে, উচ্ছেদ সতর্কতা তখনই বিবেচনা করা যেতে পারে যখন বাসিন্দাদের তাদের বাড়ি এবং এলাকা ছেড়ে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় দেয়া হয়। আর ইসরাইলি বাহিনী বারবার সতর্কতা জারি করে ‘স্বল্প নোটিশে, মধ্যরাতে ও সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে, যখন অনেক মানুষ ঘুমিয়ে থাকবে।’ অ্যামনেস্টি এমন একটি উদাহরণ দিয়ে বলেছে, বৈরুতে বোমাবর্ষণ শুরু হওয়ার আগে ৩০ মিনিটেরও কম সময় দেয়া হয়েছিল। অ্যামনেস্টি আরো বলেছে, ইসরাইল আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা সুরক্ষিত বেসামরিক নাগরিকদের সাথে এমন অনায্য আচরণ করতে পারে না। যারা অক্ষমতাসহ অসংখ্য কারণে তাদের বাড়ি ছেড়ে যেতে পারেনি। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইসরাইলকে সর্বদা আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে তার বাধ্যবাধকতাগুলো মেনে চলতে হবে, যেখানে তারা যেখানেই থাকুক না কেন বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষতি কমানোর জন্য সমস্ত সম্ভাব্য সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement