২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪ আশ্বিন ১৪৩১, ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

হাসান নাসরুল্লাহ নিহত

হাসান নাসরুল্লাহ নিহত -

- বৈরুতের রাস্তায় বাস্তুচ্যুত হাজারো মানুষ
- ইসরাইলি বিমানঘাঁটিতে হামলা তেল আবিবে বিস্ফোরণ
- ইরাকে ৩ দিনের শোক

লেবাননের প্রতিরোধ সংগঠন হিজবুল্লাহর প্রধান ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা হাসান নাসরুল্লাহ ইসরাইলি বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন। লেবাননের দক্ষিণ উপশহরে অবস্থিত হিজবুল্লাহর সদরদফতর লক্ষ্য করে গত শুক্রবার ভয়াবহ হামলা চালায় ইসরাইলের বিমানবাহিনী। এতে নাসরুল্লাহ নিহত হয়েছেন বলে গতকাল শনিবার ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) দাবি করে। পরে এক বিবৃতিতে হাসান নাসরুল্লাহ (৬৪) নিহত হওয়ার কথা নিশ্চিত করে হিজবুল্লাহ। এ ঘটনার পর ইসরাইলে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সেখানে এক হাজারের বেশি মানুষের জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ইসরাইলের বিমানঘাঁটিসহ তেলআবিবে দফায় দফায় বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। এ দিকে হিজবুল্লাহর প্রধানকে হত্যার নিন্দা জানিয়েছে বিভিন্ন দেশ। খবর আলজাজিরা, এএফপি, বিবিসি, আল-মায়েদিন, রয়টার্সের।
হিজবুল্লাহর বিবৃতিতে বলা হয়, ‘হিজবুল্লাহর সেক্রেটারি জেনারেল হাসান নাসরুল্লাহ সংগঠনটির মহান ও অমর শহীদদের সাথে যোগ দিয়েছেন; যাদের তিনি ৩০ বছর ধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন।’ রাজধানী বৈরুতসহ লেবাননের বিভিন্ন জায়গায় গত শুক্রবার রাতভর বিমান হামলা চালায় ইসরাইল। ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহর কমান্ড সেন্টারে হাসান নাসরুল্লাহ ও অন্য নেতাদের লক্ষ্য করে এসব হামলা চালানো হয়। এরপরই হামলাকারীদের তরফ থেকে নাসরুল্লাহ নিহত হওয়ার খবর জানানো হয়। তবে তাৎক্ষণিকভাবে হিজবুল্লাহ কিছু জানায়নি।
জানা গেছে, শুক্রবার বৈরুতে ইসরাইলি বিমান হামলায় ফেলা একেকটি বোমার ওজন ছিল এক টন। শুক্রবার রাত থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত হিজবুল্লাহর ১৪০টির বেশি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে তারা। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, শুক্রবার রাতে দক্ষিণ বৈরুতের হামলা ২০০৬ সালের যুদ্ধের পর সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল। বৈরুতে শুক্রবার বিমান হামলায় ইসরাইল কী ধরনের বোমা ব্যবহার করছে, সে বিষয়ে জানতে আলজাজিরার পক্ষ থেকে সামরিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইলিয়াস ম্যাগনিয়ার সাথে কথা বলা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে ইসরাইলি বিমানবাহিনীর দেয়া তথ্য আছে। বাহিনীটি বলছে, তারা ৮৫ টন বিস্ফোরক ব্যবহার করেছে। প্রতিটি বোমাই ছিল এক টন ওজনের। এসব বোমা হামলার ফলে বৈরুতে ভূমিকম্পের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।

হাসান নাসরুল্লাহর জন্ম ১৯৬০ সালে। বেড়ে উঠেছেন বৈরুতের পূর্বাঞ্চলীয় উপকণ্ঠের বুর্জ হামুদ এলাকায়। বাবা আবদুল করিম ছিলেন একজন সবজিবিক্রেতা। তার ৯ সন্তানের মধ্যে নাসরুল্লাহ ছিলেন সবার বড়। ১৯৯২ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সে হিজবুল্লাহর প্রধান হন তিনি।
জানা গেছে, শুক্রবারের ওই হামলায় নাসরুল্লাহর সাথে হিজবুল্লাহর সাউদার্ন ফ্রন্ট কমান্ডারও নিহত হয়েছেন। আইডিএফের চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল হারজি হালেভি এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, ‘এখানে বার্তা খুব পরিষ্কার। ইসরাইলি নাগরিকদের যারা হুমকি দেবে তাদের কিভাবে খুঁজে বের করতে হয়, সেটা আমরা জানি।’ আইডিএফ বলছে, দক্ষিণ বৈরুতে হিজবুল্লাহর জ্যেষ্ঠ নেতারা যখন বৈঠক করছিলেন তখন সেখানে হামলা চালানো হয়। দক্ষিণ বৈরুতের এ জায়গাটি হিজবুল্লাহর একটি শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত।
এ দিকে হিজবুল্লাহ প্রধান নাসরুল্লাহ হত্যায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। এ সময় তিনি বিশ্বের সব মুসলমানকে ইসরাইলকে মোকাবিলার আহ্বান জানিয়েছেন। লেবাননের জনগণ এবং হিজবুল্লাহর পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ করে খামেনি বলেছেন, জায়নবাদীদের জানা উচিত যে লেবাননে হিজবুল্লাহর মজবুত ভিত্তির বড় কোনো ক্ষতি করার যোগ্যতা তাদের নেই। এই অঞ্চলের সব প্রতিরোধী শক্তি হিজবুল্লাহর পাশে আছে এবং সমর্থন করবে। এই অঞ্চলের ভাগ্য নির্ধারণ করবে ইরানের ‘প্রতিরোধী শক্তি’। আর তাদের নেতৃত্বে থাকবে হিজবুল্লাহ।
এর আগে হিজবুল্লাহর প্রধানকে হত্যা করা হয়েছে- এমন খবর জানার পরই আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে দেশের ভেতরে একটি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়। তেহরানের সর্বশেষ খবর সম্পর্কে অবগত দু’জন আঞ্চলিক কর্মকর্তা রয়টার্সকে এ তথ্য জানিয়েছেন। সূত্রগুলো জানিয়েছে, ইসরাইলের হাতে হিজবুল্লাহর প্রধান নিহত হওয়ার খবর জানার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করতে ইরান হিজবুল্লাহ ও ওই অঞ্চলটিতে সক্রিয় অন্য ইসরাইলবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর (ইরানের সহায়তাপুষ্ট) সাথে নিবিড় যোগাযোগ রাখছে।

এ দিকে লেবাননের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফিরাস আবিয়াদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, গত শুক্রবার ইসরাইলি হামলায় আরো ১১ জন নিহত এবং ১০৮ জন আহত হয়েছে। গত সোমবার লেবাননে ইসরাইল হামলা জোরদার করার পর থেকে ৭০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।
অন্য দিকে বৈরুতে ইসরাইলি বিমান হামলায় হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হওয়ার বিষয় নিশ্চিত হওয়ার পর ইরাকের প্রধানমন্ত্রী শিয়া আল-সুদানি দেশজুড়ে তিন দিনের শোক ঘোষণা করেছেন। তা ছাড়া ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস নাসরুল্লাহকে হত্যার নিন্দা জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘আমরা আমাদের আন্তরিক সমবেদনা, সহানুভূতি ও সংহতি জানাচ্ছি ভ্রাতৃপ্রতিম লেবাননের জনগণ এবং হিজবুল্লাহর ভাইদের ও লেবাননের ইসলামী প্রতিরোধের প্রতি।’ এ ছাড়া বামপন্থী ফরাসি রাজনীতিবিদ এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রাক্তন সদস্য জিন-লুক মেলেনচন এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের সাথে জড়িত হয়ে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করছেন।

বৈরুতের রাস্তায় হাজারো মানুষ : লেবাননের বেকা ভ্যালিতে হামলা জোরদার করেছে ইসরাইল। প্রাণ বাঁচাতে দক্ষিণ লেবানন থেকে হাজার হাজার মানুষ বৈরুতে পালিয়ে এসেছেন। বৈরুতের সড়কগুলো এখন পালিয়ে আসা মানুষদের অস্থায়ী আশ্রয়শিবিরে পরিণত হয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিসি। লেবাননে জাতিসঙ্ঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের উপপ্রধান ইটি হিগিন্স বিবিসি রেডিও ফোরকে বলেছেন, হাজারো মানুষ বৈরুতের দক্ষিণের শহরগুলো ছেড়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ পার্কে, রাস্তায় অথবা গাড়ির ভেতর ঘুমাচ্ছেন। শিশুরা ‘ভয়াবহ আতঙ্কগ্রস্ত’ হয়ে আছে বলেও জানান ইটি হিগিন্স। তিনি বলেন, কখনো কখনো রাত ৩টার সময়ও বাড়িঘর ছাড়ার নির্দেশ আসে। বাস্তুহারা এই সব মানুষকে সহায়তা করতে ইউনিসেফ আশ্রয়শিবির পরিচালনা করছে। ইটি হিগিন্স বলেন, পানি, খাবার, কাপড় থেকে শুরু করে তাদের সবকিছুরই খুবই প্রয়োজন এবং অতি অবশ্যই একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই। পালিয়ে আসা মানুষদের মধ্যে এমন শিশুও রয়েছে, যাদের সাথে কেউ নেই। তাদের পরিবারের বাকি সদস্যরা হয় মারা গেছেন কিংবা পরিবার থেকে ওই সব শিশু কোনোভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এই কর্মকর্তা এমন একটি শিশুকে খুঁজে পাওয়ার কথা জানিয়েছেন যে শিশুটির পরিবারের বাকি ১৫ সদস্য নিহত হয়েছেন।
সিরিয়ায় ৩০ হাজার লেবাননী : অন্য দিকে ইসরাইলি হামলা থেকে বাঁচতে গত তিন দিনে লেবানন ছেড়ে সিরিয়ায় পাড়ি দিয়েছেন ৩০ হাজারের বেশি মানুষ। জাতিসঙ্ঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে আলজাজিরা। শুক্রবার সংস্থাটি বলেছে, ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে ইসরাইলের সাথে হিজবুল্লাহর সঙ্ঘাতে ৯০ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। সিরিয়ায় নিযুক্ত জাতিসঙ্ঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার প্রতিনিধি গনজালো ভারগাস লোসা বলেন, সিরিয়ায় আশ্রয় নেয়াদের মধ্যে ৮০ শতাংশই সিরিয়ার নাগরিক এবং ২০ শতাংশ লেবানিস।

হিজবুল্লাহর পাল্টা হামলা : এ দিকে হিজবুল্লাহ অত্যাধুনিক রকেট ফাদি-৩ দিয়ে ইসরাইলের রামাত ডেভিড বিমানঘাঁটি ও বিমানবন্দরসহ বেশ কয়েকটি লক্ষ্যবস্তুতে সিরিজ হামলা শুরু করেছে বলে জানিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-মায়েদিন। লেবাননে ইসলামিক প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহ গতকাল শনিবার আরো জানিয়েছে, মধ্য ইসরাইলে কাবরী এলাকায় ফাদি-১ রকেট দিয়ে হামলা করেছে। ইসরাইলি মিডিয়া হাইফার উত্তর-পূর্বে এবং পূর্ব, পশ্চিম ও মধ্য আলজলিল এলাকাজুড়ে অসংখ্য বসতিতে সাইরেন বেজে যাওয়ার খবর জানিয়েছে।
অন্য দিকে ইসরাইলের সরকার নিরাপত্তার জন্য জনগণকে সতর্ক করে দেশটিতে এক হাজারের বেশি মানুষের জমায়েতকে নিষিদ্ধ করেছে। দেশটির সেনাবাহিনী জানিয়েছে যে, তারা আলজলিলের ওপর লেবানন থেকে উৎক্ষেপণ করা ১০টি রকেট শনাক্ত করেছে এবং তাদের বাধা দেয়ার জন্য ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করেছে। এ ছাড়া অধিকৃত ফিলিস্তিনে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে ইসরাইলের শতাধিক শহর এবং বসতিতে সাইরেন বেজে উঠেছে, ১০ লাখেররও বেশি ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারী আশ্রয়কেন্দ্রে লুকিয়ে আছে। আলজাজিরার এক খবরে বলা হয়েছে, লেবাননে হামলার পরই পাল্টা হামলা হিসেবে তেলআবিবের বিভিন্ন স্থানে দফায় দফায় হামলা চালানো হয়েছে। লেবানন থেকে মধ্য ইসরাইলের দিকে ছোড়া একটি ক্ষেপণাস্ত্র খোলা জায়গায় গিয়ে পড়েছে বলে ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলেও জানানো হয়েছে।




আরো সংবাদ



premium cement