২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১, ২০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণ হলে রাজনৈতিক দল ১০ বছর নিষিদ্ধের প্রস্তাব

প্রতিহিংসা নয় আমরা সুবিচার নিশ্চিত করতে চাই : আইন উপদেষ্টা
-


আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩’ সংশোধনে আটটি খসড়া সংশোধনী প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে। গতকাল সোমবার বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে এক মতবিনিময় সভায় এ প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। খসড়া সংশোধনীতে এ আইনের ৪এ, ১৩এ ও ২০এ নামে ৩টি নতুন ধারা এবং ৩(৩) ও ১২(২) নামে ২টি নতুন উপধারা যুক্ত করা হয়। এ ছাড়া ধারা ৩(২)(এ), ৪(২) ও ১৯ ধারায় সংশোধন আনার প্রস্তাব করা হয়। এ ছাড়া খসড়া সংশোধনীর প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘কোনো রাজনৈতিক দল যদি এ আইনের অধীন কোনো অপরাধ করে তাহলে সে দলকে ১০ বছর পর্যন্ত নিষিদ্ধ করার বিধান রাখা হয়েছে।’
গতকাল আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের সভাপতিত্বে বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩’ সংশোধনবিষয়ক মতবিনিময় সভায় এ আইনের প্রস্তাবিত খসড়া সংশোধনী উপস্থাপন করা হয়।
মতবিনিময় সভায় ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, আমরা প্রথম দিন থেকে বলছি এখানে প্রতিশোধ বা কোন প্রতিহিংসা, এটা না। আমরা সুবিচার চাই। আমরা সুবিচার নিশ্চিত করতে চাই। তিনি বলেন, আপনারা নিজের চোখে দেখেছেন কি ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। আমরা কখনো বিশ্বাস করতে পারতাম না যে একটা দেশের একটি বৃদ্ধ প্রজন্ম দেশের একটি তরুণ প্রজন্মকে উন্মত্তভাবে খুনের নেশায় নেমেছিল। আমাদের চোখের সামনে সব দেখেছি। যত বেদনা বুকের ভিতর থাক, যত ক্ষোভ বুকের ভেতর থাক, আমরা এই চ্যালেঞ্জটা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন আছি যে আমাদের এই বিচারটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। আমার বুকের ভিতর যত কষ্ট থাক, যত ক্ষোভ থাকুক, যত ক্রন্দন থাকুক বিচারটাকে অবশ্যই আমাদের সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। আমরা সচেতন আছি। আমরা সচেতন আছি এ দেশে বিচারের নামে কী ধরনের অবিচার হয়েছে অতীতে। আমরা সব কিছু জানি। এজন্য আমরা সচেতন আছি যে এটার প্রতিফলন আমাদের বিচারকার্যের মধ্য দিয়ে দেখবেন। আমরা চেষ্টা করব আন্তর্জাতিক বিশে^র কাছে এবং বাংলাদেশের প্রতিটা মানুষের কাছে এই বিচার গ্রহণযোগ্য হয়। যেসব নেতা বা যেসব ব্যক্তি এখানে বিচারকার্যে সম্মুখীন হবে তাদের যারা সমর্থক আছে তাদেরও যাতে মনে হয়, হ্যাঁ সত্যি উনি অন্যায় করেছেন বা অন্যায় করেন নাই। তারাও যেন কনভিন্স থাকে।
ড. আসিফ নজরুল আরো বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমকে সচল করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে প্রসিকিউশন ও ইনভেস্টিগেশন টিম গঠন করা হয়েছে। এখন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আদালতকে (ট্রাইব্যুনাল) পুনর্গঠন করা। কারণ ট্রাইব্যুনালে এখন কোনো বিচারক নেই। আমরা এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি। আমাদের সংস্কার কার্যক্রম এখানেই থেমে থাকবে না। যারা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তাদের সবার মতামত নিয়ে এই আইন সংশোধন করা হবে। তিনি বলেন, আমরা মনে করি আমাদের সক্ষমতা আছে বিচার করার। আর প্রথমে যদি বলি আমাদের সক্ষমতা নেই তাহলে বিচার বিভাগকে ছোট করা হয়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনে ৮ প্রস্তাব : প্রস্তাবিত খসড়া সংশোধনীতে ৪এ, ১৩এ ও ২০এ নামে ৩টি নতুন ধারা এবং ৩(৩) ও ১২(২) নামে ২টি নতুন উপধারা যুক্ত করা হয়। এ ছাড়া ধারা ৩(২)(এ), ৪(২) ও ১৯ ধারায় সংশোধন আনার প্রস্তাব করা হয়।
১ম সংশোধনটি ধারা-৩ সংক্রান্ত। এ সংশোধনীর মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞায় একটি ব্যাপক ও সিস্টেমেটিক আক্রমণের অংশ হিসেবে গুম, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, যৌন দাসত্ব, জোরপূর্বক যৌনকর্ম, জোরপূর্বক গর্ভধারণ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীর কারণে জেন্ডার ও কালচারাল গ্রাউন্ডেও যদি কোনো সিভিলিয়ানের ওপর ব্যাপক ও সিস্টেমেটিক আক্রমণ করা হয় তাহলে তা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, যা পূর্বের আইনে ছিল না।
২য় সংশোধনী ধারা- ৩(৩) সংক্রান্ত। এ সংশোধনীর ফলে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ইত্যাদি অপরাধের দায় বা লায়াবিলিটি নির্ধারণ করতে ট্রাইব্যুনাল রোম স্ট্যাটিউটের ধারা ৯ অনুযায়ী গৃহীত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) এর এলিমেনটস অব ক্রাইম বিবেচনা করার সুযোগ পাবে।
৩য় সংশোধনী ধারা-৪ (২) সংক্রান্ত। এ সংশোধনীর ফলে এ আইনের অধীনে অপরাধ হতে পারে এটি জানা সত্ত্বেও যদি কোনো সংস্থা, সংগঠন, দল, সংঘবদ্ধ চক্র বা সত্তার নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয় তাকেও বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হবে, যা বর্তমান বিধান অনুসারে সম্ভব নয়।
৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের বিচারকার্যের ভিডিও স্ট্রিমিং বা ওডিও-ভিজ্যুয়াল রেকর্ডিংয়ের সুযোগ রাখা হয়েছে। এ সংশোধনীর বুনিয়াদে বিচার কার্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিতে ট্রাইব্যুনাল চাইলে শুনানি সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবে।
৫ম সংশোধনী প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে অভিযুক্ত চাইলে তার পক্ষে বিদেশী আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবে।

৬ষ্ঠ সংশোধনী- বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতাকে ত্বরান্বিত করবে। এ সংশোধনীর অধীনে ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষক আদালতের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে পারবে।
৭ম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রায় সব রকম ডিজিটাল সাক্ষ্যকে এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে সাক্ষ্যগ্রহণ পক্রিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক দল যদি এ আইনের অধীন কোনো অপরাধ করে তাহলে সে দলকে ১০ বছর পর্যন্ত নিষিদ্ধ করার বিধান রাখা হয়েছে।
আইনটির প্রস্তাবিত সংশোধনী নিয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন, সমবায় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়বিষয়ক উপদেষ্টা এ. এফ. হাসান আরিফ, শিল্প, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বিষয়ক উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল মোঃ আসাদুজ্জামান, আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো: গোলাম রব্বানী, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সচিব (চলতি দায়িত্ব) ড. হাফিজ আহমেদ চৌধুরী, নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. বদিউল আলম মজুমদার, সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ ইকতেদার আহমেদ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম, সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান ও অধ্যাপক নাজমুজ্জামান ভূঁইয়া, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. বেগম আসমা সিদ্দীকা, রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের যুগ্ম-সচিব (ড্রাফটিং) মো: রফিকুল হাসান, ঢাকাস্থ জাতিসঙ্ঘের আবাসিক সমন্বয়কারী অফিসের কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন, সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান, আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, সোস্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট ড. জাহেদুর রহমান, সাংবাদিক সাঈদ আব্দুল্লাহ, সানজিদা ইসলাম, শরিফ ভূঁইয়া প্রমুখ নিজ নিজ মতামত তুলে ধরেন।

সভায় উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, বিচারটা এমন একটা বিষয়, এক দিকে প্রসিকিউশন থাকে, অন্য দিকে ডিফেন্স থাকে। সামগ্রিকভাবে বিচারটা কেমন হচ্ছে দেশের মানুষও এটা দেখে। তিনি বলেন, আমরা এটা নিশ্চিত করতে চাচ্ছি পারপ্রিটেটাসরা যেভাবে বিচার করেছে তার বাইরে সত্যিকারার্থে যেভাবে বিচার হওয়া উচিত সেভাবেই বিচার করা। ভিকটিম ফ্যামিলিগুলোও সেটা চায়। সবার একটাই কথা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। সেই লক্ষ্য নিয়েই আজকে আমরা একত্র হয়েছি।
অ্যাটর্নি জেনারেল মো: আসাদুজ্জামান বলেন, যে সংশোধনী প্রস্তাবটি দেখলাম আমরা মনে হয়েছে, এটি একটি গুড ইনটেনশন নিয়ে করা হয়েছে। আসামিদের স্বার্থ ও অধিকার সংরক্ষণের দিকে বেশি ফোকাস করা হয়েছে। আসামিদের পাশাপাশি প্রসিকিউশনের পক্ষেও বিদেশী আইনজীবী রাখার প্রস্তাবনা এসেছে এখানে। তিনি বলেন, অনেক সময় আমরা দেখি প্রসিকিউশন টিমও ভেন্ডওভার/গেন্ডওবার হয়ে যায়। এ জন্য আমার প্রস্তাব হচ্ছে, প্রসিকিউশনের পাশাপাশি ভিকটিমের পরিবারের পক্ষ থেকেও আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ আইনে রাখা যায়। এতে ভিকটিমের পরিবারের ন্যায়বিচারপ্রাপ্তি নিশ্চয়তা আসবে বলে আমি মনে করি।
ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, ট্রাইব্যুনাল নিয়ে এর আগে যত সমালোচনা হয়েছে, সবাই মনে করেছে একাত্তরের গণহত্যার বিচার হওয়া উচিত। এখন যেভাবে সবাই মনে করছে যে, এই আন্দোলনে যারা বিভিন্ন ঘটনার শিকার হয়েছেন, তাদের বিচার পাওয়া উচিত। এখন আমরা যে সেন্টিমেন্ট দেখছি, ভুক্তোভোগীদের বিচার পেতে হবে। আমাদের একটু অন্যভাবে বিষয়টা ভাবতে হবে। যারা অভিযুক্ত হবে তারাও যাতে ন্যায়বিচার পায়। উন্মুক্ত বিচারের যে ব্যবস্থা রাখার যে প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে- সেটাকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। তিনি বলেন, আমরা যদি সর্বশেষ আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করার চেষ্টা করি তাহলে কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়েছে কবে তা আমাদের খুঁজে দেখতে হবে। আমার ধারণা খুঁজে পাওয়া যাবে না।
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ধারা ২০ এ রাজনৈতিক দল বা সংগঠনকে নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে। এখান প্রশ্ন হচ্ছে, এই নিষিদ্ধ কি শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ একটিভিটিসকে নিষিদ্ধ করবেন, নাকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নিষিদ্ধ করা হবে। কারণ হচ্ছে, সারা পৃথিবীতেই রাজনৈতিক দলগুলোর কমিটি রয়েছে। দেশে নিষিদ্ধ হলে দেশের বাইরে কার্যক্রম চালছে, সে ক্ষেত্রে নিষিদ্ধের এলাকা কোনটা হবে- এটা ঠিক করা হবে কিভাবে?
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ট্রাইব্যুনালে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা হবে।


আরো সংবাদ



premium cement