০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ২ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

আলোচনায় নির্বাচন ও সংস্কার

রাজনৈতিক দলের সাথে অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিতীয় দফার সংলাপ
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের (বাঁয়ে) সাথে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের ব্রিফ করছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর (মাঝে) এবং ডা: শফিকুর রহমান : নয়া দিগন্ত -


রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আবারো সংলাপ শুরু করেছে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। গতকাল দ্বিতীয় দফার এই সংলাপেও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগসহ তাদের অপকর্মের দোসর হিসেবে চিহ্নিত দলগুলোকে ডাকা হয়নি। দেশ পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি খাত নিয়ে বহুল আলোচিত সংস্কার কমিশনগুলোর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরুর আগে এই সংলাপের আয়োজন তাৎপর্যপূর্ণ। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দলের নেতারা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে বৈঠকে বসে তাদের দাবি ও পরামর্শগুলো জানিয়েছেন। সংলাপে বিএনপির পক্ষে প্রধান আলোচ্য ছিল নির্বাচন সংক্রান্ত এবং নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার ও কমিশন নিয়ে। আর জামায়াত সরকারের কাছে রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ চেয়েছে। প্রধান এই দু’টি দল ছাড়াও গতকাল ড. ইউনূসের সাথে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, গণতন্ত্র মঞ্চ, গণতান্ত্রিক বাম জোট, হেফাজতে ইসলাম, এবি পার্টির নেতারা আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।
সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতিও এগিয়ে নেবে সরকার : সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতিও এগিয়ে নিয়ে যাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ছয়টি কমিশনের পাশাপাশি আরো অনেক কমিশন হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম। গত রাতে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা জানান। এ দিন বেলা আড়াইটা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপ করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সংলাপের সার্বিক বিষয় তুলে ধরতেই এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে এ ধরনের সংলাপ বা কথাবার্তা থাকবে।

সংলাপে সব রাজনৈতিক দল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সমর্থন জানিয়েছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম বলেন, প্রশাসনে ফ্যাসিবাদের দোসরদের কিভাবে শাস্তির আওতায় আনা যায় এ ব্যাপারে সরকার শক্ত অবস্থানে রয়েছে। এরইমধ্যে দোসরদের অনেকে গ্রেফতার হয়েছে, অনেকের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। গণহত্যায় আমাদের কষ্ট অবস্থান ছিল যেভাবে গণহত্যার সাথে জড়িত ছিল শাস্তির আওতায় আনা হবে বলেও জানান মাহফুজ আলম। তিনি বলেন, গণহত্যার মূল ক্রীড়নক হচ্ছেন শেখ হাসিনা। তিনিসহ যারাই জড়িত তাদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে দলগুলো।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সরকারি মাহফুজ আলম বলেন, প্রথম পর্বের আলোচনা হয়েছে। ছয়টি সংস্কার কমিশন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অভিমত জানতে চাওয়া হয়েছে। সবাই সরকারের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন, সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিতে দৃঢ় মত পোষণ করেছেন। তারেক রহমানকে দেশে ফেরানো নিয়ে বিএনপির সাথে সংলাপে কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানান মাহফুজ আলম। নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে কথা হয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, পাঁচটি সংস্কার কমিশন ঘোষণা হয়েছে, আরেকটি এক দুই দিনের মধ্যে ঘোষণা হবে। প্রধান উপদেষ্টা তার বিশেষ সরকারি এবং অন্য দুইজন উপদেষ্টা সংলাপে ছিলেন। তারা অবহিত করেছেন যে, কমিশনগুলো তিন মাসের মধ্যে পলিটিক্যাল পার্টি, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সাথে কথা বলবে। তিন মাসের মধ্যে কমিশন কোন রিপোর্ট দেবে। ওই রিপোর্টগুলো পাওয়ার পর সরকার পলিটিক্যাল পার্টি এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোকজনের সাথে আবার কথা বলবে। পলিটিক্যাল পার্টির সাথে একটি কনসেন্সসাসে আসবে, মিনিমাম কনসেন্সসাস কতটুকু। রিফর্মের ব্যাপারে একটি কনসেন্সসাসে আসবে। এর উপর নির্ভর করবে টাইমলাইনটা। কারণ আপনি যতটুকু রিফর্ম করবেন, ততটুকু করতে কত সময় লাগছে সেটি দেখার বিষয়। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, এর মধ্যেই ইলেকশনের কাজগুলো এগিয়ে যাবে। ইলেকশনের যে প্রস্তুতি, ইলেকশন কমিশন ফর্মেশন এসব কাজ এগিয়ে যাবে- তাই এখনই আমরা টাইমটা বলতে পারছি না।

সরকার বলেছে নির্বাচন এক নম্বর অগ্রাধিকার : ফখরুল
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে সংলাপে আবার নির্বাচনের রোডম্যাপ চেয়েছে বিএনপি। এক ঘণ্টার সংলাপ শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছেন, নির্বাচন করা অন্তর্বর্তী সরকারের এক নম্বর অগ্রাধিকার, এটি প্রধান উপদেষ্টা তাদের জানিয়েছেন।
সংলাপের পর গতকাল বিকেল ৪টার দিকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন বিএনপি মহাসচিব। এর আগে বেলা আড়াইটার দিকে ওই সংলাপে অংশ নিতে যমুনায় যায় বিএনপির ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদল। সাংবাদিকদের মির্জা ফখরুল বলেন, তারা প্রধান উপদেষ্টার সাথে এক ঘণ্টা সময় ধরে আলোচনা করেন। প্রধান আলোচনা ছিল নির্বাচন সংক্রান্ত এবং নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার ও কমিশন নিয়ে।
সংলাপে আবারো নির্বাচনের রোডম্যাপের দাবি তুলে ধরার কথা উল্লেখ করেন বিএনপি মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘আমরা একটা রোডম্যাপ দিতে বলেছি। কবে নির্বাচন হবে, সে বিষয়ে একটা রোডম্যাপ দিতে বলেছি।’
জাতীয় পরিচয়পত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে দেয়ার যে আইন করা হয়েছে বিগত সরকারের সময়ে, সেটিও বাতিল চেয়েছে বিএনপি। মির্জা ফখরুল বলেন, বিতর্কিত কোনো ব্যক্তি যাতে নির্বাচন সংস্কার কমিটিতে না থাকে, সেটিও তারা চেয়েছেন। ফ্যাসিবাদের সময় গঠিত সব ইউনিয়ন পরিষদ বাতিলের দাবিও জানিয়েছেন তারা।

বিএনপি মহাসচিব জানান, ২০১৪ সাল থেকে পরপর তিনটি বিতর্কিত ও ভুয়া নির্বাচন করেছে যেসব নির্বাচন কমিশন, সেই কমিশনগুলোর প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যদের আইনের আওতায় আনার কথা বলেছেন তারা।
সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হককেও আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে বিএনপি। মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা মনে করি, বিচারপতি খায়রুল হক নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করার মূল হোতা। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায় দিয়ে এই বিচারপতি নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংসের মূল ভূমিকা পালন করেন। তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছি রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে অনেকে দোসর হয়ে কাজ করেছে এবং লুটপাট ও মানুষের ওপর নির্যাতনে সহায়তা করেছে। এ ছাড়া গুম-খুন ও গণহত্যায় সহায়তাকারীদের অনেকেই এখনো নিজ নিজ জায়গায় বহাল আছে, অবিলম্বে তাদের সরিয়ে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সেসব পদে নিয়োগ করার দাবিও তারা জানিয়েছেন।

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘জেলা প্রশাসকদের নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তাদের নিয়োগ বাতিল করতে বলেছি। চুক্তিভিত্তিক কিছু নিয়োগ বাতিলের প্রস্তাব দিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যেও দুই-একজন আছেন যারা এই গণ-অভ্যুত্থানের বিপ্লবের যে স্পিরিট, সেটাকে ব্যাহত করছেন, তাদের সরানোর কথা বলেছি।’
বিচার বিভাগের প্রসঙ্গে ফখরুল বলেন, বিচার বিভাগের হাইকোর্ট বিভাগে এখনো পরিবর্তন হয়নি, বেশির ভাগ নিয়োগ ছিল দলীয় ভিত্তিতে। এদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নিতে বলেছি। অতি দ্রুত পিপি ও জিপি নতুন নিয়োগের কথা বলেছি। তিনি বলেন, ‘যাদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেফতার করা হচ্ছে তাদের জামিন দেয়া হচ্ছে। এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বিষয়টি আমরা দেখার জন্য বলেছি। ২০০৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের আমলে দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা গায়েবি, ভুয়া সাজানো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মামলা প্রত্যাহারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছি।’
কিছু আমলা কিছু পুলিশ কর্মকর্তা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্যক্তি ও মন্ত্রীরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। কার সহযোগিতায় পালাচ্ছে সেই বিষয় সরকারকে দেখার কথাও উল্লেখ করেছেন বলে জানান মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘আরেকটা বিষয় জোর দিয়ে বলেছি, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ভারতে আছেন। ভারতে থেকে তার মাধ্যমে যে সমস্ত প্রচারণা চলছে, এই বিষয়টিতে ভারতের সরকারের সাথে আলোচনা করার জন্য; অন্তর্বর্তী সরকার ভারত সরকারের সাথে কথা বলবে।’
এ ছাড়া গুম-খুনের সাথে যারা জড়িত তারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে, জাতিসঙ্ঘের একটি দল এসেছে, তাদের সেভাবে সহযোগিতা করছে না, দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে কিছু মানুষ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে উসকানি দিচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে- সব প্রসঙ্গ সংলাপে তুলে ধরেছেন বলে জানান বিএনপির মহাসচিব।

বিচার বিভাগের বিষয়ে সুপারিশের বিষয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘হাইকোর্ট বিভাগে এখন পর্যন্ত কোনো পরিবর্তন হয়নি। অথচ হাইকোর্ট বিভাগের বেশির ভাগ নিয়োগই ছিল দলীয় ভিত্তিতে। সেখানে প্রায় ৩০ জন বিচারক বহাল তবিয়তে কাজ করছেন। তাদের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেয়ার কথা আমরা বলেছি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা লক্ষ করছি, যাদের দুর্নীতি-হত্যার মতো সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রেফতার করা হচ্ছে, তাদের জামিন দেয়া হচ্ছে। এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এটা আমরা দেখার জন্য বলেছি।’
সংলাপে অংশ নেয়া বিএনপির অন্য নেতাদের মধ্যে ছিলেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, আব্দুল মঈন খান ও সালাহ উদ্দিন আহমেদ। এতে সরকারের দিক থেকে প্রধান উপদেষ্টার সাথে ছিলেন উপদেষ্টা হাসান আরিফ, আদিলুর রহমান খান, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম।

রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচনী রোডম্যাপ চেয়েছি : ডা: শফিকুর রহমান
আগামী ৯ অক্টোবর রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচনী রোডম্যাপসহ সার্বিক বিষয় জাতির সামনে তুলে ধরবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটির আমির ডা: শফিকুর রহমান এ তথ্য জানিয়ে বলেছেন, আপনাদের (মিডিয়া) মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রস্তাবনাগুলো উন্মুক্ত করবো ইনশা আল্লাহ। দিনক্ষণ ঠিক থাকলে ওই দিন আমরা আমাদের চিন্তাভাবনা জাতির সামনে তুলে ধরব যে এই মুহূর্তে কী কী সংস্কার প্রয়োজন, কোন কোন প্রতিষ্ঠানের কিভাবে সংস্কার প্রয়োজন। সরকারের কাছে সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ চেয়েছেন বলেও জানান তিনি।
গতকাল বিকেলে যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে বৈঠক শেষে জামায়াত আমির এসব কথা বলেন। এ সময় তার সাথে ছিলেন দলটির নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, ডা: সৈয়দ আবদুল্লাহ মো: তাহের, আ ন ম শামসুল ইসলাম ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, মাওলানা আবদুল হালিম, প্রচার ও মিডিয়া বিষয়ক সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ, নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন, নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল, উত্তরের আমির সেলিম উদ্দিন নির্বাহী পরিষদ সদস্য মোবারক হোসাইন।
জামায়াত আমির বলেন, সাংবাদিকরা জাতির বিবেক। কিন্তু গত সাড়ে ১৫ বছর আপনারা বিবেক অনুযায়ী কাজ করতে পারেননি। বাধ্য করা হয়েছে সমাজকে বিভ্রান্ত করার জন্য, সরকারকে অবৈধ সুবিধা দেয়ার জন্য মিথ্যা বানোয়াট বিভিন্ন সংবাদ পরিবেশনে বাধ্য করা হয়েছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জামায়াতে ইসলামী। কিন্তু আমরা অতীত নিয়ে ঘাটতে চাই না। আমরা দেশবাসীকে সাথে নিয়ে সবার সহযোগিতায় দেশটি সামনের দিকে আগাক, সেই জায়গাটায় আমরা অবদান রাখতে চাচ্ছি। এ জন্য অতীতে যা হয়েছে আমরা তা পেছনে ফেলে দিলাম। তবে যারা সুনির্দিষ্ট অভিযোগে অভিযুক্ত, যারা মানুষ খুন করেছে, গুম করেছে, লুটপাট করেছে, দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করেছে, আয়নাঘর তৈরি করেছে, ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে- তাদের বিচার দাবি করছি। তবে আমাদের ওপর যে জুলুম করা হয়েছে, তাদের ওপর সেই জুলুম করা হোক চাই না। আমরা চাই ন্যায়বিচারের মাধ্যমে সবাই যেন তাদের অপরাধের পাওনাটা বুঝে পায়।
শফিকুর রহমান বলেন, আমরা আজকে এসেছিলাম দেশ ও জাতির প্রয়োজনে। এই সরকার একটি নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তারা দেশ শাসনের জন্য আসেননি। দেশ শাসনের সুষ্ঠু পথ বিনির্মানের জন্য এসেছে। গত পরপর তিনটি নির্বাচনে জাতি যেভাবে বঞ্চিত ছিল, জাতির সামনে একটি গ্রহণযোগ্য, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেয়া। এ জন্য তাদের কিছু মৌলিক বিষয়ে সংস্কার করতেই হবে। কী কী মৌলিক বিষয়ে তারা সংস্কার করবেন, সেই ব্যাপারে আমরা কথা বলেছি।

প্রধান উপদেষ্টার সাথে বৈঠকে দেশের চলমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে জনগণ ও বর্তমান সরকার পারস্পরিক সম্পর্কের আলোকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরো উন্নত হতে পারে এবং সব ধরনের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জাতিকে আরো ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে- সেসব বিষয় নিয়ে এখানে কথাবার্তা হয়েছে। আমরা আশা করছি, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোনো ধরনের পক্ষ বিপক্ষের মানসিকতা না নিয়ে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে তারা দেশকে একটা ভালো জায়গায় নিয়ে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে সক্ষম হবেন। এ ক্ষেত্রে আমরা আশা করছি যে, এ সময়টা না দীর্ঘ হবে। শুরু থেকেই আমরা বলে আসছিলাম, সংস্কারের জন্য সরকারকে আমরা যৌক্তিক সময় দিতে চাই। সেই যৌক্তিক সময়টা কী হবে- এ নিয়ে অচিরেই আমরা কাজ করব এবং সেটিও আপনাদের সামনে চলে আসবে। আশা করছি খুব দেরি হবে না। জামায়াত আমির বলেন, আগামী দিনে বৈষম্যহীন ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় আমরা কাজ করছি। যেখানে কোনো দল বা ধর্মের কারণে কেউ জুলুমের শিকার হবে না। ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনে আপনারা আমাদের সহযোগিতা করবেন।
আসন্ন দুর্গাপূজায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে করণীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা বলেছি, সরকারের সাথে জনগণের পার্টনারশিপ লাগবে, তাদের সাথে জনগণের সম্পৃক্ততার প্রয়োজন হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জনগণ যদি একসাথে কাজ করে তাহলে আশা করছি হিন্দু ভাইবোনেরা সুন্দরভাবে দুর্গাপূজা উদযাপন করতে পারবে।

কী কী সংস্কারের প্রস্তাব দেয়া হলো বৈঠকে- জানতে চাইলে জামায়াত আমির বলেন, এ ব্যাপারে আমরা মুখ খুলব আগামী ৯ অক্টোবর। সেই পর্যন্ত আপনারা ধৈর্যধরে অপেক্ষা করেন। তিনি বলেন, আমরা সরকারের কাছে দু’টি রোডম্যাপ চেয়েছি। একটি নির্বাচনী আরেকটি সংস্কারের রোডম্যাপ। সংস্কারটা সফল হলে নির্বাচনটা সফল হবে। এ জন্য দু’টি বিষয়ের ওপর আমরা গুরুত্ব দিয়েছি। তাদের সাথে আমাদের আরো ডায়ালগ হবে এবং অচিরেই এ বিষয়টি তারাও প্রকাশ করবেন আমরাও প্রকাশ করবো। এটি খুব দেরি হবে না আশা করছি।
ডা: শফিকুর রহমান বলেন, সরকারকে বলেছি, আপনাদের প্রতি জনগণের অনেক বেশি প্রত্যাশা। এ প্রত্যাশার সময়টা টেনে আমরা লম্ব করব না। যৌক্তিক সময়ের সম্মানটা রক্ষা করব। উনারা দ্বিমত পোষণ করেননি। আশা করি এখানে কোনো সঙ্কট তৈরি হবে না।

খুনিদের নির্বাচনে অযোগ্যসহ ৭ দফা দিয়েছি : চরমোনাইর পীর
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে সংলাপ করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দলটির আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের (পীর সাহেব চরমোনাই) নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল এ সংলাপে অংশ নেয়। এ সময় পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন এবং খুনিদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার দাবিসহ সাত দফা সংস্কার প্রস্তাবনা প্রদান করেছেন। যমুনায় বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান রেজাউল করীম। প্রতিনিধি দলে ছিলেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রিন্সিপাল মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল-মাদানী, অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, ইঞ্জিনিয়ার আশরাফুল আলম, সহকারী মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ।

ইসলামী আন্দোলনের আমির আরো বলেন, সংস্কার করতে যতটুকু সময় লাগে সংস্কার কাজ শেষ করে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। স্বৈরাচারীরা যেন কোনোভাবে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হতে না পারে সে ব্যবস্থা করে সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে হবে। প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার জনমতের প্রতিফলনের সরকার। আপনাদের সাথে দেশের জনগণ রয়েছে, আপনারা সবচেয়ে শক্তিশালী সরকার। কিন্তু খুনি, অর্থ পাচারকারী, দাগী, অপরাধীরা কিভাবে দেশ থেকে পালাল? আপনারা কেন তাদেরকে দেশত্যাগের সুযোগ করে দিয়েছেন। এটি আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে। তিনি বলেন, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনব্যবস্থা প্রবর্তন করা। আরপিও-এর সর্বশেষ সংশোধনী বাদ দিয়ে আরপিও পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। ইসি নিয়োগে সাবেক বিচারপতি, আমলা ও সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের সাথে ওলামায়ে কেরামকে সম্পৃক্ত করা। সর্বদলীয় কমিটির মাধ্যমে ইসি নিযোগ দেয়া। ইসির কার্যক্রম জবাবদিহিতার আওতায় আনা। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতায় মোতায়েন রাখা। দুর্গম না হলে ব্যালট পেপার সকালে পাঠানো। ব্যালটে নির্বাচন হওয়া। আপাতত ইভিএম-এ নয়। সম্পদ পাচারকারী ও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে যেকোনো নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা। পুলিশসংক্রান্ত উপনিবেশন আমলের সব আইন বাতিল করা এবং পুলিশের ব্রিটিশ লিগ্যাসি বাদ দেয়া। কারণ তা ছিল নিপীড়ক ধরনের বাহিনী। দেশের মানুষের বোধ-বিশ্বাস, চরিত্র বিবেচনা করে সেবা জনসহায়ক বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা। অজ্ঞাত সংখ্যায় আসামি দিয়ে মামলা করার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। রাত্রিকালীন টহল পুলিশের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং টহলে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বিশেষ করে ঢাকাসহ সারাদেশে প্রবেশদ্বার গুলোতে যানজট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ। ঔপনিবেশিক লিগ্যাসি ও আইন বাদ দেয়া। আইনের উৎস হিসেবে শরীয়াহকে গ্রহণ করা। উচ্চ আদালতে আলাদা শরিয়া বেঞ্চ গঠন করা। বিচারপ্রার্থীর শরিয়া আইনে প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ রাখাসহ অনেক বিষয় লিখিতভাবে দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।


আরো সংবাদ



premium cement