২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১, ২০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`
গাজীপুরে অস্থিরতা চলছেই

আশুলিয়ায় ফের শ্রমিক বিক্ষোভ ৫২ কারখানা বন্ধ

-


বেশ কয়েক দিন শান্ত থাকার পর ফের শ্রমিক বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে শিল্পাঞ্চলখ্যাত ঢাকার আশুলিয়ায়। বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতে গতকাল সেখানে একটি তৈরী পোশাক কারখানার শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন। এ ছাড়া নতুন করে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়ায় গতকাল ৫২টি শিল্প-পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। যার মধ্যে ৪৩টি কারখানা শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় বন্ধ রয়েছে এবং ৯টিতে সাধারণ ছুটি দেয়া হয়েছে।
গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়কের নরসিংহপুর এলাকায় জেনারেশন নেক্সট গার্মেন্টের কয়েক হাজার শ্রমিক সড়ক অবরোধ করেন। তারা জানান, অনেক কারখানায় যখন টিফিন বিল, নাইট বিল, হাজিরা বোনাস বাড়ানোসহ নানা দাবিতে আন্দোলন চলছিল তখন আমাদের কোনো দাবি ছিল না। অন্য কারখানার শ্রমিকরা এসে আমাদের ফ্যাক্টরিতে ঝামেলা করার চেষ্টা করলেও আমরা কাজ করেছি। তারপরও আমাদের মালিক কেন এখন কারখানা বন্ধ করে রাখছে? গত দুই মাস (গত মাসসহ চলতি মাসের) আমাদের বেতন পরিশোধ করা হয়নি। ফলে আমরা বাসা ভাড়া ও দোকানের বাকি টাকাও পরিশোধ করতে পারিনি। আমরা প্রায় ৫-৬ হাজার শ্রমিক চরম অসহায় ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দিন পার করছি। আমরা গরিব বলেই তো কারখানায় কাজ করতে এসেছি। এর আগে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের পাওনা পরিশোধের আশ্বাস দেয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। তাই আজ (২৩ সেপ্টেম্বর) বাধ্য হয়ে আমরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছি। এখন প্রশাসনের লোক এসে বলছে আমরা সড়ক ছেড়ে না দিলে তারা কঠোর হতে বাধ্য হবে। তাহলে আমরা এখন কোথায় যাবো?

জানা গেছে, নতুন করে শ্রমিক বিক্ষোভের জেরে সোমবার শিল্পাঞ্চলের ৫২টি কারখানা বন্ধ ছিল। যার মধ্যে ৪৩টি শ্রম আইন ২০০৬ এর ১৩ (১) ধারায় অনির্দিষ্টকালের জন্য এবং ৯টিতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।
হা-মীম গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠানের গেটে দেয়া নোটিশে বলা হয়, দ্যাটস ইট স্পোর্টস ওয়ার লিমিটেড, এ্যাপারেল গ্যালারি লিমিটেড, রিফাত গার্মেন্ট লিমিটেড, এক্সপ্রেস ওয়াশিং অ্যান্ড ডাইং লিমিটেড, আর্টিস্টিক ডিজাইন লিমিটেড, নেক্সট কালেকশন লিমিটেডের সব কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকদের জানানো যাচ্ছে যে, আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের বর্তমান সহিংসতা ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিবেচনায় শ্রমিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারা ১৩ (১) অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ২৩ সেপ্টেম্বর সোমবার হতে উল্লেখিত কারখানাগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হলো।
পরবর্তীতে আঞ্চলিক পরিবেশ নিরাপদ হলে শ্রমিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কর্মপরিবেশ ও নিরপত্তা নিশ্চিত করে নোটিশের মাধ্যমে কারখানা খোলার তারিখ জানিয়ে দেয়া হবে। তবে কারখানার নিরাপত্তা বিভাগ এই নোটিশের আওতামুক্ত থাকবে।
এ দিকে অনন্ত গ্রুপের একটি কারখানার মূল ফটকেও একই ধরনের নোটিশ টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে।
আশুলিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক বলেন, সকালে নরসিংহপুর এলাকায় একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। পরে ঘটনাস্থলে পুলিশের টিম পাঠানো হয়। এ ছাড়া ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে আছেন।
শিল্প পুলিশ-১ এর সুপার সারোয়ার আলম বলেন, আজ (২৩ সেপ্টেম্বর) শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় ৫২টি কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় বন্ধ রয়েছে ৪৩টি পোশাক কারখানা। বাকিগুলো সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বিভিন্ন পয়েন্টে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন।

গাজীপুরে অস্থিরতা চলছেই
গাজীপুর জেলা প্রতিনিধি জানান, গাজীপুরের পোশাক শিল্পসহ বিভিন্ন কারখানায় নানা দাবিতে অস্থিরতা চলছেই। সোমবারও জেলার বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা বেতনভাতা ও হাজিরা বোনাস বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন দাবিতে কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ করেছে। এ সময় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা পৃথকভাবে ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক কয়েক ঘণ্টা অবরোধ করে রাখে। এতে মহাসড়কে যানবাহন আটকা পড়ে অসহনীয় ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রী সাধারণরা। খবর পেয়ে শিল্প পুলিশ, জয়দেবপুর থানা পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে কালিয়াকৈরের তিন কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। কারখানায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ঘটনায় কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে।
পুলিশ, আন্দোলনরত শ্রমিক ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুর সদর উপজেলার বাঘের বাজার এলাকায় গোল্ডেন রিফিট গার্মেন্টের শ্রমিকরা তাদের বকেয়া বেতন পরিশোধ, হাজিরা বোনাস ও নাইট বিল বৃদ্ধি, টিফিনের মান উন্নতসহ ১২ দফা বাস্তবায়নের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে গত কয়েক দিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিল। ওই দাবি মেনে না নেয়ায় সোমবার সকালে শ্রমিকরা কারখানায় এসে কাজে যোগ না দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা মিছিল সহকারে কারখানার পার্শ্ববর্তী ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ওপর এসে অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে। এ সময় ওই মহাসড়কের উভয়দিকে সর্বপ্রকার যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে শ্রমিকদের শান্ত রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু শ্রমিকরা তাদের দাবিতে অনঢ় থাকেন। পরে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে মালিকপক্ষের সাথে আলোচনা করে শ্রমিকদের প্রায় সব ক’টি দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দিলে দুপুর ১২টার দিকে শ্রমিকরা সড়কের অবরোধ প্রত্যাহার করলে যানবাহন চলাচল শুরু হয়।
এ দিকে একই দিন সকালে মহানগরীর দক্ষিণ সালনা এলাকার এইচআরওয়ান ফ্যাশন কারখানার শ্রমিকরা দুই মাসের বকেয়া বেতনভাতা পরিশোধের দাবিতে কারখানার সামনে বিক্ষোভ করে। পরে তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে শ্রমিকদের বুঝিয়ে সড়কের ওপর থেকে সরিয়ে দিলে প্রায় দুই ঘণ্টা পর বেলা ১১টার যানবাহন চলাচল শুরু হয়।
এ ছাড়াও টঙ্গীতে বকেয়া বেতনসহ বিভিন্ন দাবিতে সিজন্স ড্রেসেস লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা ফের সোমবারেও বিক্ষোভ ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেছে। এতে মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাত্রী, পথচারী ও এলাকাবাসীর দুর্ভোগে পোহাতে হয়। সকাল ৯টা থেকে টঙ্গীর সাতাইশ খাঁপাড়া এলাকায় এশিয়া পাম্পের সামনে মহাসড়কে তারা এ বিক্ষোভ করে।

এ ছাড়াও টঙ্গীর বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা গত কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন ও বিক্ষোভ করে আসছিল। দাবি মেনে না নেয়ায় রোববার বিকেলে কারখানা ছুটির আগ মুহূর্তে কারখানার গেটে তালা লাগিয়ে দেন শ্রমিকরা। এতে কারখানার ভেতরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। খবর পেয়ে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও বিজিবির সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে শ্রমিকদের বুঝিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন। কিন্তু আন্দোলনরতরা তাদের দাবিতে অনঢ় থাকে। একপর্যায়ে রোববার রাত পৌনে ১২টার দিকে আন্দোলনরতদের ছত্রভঙ্গ করে অবরুদ্ধ কর্মকর্তা কর্মচারীদের উদ্ধার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন তারা। এ সময় উসকানি দেয়ার অভিযোগে ১৮ জনকে আটক করা হয়।
প্রায় একই দাবিতে টঙ্গীর চেরাগআলী মার্কেট এলাকার নোভিস্তা ফার্মাসিউটিক্যালস কারখানার শ্রমিকরা রোববার সকাল থেকে বিক্ষোভ শুরু করে। দাবি মেনে না নেয়ায় ওই দিন বিকেলে তারা কারখানা ছুটির সময় কারখানার গেটে তালা লাগিয়ে কর্মকর্তা কর্মচারীদের অবরুদ্ধ করে রাখেন। এ সময় তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক কয়েক ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন। খবর পেয়ে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও বিজিবির সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে শ্রমিকদের বুঝিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলে আন্দোলনরতরা তাদের দাবিতে অনড় থাকে। একপর্যায়ে আন্দোলনরতদের ছত্রভঙ্গ করে অবরুদ্ধ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্ধার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এ ঘটনার পরদিন গতকাল সোমবারেও সকাল থেকে ওই কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ শুরু করে। একপর্যায়ে তারা কারখানার পাশে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ওপর অবস্থান নিয়ে অবরোধ করে। এতে যানবাহন আটকা পড়ে মহাসড়কে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। খবর পেয়ে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
অপর দিকে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক এলাকায় খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কোকোলা ফুড প্রোডাক্ট লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা ১২ দফা দাবিতে সোমবার সকালে বিক্ষোভ শুরু করে। একপর্যায়ে তারা কারখানার সামনে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে। এতে কিছু শ্রমিক কারখানায় প্রবেশ করে ভাঙচুরের চেষ্টা চালায়। এ ঘটনায় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে শ্রমিকদের সড়ক থেকে সরিয়ে প্রায় আধা ঘণ্টা পর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে যানবাহন চলাচল শুরু হয়। এ সময় কারখানার ভেতরে অবৈধভাবে প্রবেশ, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং কারখানা ভাঙচুর চেষ্টার অভিযোগে তিনজনকে আটক করা হয়।

 


আরো সংবাদ



premium cement