০৫ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১,
`

সুসম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয়

প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের বৈঠক : বাসস -

- ড. ইউনূসের সরকারে আস্থা মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর
- ভাগ্য খুলছে বাদ পড়া ১৮ হাজার শ্রমিকের, যৌথ ব্রিফিংয়ে ঘোষণা

টিকিট জটিলতাসহ অপ্রত্যাশিত কিছু পরিস্থিতির কারণে মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি হাজার হাজার বাংলাদেশী শ্রমিক। তাদের দেশটিতে যেতে সহায়তা করবে মালয়েশিয়া। প্রথম পর্যায়ে ১৮ হাজার শ্রমিককে যেতে সহায়তা করবে মালয়েশিয়া সরকার। পর্যায়ক্রমে এ সংখ্যা আরো বাড়বে।
গতকাল ঢাকায় সংক্ষিপ্ত সফরকালে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দাতো শ্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। এ সময়ে তিনি জানান, ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর তার পূর্ণ আস্থা আছে। তারা বাংলাদেশের শান্তি ও নিরাপত্তা পুনর্গঠনে অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, তার সরকার জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে কাজ করছে। এ কাজে মালয়েশিয়াকে পাশে চান। এর আগে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বৈঠক করেন দুই দেশের সরকার প্রধান। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে তিনি ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ এবং আগের সরকারের নৃশংসতার কথা সংক্ষেপে তুলে ধরেন। মালয়েশিয়ার সরকারও সব ধরনের সহায়তা এবং পূর্ণ সমর্থন জানান ইউনূস সরকারের প্রতি। বৈঠক শেষে দুই দেশের সরকার প্রধানের এই যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ড. ইউনূস বলেন, বৈঠকে রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও মানবিক বিষয় আলোচনা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের আমন্ত্রণে চার ঘণ্টার সফরে গতকাল শুক্রবার দুপুরে আড়াইটার দিকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্বে দেশটির ৫৮ সদস্যদের প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসেন। এ দিন বেলা ২টার দিকে তাদের বহনকৃত বিমান হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছলে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাকে অভ্যর্থনা জানান। এরপর তাকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর এটি বাংলাদেশে বিদেশী কোনো সরকার প্রধানের প্রথম উচ্চপর্যায়ের সফর।

বিমানবন্দর থেকে সোজা হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে পৌঁছেন দুই দেশের শীর্ষনেতা। প্রথমে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সাথে ওয়ান-টু-ওয়ান বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর। এরপর দুই নেতা দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বসেন। এ সময়ে সরকারের অন্য উপদেষ্টা ও সচিবরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় মালয়েশিয়ার সহায়তা কামনা করা হয়। পাশাপাশি আসিয়ান কাঠামোর মধ্যে বাংলাদেশকে একটি ‘সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার’ হওয়ার বিষয়টিও উত্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়াও দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বেশ কিছু বিষয় স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- অর্থনৈতিক সহযোগিতা, রাজনৈতিক সম্পর্ক, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, শ্রম অভিবাসন, শিক্ষা, প্রযুক্তি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা অন্যতম। দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গণমাধ্যমের সাথে কথা বলেন দুই দেশের সরকারপ্রধান। এরপর বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিনের সাথেও সাক্ষাৎ করেন আনোয়ার ইব্রাহিম। সংক্ষিপ্ত সফর শেষে সন্ধ্যা ৬টায় মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে এই সফর নিয়ে যৌথ বিবৃতি দেয়া হবে বলে জানা যায়।

যৌথ সংবাদ সম্মেলনে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, মানুষের মর্যাদা রক্ষায় ড. ইউনূসের ভূমিকা আমরা জানি। ব্যক্তিগতভাবে তাকে আমি চার দশক থেকে চিনি। তাই তার ওপর ভরসা রাখছি। বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সমর্থন থাকবে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন, সঙ্কটময় পরিস্থিতির জন্য যারা মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি প্রথম দফায় এমন ১৮ হাজার কর্মপ্রত্যাশীদের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের কর্মীরা আধুনিক দাস নয়। তাদের সুরক্ষা দেয়ার দায়িত্ব মালয়েশিয়ার। এ সময় বাংলাদেশে যেসব মালয়েশিয়ান প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, তাদের সুবিধা দেয়ার কথাও জানান তিনি। আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, আমাদের দেশে আরো জনশক্তি প্রয়োজন। তবে উভয় দেশের মধ্যে শ্রম অভিবাসন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা থাকতে হবে। এ ছাড়া সেমি কন্ডাক্টর, ডেটা সেন্টার, এআই, নিউ টেকনোলজির বিষয়ে যৌথভাবে কাজ করার বিষয়ে সম্মত হয়েছি।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন, মালয়েশিয়া বাংলাদেশের শান্তি ও নিরাপত্তা পুনর্গঠনে অন্তর্বর্তী সরকারকে সহায়তা ও সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। আমাদের অন্তত সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউনূস সেন্টার রয়েছে, যা সামাজিক ব্যবসা এবং ড. ইউনূসের তিন শূণ্যের ধারণা প্রচার করে। আমরা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরো এগিয়ে নেয়ার বিষয়ে সম্মত হয়েছি। একমত হয়েছি তারুণ্যের শক্তি ব্যবহার করে সামনে এগোনোর বিষয়ে। তার মতে, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে। এসবের মূল লক্ষ্য দুই দেশের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া।

ড. ইউনূস বলেন, মালয়েশিয়ার সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে চাই। দুই দেশই সম্পর্ক এগিয়ে নিতে সম্মত। অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে। তাছাড়া বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, শিক্ষা, প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন, জনশক্তি রফতানি, যোগাযোগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা সহযোগিতাসহ পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আলাপ হয়েছে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং ভিসা সহজীকরণের বিষয়েও। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বৈঠকে তিনটি প্রধান পেয়েছে। এগুলো হলো- রাজনৈতিক, মানবিক, বাণিজ্যিক দিক। মালয়েশিয়ার সাথে জনশক্তি রফতানির বিষয়ে কথা বলেছি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, সাত বছর আগে ১২ লাখ রোহিঙ্গা এসেছিল। বর্তমানে সেটি আরো বেড়েছে। এখনো প্রতিদিন চার শ’ থেকে পাঁচ শ’ রোহিঙ্গা প্রবেশ করছে। তিনি বলেন, গত সাত বছরে রোহিঙ্গাদের নতুন শিশু জন্ম নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ২০১৭ সালে যেসব শিশু জন্ম নিয়েছিল, বর্তমানে তাদের বয়স সাত বছর। এসব শিশু জানতে পারছে, তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এসব হতাশা তাদের প্রতিক্রিয়াশীল করে তুলতে পারে। এটা অত্যন্ত উদ্বেগের। তবে এটির সমাধান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হাতে। ড. ইউনূস বলেন, এই সঙ্কট কেবল বাংলাদেশই নয়, মালয়েশিয়াও ভুক্তভোগী। এটি নিরসনে একসাথে আমরা কাজ করছি। বিভিন্ন আঞ্চলিক জোটকে এতে সম্পৃক্ত করার কথাও জানান তিনি।

ড. ইউনূস বলেন, আনোয়ার ইব্রাহিম তার ৪০ বছরের বন্ধু। পুরনো বন্ধুকে ঢাকায় স্বাগত জানাতে পেরে তিনি খুবই খুশি। বৈঠকে ড. ইউনূস ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিপ্লব, ছাত্র ও জনগণের আত্মত্যাগ এবং বিগত সরকারের সংঘটিত গণহত্যা নিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। প্রধান উপদেষ্টা মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর নেতাদের সাথে তার দীর্ঘ সম্পর্ক নিয়েও কথা বলেন। দুই নেতা তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে একই গাড়িতে চড়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের ভেন্যুতে যান।
মালয়েশিয়া বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শ্রমবাজার। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দেশটির সাথে নানা ধরনের সম্পর্ক রয়েছে। বর্তমানে মালয়েশিয়া বাংলাদেশে অষ্টম শীর্ষ বিনিয়োগকারী দেশ। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে দেশটির বিনিয়োগ ৮৩ কোটি ২৭ লাখ ডলার। প্রতি ডলার ১২০ টাকা হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ছিল ৩ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন মর্কিন ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশ মালয়েশিয়ায় রফতানি করেছে ৩৭ কোটি ১৯ লাখ ডলার। মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশ আমদানি করেছে ৪৫ কোটি ডলারের পণ্য। আমদানির বিবেচনায় চীন ও ভারতের পরেই তৃতীয় অবস্থানে মালয়েশিয়া। দেশটির সাথে বাংলাদেশের এফটিএ বা মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে আলোচনা চলছে। এটি সম্ভব হলে মালয়েশিয়ার বাজার বাংলাদেশীদের জন্য আরো সম্প্রসারিত হবে। শুল্কমুক্ত পণ্যের কোটা বাড়বে। এ ছাড়া মালয়েশিয়াসহ আসিয়ান অঞ্চলে বাংলাদেশী পণ্যের বাজার সম্প্রসারণে মালয়েশিয়া চাইলে ভূমিকা রাখতে পারে। দেশটির বাজারে যেসব পণ্য রফতানির সম্ভাবনা রয়েছে, সেগুলো হলো- কৃষি, তথ্যপ্রযুক্তি, লজিস্টিক ও হালাল পণ্য। এ ছাড়াও শিক্ষা-সংস্কৃতিসহ নানাবিধ বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিসহ বেশ কয়েকটি মালয়েশিয়ার কোম্পানি বাংলাদেশে পাঁচ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করেছে। এখন শিক্ষাসহ আরো বিনিয়োগে আগ্রহী। এ ছাড়া চিকিৎসাসেবা গ্রহণে মালয়েশিয়া একটি পছন্দের গন্তব্য হতে পারে। এ ছাড়া ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে মালয়েশিয়া এশিয়ার দেশগুলোর সংগঠন আসিয়ানের পরবর্তী চেয়ারম্যান হতে যাচ্ছে। ফলে আসিয়ানসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনা হবে। এ ছাড়াও আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে আসিয়ানে বাংলাদেশকে ‘সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার’ হওয়ার বিষয়টিও বিশেষভাবে উত্থাপন করা হয়েছে।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement