০৯ অক্টোবর ২০২৪, ২৪ আশ্বিন ১৪৩১, ৫ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

ইসরাইলে হামলার ছক প্রস্তুত ইরানের

-

- ইসরাইলের তৃতীয় বৃহত্তম শহর হাইফাতে রকেট হামলা হিজবুল্লাহর
- হিজবুল্লাহর সামরিক ক্ষমতা অক্ষত
- কুদস ফোর্সের সেই কমান্ডার ভালো আছেন

ইসরাইলে সম্ভাব্য হামলার জন্য ইতোমধ্যে অন্তত ১০টি পরিকল্পনা প্রস্তুত রেখেছে ইরান। দেশটির সেনাবাহিনীর এলিট শাখা ইসলামিক রেভ্যুলুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) বরাত দিয়ে গতকাল মঙ্গলবার এ তথ্য জানিয়েছে ইরানের বার্তা সংস্থা তাসনিম নিউজ এজেন্সি।
লেবাননে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযানের প্রতিবাদে গত ১ অক্টোবর ইসরাইলকে লক্ষ্য করে ১৮০টি ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরান। ব্যাপক এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর গত ৫ অক্টোবর জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী ইরানে হামলার ঘোষণা দেন। তবে কবে নাগাদ এই হামলা চালানো হতে পারে, সে সম্পর্কিত কোনো সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখ ঘোষণা করেননি তিনি।
নেতানিয়াহুর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় আইআরজিসির এক কর্মকর্তা তাসনিম নিউজকে বলেন, ‘তিনি এ কথা বলতেই পারেন; তবে যদি ইসরাইল ইরানের ভূখণ্ড ও সার্বভৌমত্বের ওপর হামলা করে, কিংবা ইরানের ‘রেড লাইন’ অতিক্রম করে, সে ক্ষেত্রে সেই হামলার কঠোর জবাব দেয়ার মতো সক্ষমতা আমাদের আছে। আর ইসরাইলে হামলা চালানো সংক্রান্ত অন্তত ১০ পরিকল্পনা আইআরজিসি হাতে রয়েছে। এই ১০টি পরিকল্পনার কয়েকটি যদি আইআরজিসি বাস্তবায়ন শুরু করে, তা হলে ইসরাইল অভূতপূর্ব সঙ্কটে পড়বে।’
ইরান ও ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যের দুই চিরবৈরী দেশ। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের সমর্থনপুষ্ট যেসব সংগঠন রয়েছে, সেগুলোর প্রত্যেকটির লক্ষ্য রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইলকে ধ্বংস করা। তবে দুই দেশের বৈরিতা আরো বৃদ্ধি পায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড গাজায় ইসরাইলের আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে, যা এখনো চলছে।

এদিকে গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর আগ্রাসন শুরুর পর থেকে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের প্রতি সংহতি জানিয়ে দক্ষিণ লেবানন থেকে ইসরাইলকে লক্ষ্য করে রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া শুরু করে ইরানের সমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক সংগঠন হিজবুল্লাহ। জবাব দিতে শুরু করে ইসরাইলও। উভয়পক্ষের হামলায় এ পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। নিহতদের অধিকাংশই লেবাননের নাগরিক। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে হামলার তীব্রতা বৃদ্ধি করে ইসরাইল। দেশটির বিমানবাহিনীর অভিযানে নিহত হয়েছেন হিজবুল্লাহর প্রধান নেতা হাসান নাসরুল্লাহসহ তাদের বেশ কয়েকজন শীর্ষ কমান্ডার। এক কথায়, গত দুই সপ্তাহে হিজবুল্লাহর চেইন অব কমান্ড ভেঙে দিয়েছে ইসরাইল।
প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে দক্ষিণ লেবাননে বিমান হামলা চালানোর পর ১ অক্টোবর ভোর থেকে সেখানে হামলা শুরু করে ইসরাইলের স্থলবাহিনী। ওই দিন রাতেই ইসরাইলকে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরান।

গত ৩ অক্টেবর কাতারের রাজধানী দোহায় এক ব্রিফিংয়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, তার দেশ ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধ চায় না। তবে ইসরাইল যদি ফিলিস্তিন এবং লেবাননে সামরিক অভিযান বন্ধ না করে, তা হলে ভবিষ্যতে ইরান আরো কঠোর প্রতিক্রিয়া জানাবে।
হিজবুল্লাহর সামরিক ক্ষমতা অক্ষত : এ দিকে লেবাননের শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন হিজবুল্লাহর উপপ্রধান নাঈম কাসেম জানিয়েছেন, তাদের সামরিক সক্ষমতা এখনো অক্ষত আছে। এ ছাড়া দখলদার ইসরাইল লেবাননে যে স্থল হামলা চালানোর চেষ্টা করেছে এটি ব্যর্থ হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
আলজাজিরাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে হিজবুল্লাহর এই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আমাদের সামরিক সক্ষমতা ঠিক আছে। আমাদের লড়াইয়ের সক্ষমতা নিয়ে শত্রুরা যা বলছে তা ভুল। তারা মিথ্যা বলছে। যুদ্ধের সম্মুখভাবে আমাদের যোদ্ধারা দৃঢ় আছে। গত ১০ দিনে যা হচ্ছে তা হলো ইসরাইলিদের কষ্ট বাড়ছে। আমরা তাদের বলছি, আরো ইসরাইলি তাদের বসতি থেকে বাস্তুচ্যুত হবে। ইসরাইলিদের পরিকল্পনা হলো লেবাননের বেসামরিকদের হত্যা করা এবং গ্রাম খালি করা যেন সবার মাঝে আতঙ্ক তৈরি হয়। আমি তাদের বলব, আপনাদের এই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।’ তিনি জানিয়েছেন, লেবাননে ইসরাইলি সেনাদের স্থল হামলা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।

গত সপ্তাহে লেবাননে সীমিত ও আঞ্চলিক স্থল হামলা শুরুর ঘোষণা দেয় দখলদার ইসরাইল। তারা লেবাননের বিভিন্ন গ্রাম দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করে। তবে ওই সময় হিজব্ল্লুাহর যোদ্ধাদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে ইসরাইলি বাহিনী। এতে স্থল হামলা শুরুর প্রথম দিনই অন্তত ৮ সেনা প্রাণ হারায়। দখলদার ইসরাইলি সেনারা প্রথমে লেবাননের পূর্ব দিক দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করে। ওই দিক দিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল দিয়ে ঢোকার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) আরবি মুখপাত্র গতকাল মঙ্গলবার এই তথ্য জানিয়েছেন।
হাইফাতে রকেট হামলা হিজবুল্লাহর : গাজা যুদ্ধের বর্ষপূর্তির দিন সোমবার ইসরাইলের তৃতীয় বৃহত্তম শহর হাইফায় রকেট হামলা চালিয়েছে লেবাননের হিজবুল্লাহ। হিজবুল্লাহ জানিয়েছে, তারা ইসরাইলি বন্দর শহর হাইফার একটি সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে ‘ফাদি ১’ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে এবং হাইফার ৬৫ কিলোমিটার পূর্বে টেবেরিয়াসেও হামলা চালিয়েছে। সশস্ত্র এই গোষ্ঠী পরে আরো জানায়, তারা হাইফার উত্তরে কয়েকটি এলাকা লক্ষ্য করেও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। ইসরাইল জানায়, হামাসের হামলার বর্ষপূর্তির দিনটিতে ভূখণ্ডে অন্তত ১৯০টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে আর এসব হামলায় অন্তত ১২ জন আহত হয়েছেন। ইসরাইলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তাদের বিমানবাহিনী দক্ষিণ লেবাননে হিজবুল্লাহর লক্ষ্যস্থলগুলোতে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করেছে আর হিজবুল্লাহর যোদ্ধাদের সঙ্গে লড়াইয়ে তাদের আরো দুই সেনা নিহত হয়েছে। এদের নিয়ে লেবাননের ভেতরে নিহত ইসরাইলি সেনার সংখ্যা ১১ জনে দাঁড়িয়েছে, জানিয়েছে রয়টার্স। ইসরাইলের বিমান হামলায় লেবাননে ১২ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। ক্রমেই আরো তীব্র হতে থাকা ইসরাইলি বোমা হামলায় বহু লেবাননি উদ্বিগ্নভাবে আশঙ্কা করছেন, হয়তো তাদের দেশও গাজার মতো ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হবে।

ইসরাইলি বাহিনী আরবিতে দেয়া এক বার্তায় সৈকতগামী ও নৌকা ব্যবহারকারীদের লেবাননের উপকূলের একটি অংশ এড়িয়ে যাওয়ার জন্য সতর্ক করে বলেছে, তারা শিগগিরই সাগর থেকে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করবে। লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সীমান্ত এলাকার একটি পৌর ভবনে ইসরাইলের বিমান হামলায় ১০ দমকল কর্মীসহ বহু মানুষ নিহত হয়েছেন। এক বছর আগে হামাসের প্রতি সংহতি জানিয়ে হিজবুল্লাহ ইসরাইলে রকেট ও ড্রোন হামলা শুরু করার পর থেকে ইসরাইলি হামলায় এ পর্যন্ত প্রায় ২০০০ লেবাননি নিহত হয়েছেন। এদের অধিকাংশেরই মৃত্যু হয়েছে গত কয়েক সপ্তাহে।
কুদস ফোর্সের সেই কমান্ডার ভালো আছেন : ইসরাইলি বিমান হামলায় গত মাসে নিহত হয়েছিলেন হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ। এর পর সেখানে গিয়েছিলেন ইরানের কুদস ফোর্সের প্রধান ইসমাইল কানি। গত কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছিল, কানির কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তবে সোমবার ইরানের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তিনি নিরাপদে আছেন, নিজের কাজ করে যাচ্ছেন।

রয়টার্স জানায়, ইরানের শহীদ বেহেশতি সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে ইসলামিক রেভ্যুলুশনারি গার্ডস কর্পস (আইআরজিসি) কুদস ফোর্স ফর কো-অর্ডিনেশন অ্যাফেয়ার্সের ডেপুটি কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইরাজ মাসজেদি এ কথা জানান। তিনি বলেন, আইআরজিসি কুদস ফোর্সের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইসমাইল কানি পুরোপুরি নিরাপদ আছেন। তিনি তার মিশন নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
পরে ইরাজ মাসজেদি রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমকে দেয়া আরেক সাক্ষাৎকারে বলেন, কানি তার স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাচ্ছেন। কেউ কেউ তার ব্যাপারে আমাদের একটি বিবৃতি জারি করতে বলেছেন। আমরা মনে করি এর কোনো প্রয়োজন নেই। ইসমাইল কানি গত সপ্তাহে বৈরুতের দক্ষিণ শহরতলিতে অবস্থানের সময় সেখানে প্রচণ্ড হামলা চালিয়েছিল ইসরাইল। এর পরপরই তার সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে ধারণা করা হয়েছিল, ইসরাইলি হামলায় তিনি নিহত হয়েছেন। ইরানের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। এ কারণে কানির নিহত হওয়ার ব্যাপারে গুঞ্জন বাড়ছিল।
উল্লেখ্য, কুদস বাহিনী ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলুশনারি গার্ডস কর্পসের (আইআরজিসি) একটি অংশ। অনেকে এটিকে আইআরজিসির বৈদেশিক সামরিক গোয়েন্দা শাখা হিসেবে গণ্য করে থাকেন। এটি ইরানের পক্ষ হয়ে হিজবুল্লাহসহ তেহরানপন্থী প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সঙ্গে সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করে থাকে। ২০২০ সালে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে মার্কিন ড্রোন হামলায় কুদস ফোর্সের প্রধান কাসেম সোলাইমানি নিহত হওয়ার পর ইসমাইল কানিকে কুদস ফোর্সের প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হয়।

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল