০৯ অক্টোবর ২০২৪, ২৪ আশ্বিন ১৪৩১, ৫ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

ময়মনসিংহে বন্যার আরো অবনতি তলিয়ে গেছে কুষ্টিয়া শহর

-


ময়মনসিংহে ভারী বৃষ্টিতে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ভোর ৫টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত ভারী বৃষ্টির কারণে কংস ও নেতাই নদীর পানি কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ায় পঞ্চম দিনে নতুন করে তিন উপজেলায় আরো ২৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। জেলায় পানিবন্দী হয়ে আছেন দুই লক্ষাধিক মানুষ। টানা পাঁচ দিনের পাহাড়ি ঢলে মানুষের ভোগান্তি আরো বেড়েছে। বাড়িঘরে পানি ওঠায় বন্ধ রয়েছে রান্নাবান্না। চরম সঙ্কট দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির।
শহরের অধিকাংশ এলাকার রাস্তা পানির নিচে থাকায় জনদুর্ভোগ চরমে উঠেছে। এদিকে কুষ্টিয়ায় আবারো ভারী বৃষ্টি হয়েছে। মাত্র এক ঘণ্টার সেই ভারী বৃষ্টিতে শহর এবং শহরতলির নিম্নাঞ্চল তলিয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। শহরের অধিকাংশ এলাকার রাস্তা পানির নিচে থাকায় জনদুর্ভোগ চরমে উঠেছে।
ময়মনসিংহ অফিস জানায়, কয়েক ঘণ্টার ভারী বৃষ্টিতে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া ও ফুলপুর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ভোর ৫টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত ভারী বৃষ্টির কারণে কংস ও নেতাই নদীর পানি কিছুটা বাড়ায় পঞ্চম দিনে নতুন করে তিন উপজেলায় আরো ২৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। জেলায় পানিবন্দী হয়ে আছেন দুই লক্ষাধিক মানুষ। টানা পাঁচ দিনের পাহাড়ি ঢলে মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। বাড়িঘরে পানি ওঠায় বন্ধ রয়েছে রান্নাবান্না। চরম সঙ্কট দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির। কংস নদীর তীরবর্তী আইলাতলী আশ্রয়ণ প্রকল্পে পানি ওঠায় দুর্ভোগ ঘরছাড়া হয়েছেন বাসিন্দারা। সহযোগিতা না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ বানভাসিরা। সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন সংগঠন বন্যার্তদের মাঝে শুকনো খাবার ও ত্রাণসমাগ্রী বিতরণ করছেন। এ পর্যন্ত তিন উপজেলায় নগদ সাত লাখ টাকা ও ৬৩ টন চাল বরাদ্দের কথা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসন।

জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ পুনর্বাসন কর্মকর্তা সানোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের জানান, মঙ্গলবার ভোর থেকে বৃষ্টি হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হয়েছে। কংস ও নেতাই নদীর পানি কিছুটা বেড়েছে। নতুন করে অন্তত ২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ পর্যন্ত তিন উপজেলায় নগদ সাত লাখ টাকা ও ৬৩ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ত্রাণসহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। আর বৃষ্টি না হলে পানি কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি আরো জানান, হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া ও ফুলপুর উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকার আশ্রয়কেন্দ্রে নারী-শিশুসহ কয়েক শত মানুষ ঠাঁই নিয়েছে। তাদের শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এদিকে কংস নদীর তীরবর্তী ধোবাউড়া উপজেলার আইলাতলী আশ্রয়ণ প্রকল্পের বেশ কয়েকটি ঘরে পানি ওঠায় দুর্ভোগ বেড়েছে বাসিন্দাদের। আমেনা বেগম নামে এক নারী জানান, কংস নদের পাড়ে তাদের আশ্রয়ণ প্রকল্প হওয়ায় এক সপ্তাহ ধরে ঘরের চারপাশ পানিতে ডুবে আছে। ছেলেমেয়ে নিয়ে খুব কষ্টে আছেন।

সাহাব উদ্দিন বলেন, সব সময় আতঙ্কের মধ্যে সময় কাটছে। কখন জানি পানি বেড়ে ঘর ডুবে যায়। মিনতি রানী পাল বলেন, ‘বন্যায় পূজার আনন্দ ¤œান হয়ে গেছে। দুইবেলা খাবারই কপালে জুটছে না, পূজা কিভাবে করব? সরকার সহযোগিতা করলে অন্তত সন্তানদের নিয়ে চলতে পারতাম।’
ধোবাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিশাত শারমিন জানান, সকালের দিকে বৃষ্টি হওয়ায় পানি কিছুটা বেড়েছে, সেই সাথে নতুন করে ২৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বানভাসিদের শুকনো খাবারের পাশাপাশি ওষুধ সরবরাহ করছি। আর যদি বৃষ্টি না হয় তাহলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।
ফুলপুরের ইউএনও এ বি এম আরিফুল ইসলাম জানান, মঙ্গলবার সকালের কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে নতুন করে উপজেলার বালিয়া ইউনিয়নসহ চারটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এতে নতুন করে ১৬টি গ্রাম বন্যাকবলিত হয়েছে। বন্যার্তদের সহযোগিতার জন্য বেশ কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। দিনের অবস্থা ভালো থাকলে দুয়েক দিনের মধ্যেই পানি নেমে যেতে পারে।
হালুয়াঘাট (ময়মনসিংহ) সংবাদদাতা জানান, হালুয়াঘাটে এত পানি জীবনেও দেখেননি বলে মন্তব্য করেছেন কৈচাপুর ইউনিয়নের গাঙ্গিনারপাড় গ্রামের মইজ উদ্দিন (৭৭)। তিনি বলেন, ১৯৮৩, ’৮৮, ’৯৮ সালেও পাহাড়ি ঢলে বন্যা হয়েছে; তবে এবারের বন্যা সবচেয়ে ভয়াবহ। শতকরা নব্বই ভাগ বাড়িঘরে বন্যার পানি উঠেছে।

দর্শারপাড় গ্রামের সাইমা সুলতানা শাবনুর জানান, বড় হওয়ার পর এই প্রথম এত বড় বন্যা আমাদের হালুয়াঘাটে দেখলাম। এই বন্যায় আমাদের উঠান, রান্নাঘর, বাড়ির পিছন, পুকুর সব তলিয়ে গেছে। বড় ঘরের সিঁড়ির কানায় কানায় পানি। সাবমার্সিবল মর্টারের স্লাবের ওপরে আব্বা মাটির চুলা বসিয়েছেন। আজ (মঙ্গলবার) সকালে ঘর থেকে বিষাক্ত সাপ বের করে পানিতে ছেড়ে দিয়েছেন। তাই সাপের ভয়ে কাপড় দিয়ে বেড়া দিলাম, যেন বিষাক্ত কোনো কিছু বারান্দা দিয়ে না ঢুকে।
পাগলপাড়া গ্রামের আলহাজ মোখলেছুর রহমান মাস্টার জানান, হঠাৎ পানি এসে ঘরের ভিতর কোমর পর্যন্ত ডুবে গেছে। আলমিরাতে থাকা গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ভিজে গেছে। ঘরে থাকা ধান-চাল নষ্ট হয়ে গেছে।
আচকিপাড়া গ্রামের লিবিংস্টোন জানায়, ভুবনকুড়া গ্রামে প্রায় ২০-২৫টি বাড়ি বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। ধানগাছের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গবাদি পশু, হাঁস, মুরগিসহ পশুপাখির মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। অগণিত ফিশারির মাছ ভেসে গেছে। ধুপাজুড়িসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের রাস্তা ভেঙে যাতায়াতের দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়েছে।

আইলাতলী গ্রামের দ্বীন ইসলাম জানান, বোরাঘাট নদীর পানি উপচে বাড়ি ঘরে উঠে গেছে। নদীর পাড়ের অনেক বাড়িঘর ভেঙে গেছে। একজনের পাঁচটি ফিশারি ডুবে ৮-১০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও গ্রামের প্রায় সব পুকুর তলিয়ে যাওয়ায় মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
মনিকুড়া গ্রামের বাঘাইতলা রোডে গিয়ে দেখা গেছে অনেক পরিবার রাস্তার পাশে দোকানে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ কেউ প্রতিবেশীর বাড়িতে উঠেছেন। স্কুল-কলেজগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে হাজারো মানুষ।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এরশাদুল আহমেদ জানান, ১২টি ইউনিয়নে ১৮ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। ৭৫ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ২৫ হাজার মেট্রিক টন চাল, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ১২০০ প্যাকেট শুকনো খাবার, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের ত্রাণ শাখা থেকে ৭০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলার দুর্গম এলাকার পানিবন্দী পরিবারগুলোর মধ্যে শুকনো খাবার ও ত্রাণ বিতরণ করেছে সেনাবাহিনী। গতকাল সেনাবাহিনীর সদর দফতর আর্মি ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ডের তত্ত্বাবধানে কমান্ডার ৪০৩ ব্যাটেল গ্রুপের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি দল ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন শেষে ত্রাণ বিতরণ করে। গত দুই দিনে ২১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরা অসংখ্য পানিবন্দী মানুষকে উদ্ধার করেছে। এসময় কর্নেল স্টাফ ও সদর দফতর আর্মি ট্রেনিং অ্যান্ড ডক্টট্রিন কমান্ড সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। গতকালও পাঁচ শতাধিক পরিবারের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হয়।
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, একদিনের বিরতি দিয়ে কুষ্টিয়ায় আবারো ভারী বৃষ্টি হয়েছে। মাত্র এক ঘণ্টার সেই ভারী বৃষ্টিতে শহর এবং শহরতলির নি¤œাঞ্চল তলিয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। শহরের অধিকাংশ এলাকার রাস্তা পানির নিচে থাকায় জনদুর্ভোগ চরমে উঠেছে। সোমবার সারা দিন ঝলমলে রোদে জনগণের চলাচল ছিল স্বাভাবিক। বিকেল সাড়ে ৩টার পর আকস্মিক কালো মেঘে পুরো আকাশ ঢেকে যায়। পৌনে ৪টার দিকে শুরু হয় ভারী বৃষ্টি। এক নাগাড়ে চলে এক ঘণ্টা। সেই ভারী বৃষ্টিতে জনজীবন থমকে যায়। বৃষ্টির সাথে বিদ্যুৎ চমকানোতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন তারা। এক ঘণ্টার বৃষ্টিতে শহরের এন এস রোড এবং মহাসড়ক ছাড়া অধিকাংশ সড়ক হাঁটু পানিতে তলিয়ে যায়। শহরের কোর্টপাড়া, থানাপাড়া, আড়––য়াপাড়া, হাউজিং, কালিশংকপুর, হরিশংকপুর মিলপাড়া, কুঠিপাড়া, আমলাপাড়া বড় বাজারের সর্বত্র পানিতে তলিয়ে যায়। বাইরে বের হওয়া লোকজনকে বাড়ি ফিরতে বেগ পেতে হয়। সড়কে রিকশা, অটো চলাচল ছিল একেবারেই কম। এতে ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তি আরো বেড়ে যায়। শহরের অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থায় একটু বৃষ্টিতেই রাস্তাঘাট ডুবে যায়। সেখানে ঘন ঘন ভারী বৃষ্টিতে পুরো শহর জুড়েই সড়কে পানি নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল