০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ২ রবিউস সানি ১৪৪৬
`
হাজার হাজার হেক্টর জমির ধান তলিয়ে গেছে

অবিরাম বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত : নিহত ৩

-

অবিরাম বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে দেশের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার হাজার হাজার হেক্টর জমির ধান বন্যার পািনতে তলিয়ে গেছে।
শেরপুর জেলার ভাটি এলাকার ৪০ গ্রাম ডুবে গেছে। এ জেলায় পানিতে ডুবে তিনজন মারা গেছে। নোয়াখালীতে নতুন করে আবারো বন্যার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। ময়মনসিংহে আকস্মিক বন্যায় শত শত পুকুরের মাছ ভেসে গেছে।
নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, কয়েক দিনের বিরতিহীন বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে দেশব্যাপী। বিশেষত ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোতে এবং বৃহত্তর টাঙ্গাইল জেলার নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে পানিতে। অভ্যন্তরীণ ভারী বর্ষণ এবং দেশের উজানে মেঘালয় পর্বতের পাদদেশের এলাকাগুলো থেকে নিচে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি উল্লেখিত এলাকার নিম্নাঞ্চল তলিয়ে বন্যার সৃষ্টি করেছে। সামনে আরো কয়েকদিন বর্ষণ অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের আবহাওয়া বিভাগ।
বাংলাদেশে এ মুহূর্তে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বেশ সক্রিয় রয়েছে। এটা যে শুধু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় তা নয়, বাংলাদেশের উত্তরের পাশের দেশের মেঘালয় পর্বতাঞ্চলে বেশ সক্রিয়। একই সাথে বঙ্গোপসাগরে প্রবল অবস্থায় রয়েছে। ফলে সারা দেশেই কয়েকদিন ধরে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। তদুপরি বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপের সৃষ্টি হয়েছে। ওই লঘুচাপের প্রভাব রয়েছে দেশব্যাপী অব্যাহত বর্ষণে। আবহাওয়া অফিস বলছে, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বিদায় নিয়ে থাকে। কিন্তু এ বছর অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশে আসা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। সে কারণে আরো কমপক্ষে এক সপ্তাহ বৃষ্টির আধিক্য থাকতে পারে।

ঢাকার নদীতে পানি বাড়ছে : ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে আগামী দুই দিন ঢাকা জেলা ও নিকটবর্তী প্রধান নদীগুলো যেমন বুড়িগঙ্গা, টঙ্গী খাল, তুরাগ, বালু নদীর পানি বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলে রাজধানী ঢাকার নিম্নাঞ্চলে সৃষ্টি হতে পারে জলাবদ্ধতা।
ভারী বর্ষণপ্রবণ এলাকা : ময়মনসিংহ, ঢাকা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের জন্য গতকাল শনিবার ও আজ রোববারে দিনটায় বেশ দুঃসংবাদ বর্ণনা করেছেন কানাডা প্রবাসী বিশিষ্ট আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ। তিনি আবহাওয়ার বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে বলেন, দেশের সর্ব-উত্তর ও সর্ব-দক্ষিণের দুই-তিনটা জেলা ছাড়া দেশের সব জেলার উপরে ২৪ ঘণ্টা মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকার প্রবল আশঙ্কা করা হচ্ছে। জাপানের কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ থেকে প্রাপ্ত দৃশ্যমান মেঘের ভিডিও এনিমেশন বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয়বাষ্প খুলনা, বরিশাল, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সরাসরি আঘাত করছে ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের সীমান্তবর্তী মেঘালয় পর্বতে। মেঘালয় পর্বতের ঢাল বেয়ে সেই মেঘ আকাশে উঠে গিয়ে বিরতিহীনভাবে বৃষ্টি ঝরাচ্ছে। এ কারণে চলমান বৃষ্টি আজ রোববার বেলা ৩টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকার আশঙ্কা আছে। পূর্বাভাসে মোস্তফা কামাল বলেন, গতকাল বেলা ২টার পর থেকে রাত ৮টার মধ্যে ময়মনসিংহ বিভাগের জামালপুর ও শেরপুর জেলার উপরে ভারী থেকে খুবই ভারি বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে। নেত্রকোনা জেলার উপরেও হালকা থেকে মাঝারি মানের বৃষ্টির আশঙ্কা করা যাচ্ছে। গতকাল রাত ১২টার মধ্যে ফেনী, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার উপরে মাঝারি থেকে ভারী মানের বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা করা যাচ্ছে।বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র পূর্বাভাসে জানিয়েছে, শেরপুর জেলার ভুগাই নদী নাকুয়াগাঁও ও জামালপুর জেলার জিঞ্জিরাম নদীর গোয়ালাকান্দা পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই কেন্দ্রটি আবহাওয়া বিভাগকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, ময়মনসংিহ বিভাগ ও এই বিভাগের সংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে আগামী ২৪ ঘণ্টা অর্থাৎ আজ রোববার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ভুগাই-কংস, জিঞ্জিরাম ও সোমেশ্বরী নদী তীরবর্তী শেরপুর, জামালপুর এবং মনমনসিংহ জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে।
শেরপুর প্রতিনিধি জানান, টানা বর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে সৃষ্ট শেরপুর জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। উজানে পানি কিছুটা কমতে শুরু করলেও ভাটি এলাকায় আরো অন্তত ৪০ গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। এ পর্যন্ত ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার অন্তত ১৪টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে কমপক্ষে ৫০ হাজার মানুষ। বাড়ি ঘরে পানি ঢুকে পড়ায় চরম কষ্টের মধ্যে পড়েছে লোকজন। নালিতাবাড়ীর খলিশাকুড়ির খলিলুর রহমান (৬৫), আন্ধারুপাড়ার বৃদ্ধ ইদ্রিস আলী (৬৫) ও ঝিনাইগাতীর সন্ধ্যাকুড়ায় অজ্ঞাত ব্যক্তিসহ তিনজন বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। তবে মৃত্যুর সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে।

রাতভর বন্যাদূর্গত এলাকায় আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধার করেছেন পুলিশ, বিজিবি ও স্বেচ্ছাসেবকরা। বন্যাদুর্গত এলাকায় শুকনা খাবারের সঙ্কট চরমভাবে দেখা দিয়েছে। রাস্তাঘাট ব্রিজ কালভার্ট পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় চলাচলেও দুর্ভোগ পোহাচ্ছে মানুষ।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানিয়েছে, এ পর্যন্ত জেলায় ৭ হাজার ৭০০ হেক্টর জমির আমন ধান সম্পূর্ণ পানির নিচে এবং ৯ হাজার ৭০০ হেক্টর জমির আমন ধানের আবাদ আংশিক পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
নোয়াখালী অফিস জানায়, মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে অব্যাহত টানা ভারী বর্ষণে নোয়াখালীতে বন্যার পরিস্থিতি ফের অবনতি ঘটছে। গত দুই দিন যাবৎ অব্যাহত টানা ভারী বর্ষণে ফের রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে গেছে। নোয়াখালীর জেলা শহর মাইজদী ও জেলার প্রধান বাণিজ্য শহর চৌমুহনীসহ আটটি উপজেলা গত আগস্ট মাসে ভারী বর্ষণ ও ভারত ধেসে আসা পানিতে প্লাবিত হয়। খালগুলো ময়লা-আবর্জনায় বর্তী থাকায় পানি নিষ্কাশনে ব্যবস্থা বিঘœ ঘটে এবং জলাবদ্ধবতা সৃষ্টি হয়। ফলে ধীরগতিতে নামতে থাকে পানি। ধীর গতিতে পানি নিষ্কাশন হয়ে গত দুই মাসে পরিস্থিতি অনেকটা উন্নতি হয়। কিন্তু গত দুই দিনে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে টানা ভারী বর্ষণে ফের রাস্তাঘাট বাড়িতে পানি ঢুকে পড়ার উপক্রম হয়েছে।
হালুয়াঘাট (ময়মনসিংহ) সংবাদদাতা জানান, অতিবৃষ্টিতে আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি হয়েছে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে। পানিবন্দী রয়েছে কয়েক শত পরিবার। ১৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে কয়েক হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। স্বেচ্ছাসেবী ও ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে ভারতের মেঘালয় ও বাংলাদেশের ময়মনসিংহ অঞ্চলে অতিমাত্রায় বৃষ্টিপাত হয়। শুক্রবার সকাল থেকে সীমান্তবর্তী এলাকার ভূবনকুড়া, আমিরখাঁকুড়া, মাজরাকুড়া, বাঘাইতলা, সংড়া, পলাশতলা, গাজিরভিটা, সূর্যপুর, সমনিয়াপাড়া হয়ে পাহাড়ি ঢল নামে। সন্ধ্যার পর হালুয়াঘাট পৌর শহরে পানি প্রবেশ করে।

 


আরো সংবাদ



premium cement