১১ অক্টোবর ২০২৪, ২৬ আশ্বিন ১৪৩১, ৭ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

রাখাইনে আরাকান আর্মির রোহিঙ্গা নিধন অব্যাহত

-

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বুথিডাং শহরে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর আরাকান আর্মির হত্যা নির্যাতন অব্যাহত গতিতেই চলছে। রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে উভয় সঙ্কটে। একদিকে জান্তা সরকার তাদের অপহরণ করে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়তে বাধ্য করছে। অন্যদিকে আরাকান আর্মির হত্যাযজ্ঞ থেকে রোহিঙ্গারা পালিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বাংলাদেশেও আসতে পারছে না। জঙ্গলে আশ্রয় নিলেও সামরিক জান্তা কিংবা আরাকান আর্মির হাতে তাদের অপহরণের শিকার হতে হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের হাজার হাজার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। যৌন সহিংসতার শিকার হচ্ছে রোহিঙ্গা নারীরা। বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন রাখাইন রাজ্যের বুথিডাং শহরে এ ধরনের ভয়ানক নির্যাতন, নিপীড়ন আর গণহত্যার মর্মান্তিক তথ্য উঠে এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দি ডিপ্লোম্যাটের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিলের (এসএসি) বিরুদ্ধে আরাকান সেনাবাহিনীর অভিযান রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের সূত্রপাত করেছে। গত এপ্রিলে মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের কাছে বুথিডাং শহরটি সেনাবাহিনীর কাছ থেকে দখলের জন্য আক্রমণ শুরু করে বিদ্রোহী আরাকান আর্মি। বুথিডাং থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মুসলমানদের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে, এসব ভিডিও ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর গণহত্যার স্মৃতিকেই মনে করিয়ে দিচ্ছে। ওই সময় সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। আরাকান আর্মি গত ১৭ মে বুথিডাং শহরে প্রবেশের পর সব রোহিঙ্গাকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়।
জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার অফিস (ওএইচসিএইচআর), মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে গত সেপ্টেম্বরের প্রতিবেদনে, বুথিডাং এবং এর আশপাশে বেসামরিক নাগরিকদের, বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের ওপর হামলার জন্য সামরিক এবং আরাকান সেনাবাহিনী উভয়কেই অভিযুক্ত করেছে। ওএইচসিএইচআর ইচ্ছাকৃতভাবে বাড়িঘর এবং সরকারি ভবন পুড়িয়ে ফেলা, বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গুলি চালানো, নির্যাতন এবং যৌন সহিংসতার কথা বলেছে প্রতিবেদনটিতে। তবে আরাকান আর্মি বুথিডাংয়ে অভিযান চলাকালে রোহিঙ্গাসহ বেসামরিক নাগরিকদের ওপর কোনো হামলার কথা স্পষ্টভাবে অস্বীকার করেছে। সামরিক বাহিনীর ভাষ্যও তাই। তবুও বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয় এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের অনুমান কয়েক ডজন বেসামরিক লোক নিহত হয়।
কী ঘটনা ঘটেছে সেখানে : বুথিডাং রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্তওয়ে থেকে ৯৬ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এবং এটি মংডু জেলার অংশ। শহরের জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ রোহিঙ্গা মুসলিম, আনুমানিক মোট ২০৬,০০০ এর মধ্যে ১৮০,০০০ জন। রাখাইন বৌদ্ধরা বুথিডাং-এর জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশ এবং বাকিরা খুমি, খামিন, মরা, চিন, দিয়ানেট এবং বাঙালি হিন্দু।
এই প্রতিবেদক গত ২০ থেকে ২৫ জুন ছয় দিন বুথিডাং-এ ছিলেন রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ঘটনার তদন্তের জন্য। ব্যক্তিগতভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার পাশাপাশি, তিনি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক, তিনটি অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি (আইডিপি) ক্যাম্পের বাসিন্দাদের, এসএসির বন্দী অফিসার, আরাকান আর্মি এবং এর রাজনৈতিক ফ্রন্টের কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার নেন।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কাছ থেকে বুথিডাং দখলের অভিযান শুরু করার আগে আরাকান আর্মি ইতোমধ্যেই দক্ষিণ চিন রাজ্য এবং রাখাইন রাজ্যের একটি বিস্তীর্ণ অংশে ৯টি শহর দখল করেছে। সামরিক বাহিনী জানত যে, অনেক প্রতিকূল অবস্থায় তারা বিদ্রোহী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জনপদকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে না। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর আটক মেজর হ্লাইং উইন টুন সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকের কাছে বলেন, জান্তা সেনারা সম্পদ হ্রাস, মনোবল এবং জনসমর্থনের অভাবে ভুগছে। তাই তারা আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) নামে রোহিঙ্গা যুবকদের একটি মিলিশিয়া তৈরি করে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়তে বাধ্য করছে। বুথিডাংয়ের সামরিক স্থাপনায় গত মার্চ ও এপ্রিলে ৭৫০ জন রোহিঙ্গা যুবককে কয়েক দিনের জন্য নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এছাড়া আরাকান আর্মিকে ঠেকাতে জান্তা সেনারা কালার পাঞ্জুরন চাউং (মায়ু নদীর একটি উপনদী) ওপর শহরে যাতায়াতের সেতুটি উড়িয়ে দেয়।
রোহিঙ্গাদের অনেকেই তাদের জোরপূর্বক নিয়োগের অভিযোগ করেছে। তাদের অনেকে সামরিক কেন্দ্র থেকে পালিয়ে এসে আরাকান আর্মির কাছে আত্মসমর্পণ করে যখন বুথিডাং শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় যুদ্ধ চলছিল। সাক্ষাৎকারে তারা তাদের অভিজ্ঞতা ও কিভাবে এআরএসএ এবং সামরিক বাহিনী যৌথভাবে তাদের জোরপূর্বক নিয়োগ দেয় সে সম্পর্কে কথা বলেছে। তাদেরই একজন পালিয়ে আসা হামিদুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের সামরিক ফাঁড়ি পাহারা দিতে, শহরে রাখাইন বৌদ্ধদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতে, পরিখা খনন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। আমাদের সাথে অপারেশনে এআরএসএ কর্মীরা ছিলেন এবং আমাদের পিছনে কয়েকজন সামরিক কর্মী ছিলেন যারা আমাদের কার্যকলাপের ওপর কঠোর নজরদারি রেখেছিলেন।’ হামিদুল্লাহ পালিয়ে এসে শহরের একটি থানায় আরাকান আর্মির কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
জান্তা সেনাবাহিনীর পরবর্তী পদক্ষেপটি ছিল বুথিডাং শহরে রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে জাতিগত বিরোধকে উসকে দেয়ার জন্য বিক্ষোভের আয়োজন করা। সামরিক বাহিনী অনুমান করেছিল যে বিক্ষোভের ফলে রোহিঙ্গা এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হবে এবং বুথিডাং শহরে আরাকান আর্মির প্রবেশ বন্ধ হবে। একই কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে রাখাইন রাজ্যের অন্যান্য জনপদেও। গত ২২ মার্চ হাজার হাজার বিক্ষোভকারী আরাকান আর্মিকে নিন্দা করে স্লোগান দিয়ে রাজ্যের রাজধানী সিত্তওয়েতে রাস্তায় নেমে আসে। রোহিঙ্গা কর্মী নে সান লুইন অভিযোগ করেন যে, সামরিক বাহিনী তার সম্প্রদায়ের সদস্যদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার এবং সিত্তওয়েতে বিক্ষোভে অংশ না নিলে ‘তাদের দেশ থেকে বহিষ্কার’ করার হুমকি দিয়েছে।
গত ২২শে জুন বুথিডাং-এ চার রোহিঙ্গা ধর্মগুরু এবং শিক্ষকদের একটি দল- মাওলানা আব্দুল গনি, মোহাম্মদ নূর, আবুল বাসের এবং আতাউল্লাহ- একসাথে সাক্ষাৎকারে ব্যাখ্যা করেছেন যে তাদের সম্প্রদায়ের সবাই শহরে প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নেয়নি। তারা বলেছে যে আশপাশের কিছু গ্রামের বাসিন্দারা এআরএসএ এবং সেনাবাহিনীর দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুবকদের একটি অংশের দ্বারা প্রোগ্রামে অংশ নিতে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। শহরের কাছাকাছি গ্রামের বাসিন্দারা সহিংসতায় জড়িত ছিল বলে নিশ্চিত করেছেন আটক পুলিশ প্রধান অং কিয়াও।
আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমানরা এভাবেই জান্তা সেনা কিংবা আরাকান আর্মির হাতে নৃশংস নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। গত মে মাসে কিছু মিডিয়া রিপোর্ট থেকে বুথিডাং টাউনশিপে ব্যাপক অগ্নিসংযোগের প্রমাণ মেলে। স্যাটেলাইট ইমেজ দেখায় বুথিডাং শহরের বড় অংশকে অগ্নিসংযোগের ঘটনা গ্রাস করেছিল। রোহিঙ্গা নাগরিক সমাজের কর্মী এবং মিয়ানমারের ছায়া জাতীয় ঐক্য সরকারের উপমন্ত্রী অং কিয়াও মো, মিডিয়াকে বলেছেন যে, রোহিঙ্গা বাসিন্দাদের আরাকান আর্মি শহর ছেড়ে চলে যেতে নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু তারা প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছিল যে, তাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই এবং তাই তারা আটকা পড়ে আছে। তারপর তাদের ওপর আরাকান আর্মির আক্রমণ শুরু হয়। ১৮ মে আরাকান আর্মি শহরটির অধিকাংশ এলাকা দখল করতে শুরু করে। এর আগে শহরে অগ্নিসংযোগ শুরু হয় এবং মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত তা বিরতিহীনভাবে চলতে থাকে। শহরের বেশির ভাগ ঘর পুড়ে গেছে। একটি চার্চ ও একটি মঠ পুড়িয়ে দেয়া হয়। দেদার লুটপাটও চলে। রেভারেন্ড থার ইয়ার অং, যিনি খামিন সম্প্রদায়ের অন্তর্গত, তিনি জানান, রোহিঙ্গা মুসলিম এবং রাখাইন বৌদ্ধসহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের সাথে আমরা থাকতাম। তারা শহরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিছু মুসলিম প্রতিবেশী (রোহিঙ্গা) আমাদেরকে কোথাও না যেতে বলেছিল এবং আমরা তাদের পরামর্শ মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের শেষ রক্ষা হয়নি। বাড়িঘর পুড়িয়ে ফেলার পাশাপাশি লুটপাট করা হয়।
বুথিডাংয়ে মোট কত ঘর পুড়ে গেছে সে সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন অনুমান রয়েছে। ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা থান উইন বলেন, শহরে মোট ৪,৫০০টির মধ্যে প্রায় ২,৯০০টি বাড়ি পুড়ে গেছে। শহরের একটি আইডিপি ক্যাম্পের দুই বয়স্ক বাসিন্দা এবং ইউনাইটেড লিগ অব আরাকানের একজন কর্মী পোড়া ঘরের পরিসংখ্যান ১,৫০০ থেকে ২,০০০ এর মধ্যে দিয়েছিলেন। এই অনুমান অনুসারে, শহরের প্রায় ৬০ শতাংশ ঘর পুড়ে গেছে।
এক রোহিঙ্গা নারী রোজিয়া বলেন, আমরা একটি পৃথক ঘরে ছিলাম বলে আমি আমার দুই সন্তান এবং স্বামীকে নিয়ে অল্পের জন্য পালিয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু বাকি চারজন (পরিবারের) সদস্য ঘটনাস্থলেই মারা যায়। বুথিডাং শহরের আইডিপি ক্যাম্পে বসবাসকারী মধ্যবয়সী রোহিঙ্গা ব্যক্তি আব্দুল লাফা দাবি করেছেন যে তাদের গ্রাম হপন নিও লেকে গোলাবর্ষণ ও বিমান হামলায় অন্তত ১০ জন নিহত হয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় ড্রোনের মাধ্যমে এসএসি বোমা এবং বিমানের বোমা দ্বারা ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। (সংক্ষেপিত)


আরো সংবাদ



premium cement