০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ২ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী আর নেই

-


সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ডা: এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ওরফে বি চৌধুরী ইন্তেকাল করছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। শুক্রবার রাত ৩টা ১৫ মিনিটে নিজের প্রতিষ্ঠিত উত্তরা মহিলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বদরুদ্দোজা চৌধুরীর প্রেস সচিব জাহাঙ্গীর আলম এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এ ছাড়া ছেলে মাহি বি চৌধুরী নিজের ফেসবুক আইডিতে পোস্ট দিয়ে তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তার বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে, দুই মেয়ে এবং নাতি-নাতনীসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
ফুসফুসে সংক্রমণ হওয়ায় গত ২ অক্টোবর সকালে বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে উত্তরা মহিলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সে দিন তার মেয়ে ডা: শায়লা চৌধুরী জানান যে, তার বাবা আগে থেকেই স্কিমিক হার্ট ডিজিজে ভুগছিলেন।
আগেও একাধিকার অসুস্থ হয়ে পড়ায় এই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৯৪ বছর বয়সী বদরুদ্দোজা চৌধুরী বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায়ও ভুগছিলেন বলে তথ্য দিয়েছেন তার চিকিৎসকরা। এর আগে, রাতে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়ার তথ্য জানিয়েছিলেন ছেলে মাহি বি চৌধুরী। তিনি বাবার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছিলেন।
নিজ গ্রাম মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর স্টেডিয়ামে নামাজে জানাজা শেষে তাকে গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
খ্যাতিমান চিকিৎসক ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ বদরুদ্দোজা চৌধুরী ১৯৩২ সালের ১ নভেম্বর কুমিল্লা শহরে (প্রখ্যাত ‘মুন্সেফ বাড়ি’) নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা অ্যাডভোকেট কফিল উদ্দিন চৌধুরী কৃষক প্রজা পার্টির সহসভাপতি, যুক্তফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন।

বি চৌধুরী একজন কৃতী ছাত্র ছিলেন। ১৯৪৭ সালে ঢাকার বিখ্যাত সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে মেধাতালিকায় দ্বিতীয় স্থান নিয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৪৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাস করেন। তিনি ১৯৫৪-৫৫ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন।
বদরুদ্দোজা চৌধুরী লন্ডনে অবস্থিত কারফিউ অ্যান্ড এডিনবার্গ থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রের ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। জীবনের সব পরীক্ষাতেই মেধাতালিকায় তার স্থান ছিল প্রথম দিকে।
ডা: বদরুদ্দোজা চৌধুরী যুক্তরাজ্যের রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ানস্ লন্ডন, এডিনবার্গ ও গ্লাসগো থেকে নির্বাচিত ফেলো-এফআরসিপি এবং বাংলাদেশের (সম্মানিত) এফসিপিএস। তিনি রোগবিজ্ঞানে দেশের একজন শীর্ষ অধ্যাপক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং ষাটের দশকের শেষের দিকে রোগবিজ্ঞান নিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) ‘আপনার ডাক্তার’ অনুষ্ঠানের রেকর্ড অর্জনকারী সফল উপস্থাপক।

সফল পার্লামেন্টেরিয়ান অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী জাতিসঙ্ঘে তিনবার বক্তৃতা দেন। তিনি একজন লেখক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, উপস্থাপক এবং সুবক্তা ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত এবং বহু গ্রন্থের প্রণেতা।
বি চৌধুরী রাজনীতি ও সমাজ উন্নয়নে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৩ সালে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পদক লাভ করেন। তিনি ১৯৭৭ সালে শ্রেষ্ঠ টিভি উপস্থাপক হিসেবে বাংলাদেশ টেলিভিশন পুরস্কারও লাভ করেন। তিনি ১৯৭৭ সালে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমানের সরকারে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন। জাতীয়তাবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ১৯৭৯ সালে বিএনপিতে যোগ দেন এবং দলটির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব হিসেবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।
বদরুদ্দোজা চৌধুরী চিকিৎসক থেকে ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের ডাকে বিএনপিতে যোগ দিয়ে রাজনীতিতে নামেন। তিনি দলটির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব হন। জিয়াউর রহমানের সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। বি চৌধুরী মরহুম রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের ডাকে ১৯৭৮ সালে রাজনীতি শুরু করেন। তিনি মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর থেকে ১৯৭৯ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং কেবিনেট মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে তিনি দ্বিতীয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং প্রথমে শিক্ষামন্ত্রী ও পরে সংসদ উপনেতা হন। ১৯৯৬ সালে তিনি সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতার দায়িত্ব পালন করেন।
সর্বশেষ ২০০১ সালে তিনি পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং একই বছরের অক্টোবর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিএনপি সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন।

অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর বাংলাদেশের দ্বাদশ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক কারণে ২০০২ সালের ২১ জুন রাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন তিনি।
২০০৪ সালের ৮ মে বি চৌধুরী বিকল্পধারা বাংলাদেশ নামে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দলটির প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে ছিলেন। স্ত্রী হাসিনা ওয়ার্দা চৌধুরী, দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে ছিল বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সংসার। তার বড় মেয়ে মুনা চৌধুরী পেশায় আইনজীবী, ছোট মেয়ে শায়লা চৌধুরী চিকিৎসক। তিনি উত্তরা মহিলা মেডিক্যাল কলেজে অধ্যাপনা করেন। বদরুদ্দোজা চৌধুরীর একমাত্র ছেলে মাহি বি চৌধুরী, বিকল্পধারা বাংলাদেশের নেতা। তিনি মুন্সিগঞ্জ-১ আসন থেকে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
বি চৌধুরীর প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত : মরহুম সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর প্রথম নামাজে জানাজা গতকাল শনিবার সকাল ৮টায় তার নিজের প্রতিষ্ঠিত উত্তরা মহিলা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তার প্রেস সচিব জাহাঙ্গীর আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। বদরুদ্দোজা চৌধুরীর দ্বিতীয় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় গতকাল বাদ জোহর বারিধারা কূটনৈতিক এলাকার ৮ নম্বর সড়কে অবস্থিত বায়তুল আতিক জামে মসজিদে। পরে তৃতীয় নামাজে জানাজা আজ ৬ অক্টোবর সকাল ১০টায় শ্রীনগর স্টেডিয়ামে এবং বাদ জোহর গ্রামের বাড়ি মজিদপুর দয়হাটায় চতুর্থ নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।

প্রধান উপদেষ্টার শোক : প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস শনিবার সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, জাতি একজন বিশিষ্ট জনসেবক ও একজন শ্রদ্ধেয় রাজনীতিবিদকে হারাল। প্রধান উপদেষ্টা এক শোক বার্তায় বলেন, ‘আমি মরহুমের রূহের মাগফিরাত কামনা করছি। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌসে সুন্দর স্থান দান করুন।’
বার্তায় প্রধান উপদেষ্টা চিকিৎসক ও জনসেবক হিসেবে বদরুদ্দোজা চৌধুরীর দীর্ঘ ও বহুল সম্মানিত কর্মজীবনের কথা স্মরণ করেন। তিনি বলেন, ডা: বদরুদ্দোজা চৌধুরী দেশের একজন প্রখ্যাত চিকিৎসক হিসেবে কল্যাণ ও সুস্বাস্থ্যের বার্তা ছড়িয়েছেন। একসময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) তার উপস্থাপনায় প্রচারিত ‘আপনার ডাক্তার’ অনুষ্ঠানটি লাখ লাখ দর্শকের প্রিয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। এ অনুষ্ঠানটি তাকে ব্যাপক পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা এনে দেয়।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘তিনি একই স্তরের একনিষ্ঠতা নিয়ে রাজনীতিতে এসেছিলেন। পাঁচবারের সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি ৯০-এর দশকে দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সংসদে তার বক্তৃতা সব মতের রাজনীতিবিদদের কাছে প্রশংসিত হয়েছিল।’
প্রধান উপদেষ্টা আশা করেন তার পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধব এই ক্ষতি বহন করার শক্তি সঞ্চয় করতে পারবেন। তিনি জনগণকে তার জীবন থেকে শিক্ষা নেয়ার এবং ‘জনগণ ও গণতন্ত্রের কল্যাণে নিজেদের উৎসর্গ করার’ আহ্বান জানান।

মির্জা ফখরুলের শোক
আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, সাবেক রাষ্ট্রপতি, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব, বিকল্পধারার প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা: এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
গতকাল শনিবার বিএনপির সহ-দফতর সম্পাদক মুহম্মদ মুনির হোসেনের স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ শোক জানান তিনি।
শোকবার্তায় বিএনপি মহাসচিব বলেন, অধ্যাপক ডা: এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর মৃত্যুতে তার পরিবার-পরিজনের মতো আমিও গভীরভাবে সমব্যথী। মরহুম বদরুদ্দোজা চৌধুরী একজন দক্ষ ও প্রাজ্ঞ রাজনীতিক হিসেবে দেশের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। তিনি ছিলেন জাতীয় রাজনীতির একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তিনি তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে একজন সুদক্ষ সংগঠক ও প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। গণতন্ত্রের প্রতি তার আন্তরিক নিষ্ঠা তাকে একটি স্বতন্ত্র মাত্রা দিয়েছিল। দেশের স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের সংগ্রামে তিনি ছিলেন আপসহীন ও সাহসী যোদ্ধা। দেশ ও মানুষের প্রতি সহমর্মী মরহুম বদরুদ্দোজা চৌধুরী রাজনীতির পাশাপাশি একজন প্রসিদ্ধ চিকিৎসক হিসেবেও মানুষের সেবা করে গেছেন।
তিনি অধ্যাপক ডা: এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর রূহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকাহত পরিবারবর্গ, আত্মীয়স্বজন, গুণগ্রাহী ও ভক্তদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

 


আরো সংবাদ



premium cement