০৭ অক্টোবর ২০২৪, ২২ আশ্বিন ১৪৩১, ৩ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

অতি বৃষ্টি ও ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে ৩ জেলা প্লাবিত

-


গত কয়েক দিনের টানা ভারী বৃষ্টি ও সীমান্তের ওপারে ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও গাইবান্ধা জেলার বিভিন্ন অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন এসব এলাকার বাসিন্দারা। এ ছাড়া সড়ক ও রেলপথ ডুবে যাওয়ায় চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। সেই সাথে দেখা দিয়েছে তীব্র নদী ভাঙন।

তাহিরপুরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত
তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে ফসলি জমি, বসতবাড়ি ও সড়ক পানিতে ডুবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রোববার (৬ অক্টোবর) সকাল থেকে জাদুকাটা, রক্তি,পাটলাই নদী দিয়ে ভারতের পানি প্রবল বেগে ভাটির দিকে নামছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলায় সীমান্তের বিভিন্ন নদী ও ছড়া দিয়ে ভারত থেকে নেমে আসা পানি প্রবল বেগে নিম্নাঞ্চলের দিকে ঢুকছে। এতে সুনামগঞ্জ-বিশ্বম্ভরপুর-তাহিরপুর সড়কের কৈয়ারকান্দা ১০০ মিটার সড়ক ও আনোয়ারপুর বাজারের সামনের সড়ক দিয়ে পানি হাওরে ঢুকছে। নদীর তীরবর্তী বসতবাড়ি, সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এ ছাড়াও রোপা আমনের জমি পানিতে তলিয়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাহিরপুরে আসতে গিয়ে পর্যটকগণ চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে।
সুনামগঞ্জ-বিশ্বম্ভরপুর-তাহিরপুর সড়কের সিএনজি অটোরিকশাচালক মাসুক মিয়া জানান,পাহাড়ি ঢলের ১০০ মিটার সড়ক উপচে পানি হাওরে প্রবেশ করেছে। এতে করে যাত্রী নিয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছি।
বালিজুরী ইউনিয়নের দক্ষিণকুল গ্রামের কৃষক রফিক মিয়া জানান, ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে আমনের জমি তলিয়ে গেছে। বালিজুড়ী ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান বাবুল মিয়া জানান,পাহাড়ি ঢলের পানিতে তাহিরপুর সুনামগঞ্জ সড়কের কয়েকটি স্থানে ডুবে গেছে। তবে যানবাহন চলাচল এখনো বন্ধ হয়নি। পানি আরো বাড়লে দুর্ভোগ বেড়ে যাবে। পানিতে আমনের জমি তলিয়ে গেছে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার জানিয়েছেন, সুনামগঞ্জের সুরমা নদীর পানি বিপদ সীমার ২ সেন্টিমিটারের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, তবে বন্যার আশঙ্কা নেই।

নেত্রকোনায় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড
নেত্রকোনা প্রতিনিধি জানান, গত কয়েক দিনের প্রবল বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সীমান্তবর্তী দুই উপজেলার শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়ে কয়েক শ’ নারী-পুরুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। প্রায় ৫’ হেক্টর জমির আমন ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। ঢলের পানির নিচে রেলপথ ডুবে গিয়ে ট্রেন চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। নেত্রকোনায় ৬৫০ মিলিমিটার সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। পাহাড়ি ঢলের পানি বাঁধের উপর দিয়ে প্রবল গতিতে প্রবাহিত হওয়ায় যে কোনো সময় বাঁধ ধসে পড়ায় আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, টানা প্রবল বর্ষণ ও ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সীমান্তের সুসং দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ফলে সেখানকার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। জারিয়া, ঝাঞ্জাইল-ময়মনসিংহ রেলপথ তলিয়ে যাওয়ায় ধীরগতিতে ঝুঁকি নিয়ে কোনো রকমে ট্রেন চলাচল করছে। সুসং দুর্গাপুর সীমান্তের পাহাড়ি নদী সোমেশ^রী, কংশ, গণেশ^রী, ধনু নদ, উব্দাখালী ও সদরের মগড়া নদীর পানি বিপদ সীমা ছুঁই ছুঁই আবার কোনো কোনো স্থানে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল রোববার নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। নবাগত জেলাা প্রশাসক বনানী বিশ^াস দুর্গাপুরের বন্যাকবলিত বিভিন্ন অঞ্চল পরিদর্শন করে দুর্গতদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন।
নেত্রকোনা জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী সারওয়ার জাহান বলেন, ঢলের বেগ এত বেশি যে বাঁধের উপর দিয়ে তীব্র গতিতে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল পর্যন্ত পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নদ-নদীর পানি বিপদসীমার কাছাকাছি চলে এসেছে। বৃহস্পতিবার ভোর থেকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে ৭২ ঘণ্টায় .৩৪১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। একই সময় নেত্রকোনার সীমান্ত এলাকা দুর্গাপুর ও জারিয়া, ঝাঞ্জাইল স্টেশনে ৬৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক বনানী বিশ^াস রোববার বিকেলে নয়া দিগন্তকে বলেন, সীমান্ত দিয়ে ঢলের পানি অব্যাহতভাবে প্রবেশ করায় আমাদের সীমান্ত এলাকার নিমাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে বন্যার্তদের জন্য নগদ ৩ লাখ টাকা ও ৬০ মেট্রিক টন চাল বিতরণ চলছে। সেখানে বন্যার্তদের সহায়তার জন্য একাধিক টিম কাজ করছে। বন্যাকবলিত এলাকার সার্বিক পরিস্থিতি মনিটরিং করা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় যা ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন সেজন্য আমরা সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি।

তিস্তার নিচু এলাকা প্লাবিত
সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) সংবাদদাতা জানান, টানা ভারী বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বাড়ছে তিস্তার পানি ডুবছে নিচু এলাকা। পাশাপাশি ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে বিভিন্ন চরে। পৌর সভার রামডাকুয়া এলাকা অবস্থিত কেন্দ্রীয় শ্মশানঘাটে পানি উঠেছে। ঠেকানো যাচ্ছে না অব্যাহত ভাঙন। নিচু এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ছে। পানি বাড়ায় চরের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নৌকা ছাড়া এক চর হতে অন্য চরে চলাচল সম্ভব হচ্ছে না।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তারাপুর, বেলকা, হরিপুর, চন্ডিপুর, শ্রীপুর ও কাপাসিয়া ইউনিয়নের উপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদী। ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢলে তিস্তার শাখা নদীর আশপাশ ডুবে যায় পানিতে। সেই সাথে শুরু হয় নদীভাঙন। চলতে থাকে বছরব্যাপী। নদী পাড়ের মানুষের দাবি, স্বাধীনতাপরবর্তী দীর্ঘদিনেও স্থায়ীভাবে নদী ভাঙন রোধ, ড্রেজিং, নদী খনন ও সংস্কারের উদ্যোগ নেয় সরকার। যার কারণে প্রতি বছর পাঁচ শতাধিক বসতবাড়ি, হাজারো একর ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে।
লালচামার গ্রামের জাহিদুল ইসলাম, আব্দুল হামিদসহ অনেকে জানান, ভারী বর্ষণে হঠাৎ করে তিস্তার পানি বাড়তে শুরু করায় নিচু এলাকা ডুবে গেছে। নদীতে পানি বাড়লে এবং বন্যা এলে তিস্তার চরাঞ্চলের মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না।
হরিপুর ইউনিয়নের ডাঙ্গার চর গ্রামের সাঞ্জু মিয়া বলেন পানি বাড়লে চরের মানুষের দুঃখও বাড়ে। প্রতি বছর নদীর ভাঙনে বসতবাড়ি, আবাদি জমি বিলীন হচ্ছে নদীগর্ভে। একজন চরবাসীকে মৌসুমে কমপক্ষে চারবার ঘরবাড়ি সরাতে হচ্ছে। কিন্তু আজও স্থায়ীভাবে নদীভাঙন রোধের কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে না।
হরিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো: মোজাহারুল ইসলাম জানান, পানি বাড়ায় তার গোটা ইউনিয়নের নিচু এলাকা ডুবে গেছে। তবে এখন পর্যন্ত আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। পাশাপাশি ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। ভাঙন রোধে প্রাথমিকভাবে জিও ব্যাগ ও জিও টিউব ফেলা হচ্ছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো: ওয়ালিফ মণ্ডল জানান, হঠাৎ ভারী বর্ষণের ফলে তিস্তার নিচু এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। কিছু কিছু চরে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের খোঁজখবর রাখতে বলা হয়েছে। প্রয়োজনে ত্রাণ সরবরাহ করা হবে।
গাইবান্ধা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী হাফিজুল হক জানান, ভাঙন রোধে জিও ব্যাগ ও জিও টিউব ফেলা হচ্ছে। তবে স্থায়ীভাবে ভাঙন রোধ সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের সিদ্ধান্তের ব্যাপার।

শেরপুরে ২৪২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ
শেরপুর প্রতিনিধি জানান, গত কয়েকদিনের বর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে সৃষ্ট শেরপুর জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উজানে কিছুটা উন্নতি হলেও নিম্নাঞ্চলে অবনতি হয়েছে। নতুন করে শেরপুর সদর উপজেলার বাজিতখিলা, ধলা ও গাজীরখামার ইউনিয়ন এবং নকলা উপজেলার নকলা সদর, পৌরসভা (আংশিক), গনপদ্দী ও উরফা ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ।
গত শুক্রবার আকস্মিক পাহাড়ি ঢলে পানি বৃদ্ধির পর থেকে শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতি ও নালিতাবাড়ী উপজেলার উঁচু জায়গায় অবস্থিত ৫৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করে স্থানীয় প্রশাসন। জেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৭৪১টি। এর মধ্যে বন্যাকবলিত হয়েছে ৩০১টি বিদ্যালয়। বেশি পানিতে নিমজ্জিত থাকার কারণে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ২৪২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। আর আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে ৫৯টি। বেশি বন্যাকবলিত হয়েছে নালিতাবাড়ী উপজেলা। উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। উপজেলার ১২১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ১১৯টি বন্ধ রয়েছে।
শেরপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো: ওবায়দুল্লাহ জানান, বন্যা পরিস্থিতি একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই। যেসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি উঠেছে সেগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। স্কুলের ভেতর থেকে পানি নেমে গেলে শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চালু করা হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement