৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৫ আশ্বিন ১৪৩১, ২৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

৯১ হাজার কোটি টাকার ঋণ নবায়ন

স্বৈরাচারের শেষ বছর
-


নীতিমালা শিথিল করে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার শেষ বছরে ৯১ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়। এত বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ নবায়ন ব্যাংকিং খাতের ইতিহাসে আর কখনো হয়নি। এ সময় খেলাপি ঋণ আড়াল করার চিত্র ছিল চোখে পড়ার মতো। এস আলম, বেক্সিমকো, নাসা গ্রুপসহ হাসিনা সরকারের প্রধান অর্থের জোগানদাতা ব্যবসায়ীদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর। যখন যা ইচ্ছে মতো তার প্রতিফলন হতো বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায়। ব্যবসায়ী গ্রুপগুলো গর্ব করে বলত তাদের তদবিরে গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আর এ কারণেই তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী নীতিমালা শিথিল করত বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ব্যাংক খাতের কলঙ্ক এস আলম, তার পিএস আকিজ উদ্দিন, বেক্সিমকো ও নাসা গ্রুপসহ বেশ কয়েকটি ব্যবসায়ী গ্রুপকে বাঁচাতে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া একজন ডেপুটি গভর্নরসহ বেশ কয়েকজন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা সবসময় তৎপর থাকতেন। এস আলম, আকিজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে যেন কোনো প্রকার পদক্ষেপ নেয়া না হয় সে জন্য বাংলাদেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) কিছু কর্মকর্তাকে রীতিমতো ধমক দেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ৫ আগস্টের পর স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে গেলেও ব্যাংক খাত বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যেই স্বৈরাচারের দোসররা এখন ঘাপটি মেরে আছে। কোন বিভাগে কী ধরনের কাজ হচ্ছে তা নিয়ে তারা সার্বক্ষণিক তদারকি করে থাকেন। এদেরকে দ্রুত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরাতে না পারলে ব্যাংক লুটেরাদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হবে না বলে তারা জানিয়েছেন।

গতকাল রোববার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রকাশিত আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, গত বছর শেষে ব্যাংক খাতের পুনঃতফসিলকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৮৮ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের ১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। গত পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৯ সালে ব্যাংকগুলো ৫২ হাজার ৩৭০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করে। পরের বছর ২০২০ সালে পুনঃতফসিল কম হয়। ওই বছর খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয় ১৯ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। ২০২১ সালে করা হয় ২৬ হাজার ৮১০ কোটি, ২০২২ সালে ৬৩ হাজার ৭২০ কোটি এবং ২০২৩ সালে ৯১ হাজার ২২১ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে পুনঃতফসিল ঋণ বেড়েছে ৪৩ দশমিক ১৫ শতাংশ।

গত বছর পুনঃতফসিল ঋণ অস্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাড় নীতি ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে দায়ী করা হচ্ছে। কারণ নির্বাচনে প্রার্থী হতে গত বছরের শেষ দিকে অনেক প্রার্থীই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত হন। এ ছাড়া বছর শেষে নিজেদের আর্থিক হিসাব ভালো দেখাতেও শেষ প্রান্তিকে অনেক খেলাপি গ্রাহকের ঋণ উদার হস্তে নবায়ন করে ব্যাংকগুলো।
গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী, প্রার্থীদের নামে খেলাপি ঋণ থাকলে তা মনোনয়নপত্র দাখিলের আগে নবায়ন বা পরিশোধ করতে হয়। আর যথাসময়ে ঋণ নবায়ন হলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থী নির্বাচনে যোগ্য বলে বিবেচিত হন, অন্যথায় প্রার্থী হতে পারেন না।
সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সে সময় বাছবিচার ছাড়াই বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। কারণ ২০২২ সালের জুলাইয়ে পলাতক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এসে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের পুরো ক্ষমতাই ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেন। সেই সাথে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের নীতিমালাও শিথিল করা হয়।

যেমন ঋণ নিয়মিত করতে তখন আড়াই থেকে সাড়ে চার শতাংশ অর্থ জমা দিলেই হয়, আগে যা ছিল ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। এসব ঋণ পরিশোধে গ্রাহকদের সুযোগ দেয়া হয়েছে পাঁচ থেকে আট বছর, যা আগে সর্বোচ্চ তিন বছর ছিল। এ ছাড়া বিশেষ বিবেচনায় কোনো খেলাপি ঋণ চারবার পর্যন্ত পুনঃতফসিলের সুযোগ রাখা হয়েছে, আগে তিনবারের বেশি পুনঃতফসিল করা যেত না। এ ছাড়া ব্যাংকের পর্ষদই এখন খেলাপি ঋণ নবায়নের সিদ্ধান্ত দিতে পারছে। আর ব্যাংকগুলোর হাতে ক্ষমতা যাওয়ায় খেলাপি ঋণ নবায়ন বেড়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে বারবার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলে ছাড় দেয়াটা ইতিবাচক কিছু বয়ে আনছে না। উল্টো যে ঋণগুলো পুনঃতফসিল মাধ্যমে নিয়মিত করা হচ্ছে, সেই ঋণ পরিশোধে টালবাহানায় আবার খেলাপি হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছর শেষে দেশের ব্যাংক খাতের পুনঃতফসিলকৃত ঋণের স্থিতি ছিল দুই লাখ ৮৮ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের ১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এর মধ্যে ১৮ দশমিক ৭০ শতাংশ ঋণ আবার খেলাপির খাতায় উঠেছে। ২০২২ সালে পুনঃতফসিলকৃত ঋণের স্থিতি ছিল দুই লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি, ২০২১ সালে এক লাখ ৬৮ হাজার ৩৯০ কোটি, ২০২০ সালে এক লাখ ৫৫ হাজার ৬৩০ কোটি এবং ২০১৯ সালে ছিল এক লাখ ৩৬ হাজার ২৩০ কোটি টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, জাতীয় নির্বাচনের কারণে ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেশি পুনঃতফসিল হয়েছে। কারণ আমাদের দেশের অনেক নেতাই ঋণখেলাপি। তাই নির্বাচনের আগে অনেক প্রার্থী ঋণ নবায়ন করেন। এর প্রভাবে পুরো বছরের চিত্র অস্বাভাবিক দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশের শিল্প উদ্যোক্তারা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ঋণ পুনঃতফসিল করেছেন। ২০২৩ সাল শেষে পুনঃতফসিলকৃত ঋণ স্থিতির ২৬ দশমিক ৪ শতাংশই ছিল শিল্প খাতের। দ্বিতীয় স্থানে ছিল বস্ত্র ও তৈরী পোশাক খাত। এ খাতের উদ্যোক্তারা ২০ দশমিক ৯ শতাংশ ঋণ পুনঃতফসিল করেছেন। এ ছাড়া পুনঃতফসিলকৃত ঋণের ১১ দশমিক ৩ শতাংশ চলতি মূলধন, ব্যবসায়িক ১১ শতাংশ, আমদানি ৮ দশমিক ৭ শতাংশ, ৬ দশমিক ৫ শতাংশ নির্মাণ, ৫ দশমিক ২ শতাংশ কৃষি খাতে এবং ৫ দশমিক ৫ শতাংশ অন্যান্য খাতে।
পুনঃতফসিলকৃত ঋণকে ‘স্ট্রেসড’ বা ‘দুর্দশাগ্রস্ত’ হিসেবে দেখায় আইএমএফ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বরে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৩৩ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। একই সময়ে পুনঃতফসিলকৃত ঋণের স্থিতি ছিল দুই লাখ ৮৮ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। আবার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আদায় অযোগ্য হওয়ায় ব্যাংকগুলো ৭১ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করেছে। সবমিলিয়ে গত বছরের শেষে ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের মোট পরিমাণ ছিল চার লাখ ৯৩ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা। ২০২৩ শেষে মোট অনাদায়ী ঋণ ছিল ১৫ লাখ ৩৮ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। সেই হিসাবে মোট ঋণের ৩২ দশমিক ১০ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ।

 


আরো সংবাদ



premium cement