৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৫ আশ্বিন ১৪৩১, ২৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপরে

-


ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার দুই সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এতে লালমনিরহাট, নীলফামারী জেলায় বন্যা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এসব জেলার নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ফসল ও রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে গেছে। শুধু লালমনিরহাটেই ৩০ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এদিকে পানি বৃদ্ধির সাথে তীব্র নদীভাঙন শুরু হয়েছে নীলফামারী জেলায়। মানুষের মধ্যে স্বস্তি নেই- আতঙ্ক বিরাজ করছে।
লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, উজানের পাহাড়ি ঢল আর কয়েক দিনের টানা ভারী বৃষ্টিতে তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ বেড়ে বিপদসীমার দুই সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। লালমনিরহাট হঠাৎ সৃষ্ট বন্যায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় ৩০ হাজার পরিবার।
গতকাল সকাল ৬টা হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানীতে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ১৭ মিটার, যা বিপদসীমার (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ১৫ মিটার) দুই সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
এর আগে গত শনিবার দুপুর থেকে বিপদসীমার কাছাকাছি প্রবাহিত হয়। ফলে নদীতীরবর্তী অঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। বামতীরের জেলা লালমনিরহাটের পাঁচটি উপজেলায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় ৩০ হাজার পরিবার। প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে এর সংখ্যা। আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে তিস্তাপাড়ের মানুষ।
বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র ও চরবাসী জানান, ভারতে সিকিমে উৎপত্তিস্থল থেকে ভারতে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। নদীর বাংলাদেশ অংশের উজানে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তা পানি নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি ফারাক্কা গেট খুলে বাংলাদেশ অংশে ছেড়ে দেয়া হয়। একই ভাবে শুষ্ক মৌসুমে গেট বন্ধ করে বাংলাদেশকে মরুভূমি করে তিস্তার পানি একক ব্যবহার করছে ভারত সরকার।

ভারতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হওয়ায় ভারত তাদের অতিরিক্ত পানি বাংলাদেশ অংশে ছেড়ে দেয়া। এই উজানের ঢল ও ভারী বর্ষণে তিস্তার পানি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। তাই বর্ষণ শুরু হলেই তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে রাখা হয় পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে। টানা কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টিতে তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ বেড়ে যায়। এতে তিস্তা নদীর ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার কাছাকাছি দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত শনিবার দুপুর ১২টায় পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ১০ মিটার, যা বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। বেলা বাড়ার সাথে পানিও বেড়ে যায়। রাতভর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। গতকাল সকাল ৬টায় ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ১৭ সেন্টিমিটার, যা বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে লালমনিরহাটের পাঁচটি উপজেলার নদীতীরবর্তী এলাকার প্রায় ২৫ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
নদীতীরবর্তী এলাকার বেশ কিছু রাস্তাঘাট ব্রিজ কালভার্ট ভেঙে গেছে পানির তোড়ে। উঠতি আমন ধান ও বিভিন্ন সবজি ডুবে আছে বন্যার পানিতে। দীর্ঘ সময় ডুবে থাকলে এসব ফসলের মারাত্মক ক্ষতির শঙ্কা করছেন চাষিরা। একই সাথে বন্যার পানির তোড়ে ভেসে গেছে বেশ কিছু পুকুরে মাছ। মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে সলেডি স্প্যার বাঁধসহ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো। শনিবার রাতভর সলেডি স্প্যার বাঁধ ২ এর ওপর দিয়ে অভার ফ্লো প্রবাহিত হয়। বাঁধ ভেসে যাওয়ায় শঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে ভাটিতে থাকা শত শত পরিবার। স্থানীয়রা রাতে বালুভর্তি বস্তা ফেলে রক্ষা করে।
নীলফামারী প্রতিনিধি জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত শনিবার রাত থেকে তিস্তা নদীর পানি নীলফামারীর ডালিয়া তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে বাড়তে থাকে এবং রোববার সকাল ৬টার পর থেকে বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি পরিমাপক নূরুল ইসলাম জানান গতকাল সকাল ৬টা থেকে তিস্তার পানি বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও ৮টার পর থেকে তিস্তার পানি কমতে শুরু করে এবং ৯টায় পানি কমে বিপদসীমার ১ সেন্টিমিটার এবং বিকেল ৩টা থেকে ৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। এদিকে পানির গতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে।

হঠাৎ করে তিস্তা নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় নদীতীরবর্তী ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার নিম্নাঞ্চলের বাড়িঘরে পানি উঠেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড নীলফামারীর ডালিয়া ডিভিশনের উপপ্রকৌশলী রাশেদীন জানান, উজানের ঢলে তিস্তার পানি ভোর থেকে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় ব্যারাজের সব ক’টি কপাট খুলে দেয়া হয়েছে ।
ডিমলা (নীলফামারী) সংবাদদাতা জানান, উজানে পাহাড়ি ঢল ও গত কয়দিনের ভারী বর্ষণের পর তিস্তাতীরের বাসিন্দারা নদীভাঙনের আশঙ্কায় দিশেহারা। গতকাল সকাল থেকে তিস্তা নদীর ডালিয়া পয়েন্টে পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে গতকাল সকাল ৯টায় বিপদসীমার ৫২ দশমিক ১৪ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। এর আগে গত রাত সাড়ে ১২টায় পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে ৫২ দশমিক ১৭ সেন্টিমিটার যা বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
এদিকে তিস্তার পানি কমায় ডিমলা উপজেলার গয়াবাড়ী, পশ্চিম ছাতনাই, পূর্ব ছাতনাই, খগাখড়িবাড়ী, টেপাখড়িবাড়ী, খালিশা চাপানী ও ঝুনাগাছ চাপানী ইউনিয়নের প্রায় ১০টি গ্রামসহ পানিবন্দী নিম্নাঞ্চলের প্রায় কয়েক হাজার মানুষ।

সরেজমিন দেখা যায়, উপজেলার ছোট খাতাটি বাঁধের বেশ কিছু স্থানে ধস দেখা দিয়েছে। তিস্তাপাড়ের চর ও নি¤œাঞ্চলে পানি প্রবেশে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় দুই হাজার ৫০০ মানুষ। আগাম শীতকালীন সবজি, বোরো ফসলের ক্ষেত ও চলাচলের সড়ক। ভেসে গেছে মাছের পুকুর-খামার। অনেকে গবাদিপশু নিয়েও নিদারুণ বিপাকে পড়েছেন। এছাড়াও টানা বৃষ্টিপাতে পানি বাড়ার ফলে উপজেলার সব নদ-নদীর পানির পাশাপাশি বিলের পানি বৃদ্ধিও অব্যাহত আছে। এতে রাস্তাঘাট ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে।
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি পরিমাপক নূরুল ইসলাম দৈনিক নয়া দিগন্তকে জানান, গতকাল সকাল ৯টা থেকে তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। এর আগে গত রাত ১১টায় তিস্তার ডালিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহের উচ্চতা রেকর্ড করা হয়েছে ৫২ দশমিক ১৭ সেন্টিমিটার। অর্থাৎ বিপদসীমার দশমিক ২ সেন্টিমিটার (বিপদসীমা ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার) ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হওয়া আপাতত বন্যার আশঙ্কা নেই।
বাইশ পুকুর এলাকার মমিনুর রহমান (২৭) নয়া দিগন্তকে বলেন, রাতে পানি বৃদ্ধি পর আমাদের বাড়িতে পানি উঠেছে। সকাল থেকে কিছুটা পানি কমতে শুরু করেছে। নদীর তীরবর্তী এলাকায় যেখানে ধস সৃষ্টি হয়েছে দ্রুত সংস্কার করতে হবে। তা ছাড়া ভাঙন তৈরি হবে। বর্তমানে ভাঙন আতঙ্কে সময় পার করছি।

 


আরো সংবাদ



premium cement