০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ২ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

শিল্পবাণিজ্যে গতি ফেরাতে কার্যকর পদক্ষেপ চান ব্যবসায়ীরা

-


ব্যবসা-বাণিজ্যে স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া দরকার বলে মনে করছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা। একই সাথে তারা বলছেন, ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য সুদহার কমানো, স্থানীয় বাজারে চাহিদা সৃষ্টি, রফতানির প্রতিবন্ধকতা দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
গতকাল ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) কর্তৃক আয়োজিত ‘কারেন্ট স্টেট অব দ্য ইকোনমি অ্যান্ড আউটলুক অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারে ব্যবসায়ীরা এসব কথা বলেন।
এসময় এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, ১৫ শতাংশের বেশি ব্যাংক ঋণের সুদ দিয়ে পৃথিবীতে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা খুবই দুঃসাধ্য একটি ব্যাপার। তবে আমাদের উদ্যোক্তাদের সেটা করতে হচ্ছে। বিশেষ করে কাস্টমস হাউসসমূহে দূর্নীতির কারণে ব্যবসায়ীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ অবস্থা নিরসনে ফিন্যান্সিয়াল রিফর্মস কমিটি গঠন করার পাশাপাশি অটোমেশন নিশ্চিত করা জরুরি বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, দেশে মধ্যম আয়ের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে, যাদেরকে করজালের আওতায় নিয়ে আসা গেলে জিডিপিতে রাজস্বের অবদান অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে এবং লাভবান হবে আমাদের অর্থনীতি। তিনি আরো বলেন, উচ্চ মূল্য দিয়েও শিল্পখাতে প্রয়োজনীয় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না, তাই আমাদের অনশোর-অফশোর গ্যাস অনুসন্ধানে আরো জোর দিতে হবে।

লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, আমরা উদ্যোক্তারা এ দেশে থেকেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার মাধ্যমে অর্থনীতিকে আরো সুদৃঢ় করতে আগ্রহী। তিনি বলেন, দক্ষ ও ভালো নিয়োগের মাধ্যমে সঙ্কট উত্তরণ সম্ভব, যেটি বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্যবসায়ীরা ভীষণভাবে অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে, যা উত্তরণে শিল্পাঞ্চলে শিল্পপুলিশ ও সেনাবাহিনীর কার্যক্রম আরো জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়াও প্রশাসনের অনেক জায়গা থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না, এক্ষেত্রে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নিকট থেকে সুনিদিষ্ট বার্তা দেয়া দরকার।
তিনি বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে স্থানীয়ভাবে আমাদের চাহিদা কমে গেছে, যেটা উদ্বেগের বিষয়, সেখানে সবাইকে নজর দিতে হবে। তিনি আরো বলেন, ডাবল ডিজিটের সুদ দিয়ে ব্যবসায় মুনাফা করা অসম্ভব, তাই আমাদের দীর্ঘমেয়াদি টেকসই অর্থায়ন রোডম্যাপ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ওপর অধিক হারে জোরারোপ করতে হবে। শুধুমাত্র রেমিট্যান্স ও দাতাদের ওপর নির্ভর করলে চলবে না, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের ওপর আরো অধিক হারে গুরুত্ব দিতে হবে।

বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বিদ্যমান শ্রমিক অসন্তোষ ও বিক্ষোভের পিছনে অনুপ্রবেশকারীদের হাত রয়েছে এবং এ অবস্থা থেকে উত্তরণে শ্রমিক-মালিক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মধ্যকার সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় করতে হবে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে শ্রমিকদের বেশকিছু দাবি মেনে নেয়া হয়েছে, পাশাপাশি শ্রমিকদের যেকোনো যৌক্তিক দাবি বিজেএমইএ ও বিকেএমইএ ইতিবাচকভাবে মেটাতে বদ্ধ পরিকর। সেইসাথে বৈশ্বিক ব্রান্ডসমূহ ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের নিকট হতে পণ্যের যৌক্তিক মূল্য প্রাপ্তির ওপর তিনি জোরারোপ করেন, যার মাধ্যমে শ্রমিক স্বার্থ আরো সুসংহত করা সম্ভব হবে। খেলাপি ঋণ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ সিদ্ধান্তের কারণে দেশের অধিকাংশ উদ্যোক্তার খেলাপি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, যা পুনঃবিবেচনা করা প্রয়োজন বলে তিনি অভিমত দেন। সেইসাথে শিল্পখাতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত আহ্বান জানান।
ডিসিসিআইর সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, বিচার বিভাগ, এনবিআর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রমে বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে, যা আশাব্যঞ্জক একটি বিষয়। তবে বর্তমান সময়ে তৈরি পোষাক খাতের ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব ও শ্রমিক অসন্তোষের কারণে শিল্প-কারখানায় নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ায় পণ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এটা মোটেই কাম্য নয়। যেকোন মূল্যে এ পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে হবে, তা না হলে বাংলাদেশ বৈশ্বিকভাবে ইমেজ সঙ্কটে পড়তে পারে। তিনিও কলকারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতকরণের ওপর জোর দেন। শামস মাহমুদ আরো বলেন, এলডিসি উত্তরণে আমরা এখনো প্রস্তুত নই, বিষয়টি নিয়ে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেয়া দরকার বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. মাসরুর রিয়াজ বলেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সমস্যা সমাধানে আমরা গত দুই বছরে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছি, যার প্রভাব বর্তমান সময়ে পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং ব্যবসায়ীদের আস্থার পরিবেশ উন্নয়নে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে শিল্পখাতের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে মাঠপর্যায়ে কার্যকর উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না, যেটি মোটেই কাম্য নয়। এ ছাড়াও দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ সম্প্রসারণ, এসএমইখাতে অর্থায়ন ও উন্নয়ন কার্যকর নীতি সহায়তা প্রদান অত্যন্ত জরুরি বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। তিনি আরো বলেন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে তা আরো ভয়াবহ হবে। প্রাণ-আরএফএল গ্রপের চেয়ারম্যান এবং সিইও আহসান খান চৌধুরী বলেন, শ্রমিক অসন্তোষ, জ্বালানি স্বল্পতা, ব্যাংক ঋণের সুদের উচ্চহারসহ নানাবিধ সমস্যায় আমাদের বেসরকারিখাতে মোকাবেলা করছে, যা দ্রুততম সময়ে উন্নতি করতে হবে। এ ছাড়াও ঋণ খেলাপির সংষ্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন।

মাস্টারকার্ড বাংলাদেশের সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল বলেন, চলতি বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে ডিজিটাল পেমেন্ট কার্যক্রম বেশ কম হলেও এখন কিছুটা বেড়েছে, তবে গত মাসের বন্যা ও পার্বত্য এলাকায় অস্থিরতার ফলে স্থানীয় পর্যটন ব্যবসা উল্লেখজনক হারে কমে গেছে।
ফুড পান্ডা বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এবং সিইও আমব্রারিন রেজা বলেন, গত ৩ মাসে ইন্টারনেট সেবা বিঘিœত হওয়ায় বিশেষ করে ডিজিটাল সেবা খাতের ব্যবসায়ীরা মারাক্তকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তিনি সারা দেশে ডিজিটাল সেবাখাতের সম্প্রসারণে ইন্টারনেট খরচ কমানো প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেন।
সেমিনারের সূচনা বক্তব্যে ডিসিসিআই সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, কোভিডপরবর্তী সময় থেকেই আমরা নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, তবে সাম্প্রতিক সময়ে শিল্পকারখানায় অসন্তোষের কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, উচ্চমূল্যস্ফীতি ও ব্যাংক ঋণের সুদের উচ্চ হার এবং সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনায় অস্থিতিশীলতার কারণে বেসরকারিখাত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতির সার্বিক বিকাশে এ অবস্থার উত্তরণ জরুরি। তিনি উল্লেখ করেন, দেশের ব্যাংকগুলোতে তারল্য সঙ্কট রয়েছে, ফলে উদ্যোক্তারা প্রত্যাশীত মাত্রায় ঋণ পাচ্ছেন না, সেইসাথে কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা শিল্পখাতে পণ্য উৎপাদনকে ব্যাহত করছে, ফলে স্থানীয় চাহিদার জোগান মেটানোর পাশাপাশি রফতানি সমন্বিত রাখা বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা চেম্বার সভাপতি শিল্পাঞ্চলসমূহে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের পাশাপাশি শিল্পাঞ্চলসমূহে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে আবাসন, শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা স্বল্পমূল্যে নিশ্চিতকরণে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণেরও দাবি জানান।


আরো সংবাদ



premium cement