০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১৮ আশ্বিন ১৪৩১, ২৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

এস আলম বেক্সিমকো নাসার লুটে ধুঁকছে ব্যাংক খাত

-


দেশের ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়ে দুর্দশায় পড়া ব্যাংকগুলোকে টাকার সঙ্কট মেটানোর চেষ্টা করছে। এরই অংশ হিসেবে গতকাল চারটি ব্যাংককে ৯৪৫ কোটি টাকা বিশেষ ব্যবস্থায় ধার দেয়ার ব্যবস্থা করেছে তারা। বিশেষ করে ব্যাংক খাতের মাফিয়া ও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার প্রধান অর্থের জোগানদাতা সাইফুল আলম মাসুদ ওরফে এস আলম, নাসা গ্রুপের কর্ণধার ও এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার ও বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমানের দখলকরা ব্যাংকগুলোর নগদ অর্থের সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। এসব ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকেও কোনো টাকা উত্তোলন করা যাচ্ছে না। একমাত্র ইসলামী ব্যাংক বাদে অন্য ব্যাংকগুলো শাখা থেকেও গ্রাহকদের তেমন টাকা দিতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে এসব ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে গঠিত নতুন পর্ষদকে সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে রাতারাতি আটটি ব্যাংকের মালিকানা দেয়া হয় মাফিয়া বনে যাওয়া এস আলম গ্রুপকে। এশিয়ার অন্যতম সেরা একটি ব্যাংক ছিল বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংক। ২০১৭ সালে একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে এ ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও এমডিকে তুলে নিয়ে তাদের এস আলমের কাছে শেয়ার হস্তান্তরে বাধ্য করা হয়। একইভাবে দখলে নেয়া হয় সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। পাশাপাশি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকেরও মালিকানা নিয়ে নেয় তারা। পরে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকেরও নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল তারা। এসব ব্যাংক থেকে গত সাত বছরে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা নামে-বেনামে বের করে নেয় এস আলম। ফলে এসব ব্যাংকগুলোর মধ্যে ছয়টির পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, তাদের অনেক শাখায় লেনদেন করার মতো নগদ টাকাও নেই। আমানতকারীদের চাপে পড়েথ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন শাখা কর্মকর্তারা।

এ দিকে এক্সিম ব্যাংকের দখলে ছিলেন স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার অন্যতম অর্থের জোগানদাতা ও আস্থাভাজন নাসা গ্রুপের প্রধান নজরুল ইসলাম মজুমদার। তিনি ১৭ বছর নানা কায়দায় এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ ধরে রাখা ও বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকের (বিএবি) চেয়ারম্যানও ছিলেন। এক্সিম ব্যাংক থেকেও বিপুল অঙ্কের ঋণ নামে-বেনামে নিয়ে গেছে নাসা গ্রুপ। ব্যাংকের নতুন পর্ষদের একজন পরিচালক গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, এক্সিম ব্যাংকের ভেতরের অবস্থা খুবই নাজুক। এত দিন মজুমদার প্রভাব খাটিকে ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ম্যানেজ করে খেলাপি ঋণ কম দেখাত। কিন্তু প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৫০ শতাংশের বেশি।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার পর দখল করা ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা আটটিসহ মোট ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। পর্ষদ পুনর্গঠন করা অন্য তিন ব্যাংক হলো আইএফআইসি, ইউসিবি ও এক্সিম ব্যাংক। এর মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের দখলে ছিল আইএফআইসি ব্যাংক, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের নিয়ন্ত্রণে ছিল ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ব্যাংকের তারল্য সঙ্কট কাটিয়ে পুনরায় সক্ষমতা ফেরাতে উদ্যোগ নিয়েছে। ওই সব দুর্বল ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গ্যারান্টি দিয়ে যেসব ব্যাংকে বাড়তি তহবিল রয়েছে তাদের মাধ্যমে নগদ অর্থ সরবরাহ করা হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে গতকাল চার বাণিজ্যিক ব্যাংককে ৯৪৫ কোটি টাকা ধার হিসেবে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে দেশের কয়েকটি ব্যাংক। অর্থসহায়তা পাওয়া ব্যাংকগুলো হলো- ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টির মানে হলো, কোনো কারণে কোনো ব্যাংক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই টাকা দেবে। আপাতত কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি টাকা না দিয়ে অন্য ব্যাংক থেকে ধারের ব্যবস্থা করছে। অর্থাৎ বাজারের টাকা এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে যাবে। ফলে মূল্যস্ফীতির ওপর বাড়তি প্রভাব পড়বে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টির বিপরীতে চার ব্যাংককে ধার হিসেবে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে পাঁচটি ব্যাংক। এর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংককে দেয়া ৩০০ কোটি টাকার মধ্যে সিটি ব্যাংক ২০০, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ৫০ ও মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ৫০ কোটি টাকা দিয়েছে। সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকও ৩৫০ কোটি টাকা ধার পেয়েছে। ব্যাংকটিকে ধার দিয়েছে সিটি ব্যাংক ৩০০ কোটি ও মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ৫০ কোটি টাকা। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ২৫ কোটি দিয়েছে ইস্টার্ন ব্যাংক। ন্যাশনাল ব্যাংক পেয়েছে ২৭০ কোটি টাকার অর্থসহায়তা। ব্যাংকটিকে ধার দিয়েছে বেঙ্গল কমার্স ব্যাংক ২০ কোটি, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ৫০ কোটি ও সিটি ব্যাংক ২০০ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭০০ কোটি টাকা ধার দিয়েছে সিটি ব্যাংক ।
এর আগে গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টির বিপরীতে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ধার দিতে সবল ১০ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও তাদের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। ব্যাংকগুলো হলো : রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক, বেসরকারি খাতের ব্র্যাক, ইস্টার্ন, সিটি, শাহ্জালাল ইসলামী, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, পূবালী, ঢাকা, ডাচ্-বাংলা ও ব্যাংক এশিয়া। বৈঠক শেষে জানানো হয়, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে দেওয়া ঋণের টাকা ফেরত চাইলে সবল ব্যাংকগুলোকে তিন দিনের মধ্যেই তা ফেরত দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোনো ব্যাংক ঋণ দেয়ার জন্য কোনো টাকা নিতে পারবে না। কোন ব্যাংককে কত টাকার তারল্যসহায়তা দেয়া হবে, সেটি নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া দুই ব্যাংকের সমঝোতার ভিত্তিতে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হবে। এসব শর্তে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ধার দিতে রাজি হয়েছে ১০ ব্যাংক।

 


আরো সংবাদ



premium cement