২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

বিচারকদের স্বাধীনতা নিশ্চিতে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে : প্রধান বিচারপতি

-

প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন, একটি ন্যায়ভিত্তিক বিচারব্যবস্থার কাজ হলো নিরপেক্ষভাবে স্বল্প সময় ও কম খরচে বিরোধের মীমাংসা নিশ্চিত করে জনগণ, সমাজ, রাষ্ট্রকে সুরক্ষা দেয়া। এ জন্য বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা থেকে পৃথক ও স্বাধীন করা সবচেয়ে জরুরি। কেননা শাসকের আইন নয়; বরং আইনের শাসন নিশ্চিত করাই বিচার বিভাগের মূল দায়িত্ব। গতকাল শনিবার দেশের অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে অভিভাষণে এ কথা বলেন প্রধান বিচারপতি।
তিনি বলেন, বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার স্বার্থে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এখন আবশ্যক। দেশের সংবিধানের ১১৬ক অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতের বিচারকরা বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন বলে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বিচারকদের প্রকৃত স্বাধীনতা ততদিন পর্যন্ত নিশ্চিত হবে না, যতদিন না বিচার বিভাগে দীর্ঘ দিন ধরে বিরাজমান দ্বৈত শাসনব্যবস্থা অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ এখতিয়ার সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে জরুরি ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। এটিই হবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকল্পে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রথম ধাপ। তিনি বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের মতো বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তাব প্রস্তুত করে আমরা শিগগিরই আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করব। এই প্রস্তাব দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য আমি প্রধান উপদেষ্টা ও আইন উপদেষ্টার সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের ইনার গার্ডেনে এই অভিভাষণের আয়োজন করা হয়। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, কোনো সন্দেহ নেই যে, বিদ্যমান সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রধান সমস্যা হচ্ছে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ কার্যকররূপে পৃথক না হওয়া। এর কুফল আমরা সবাই ভোগ করছিলাম দেড় দশক ধরে। এ ছাড়া আছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব। মামলা অনুপাতে বিচারকের নিদারুণ স্বল্পতা, বার ও বেঞ্চের মধ্যে মনোভাবের ঘাটতি, আদালতগুলোর অবকাঠামোগত সঙ্কট, অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য নীতিমালা না থাকা। উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ ও স্থায়ীকরণের ক্ষেত্রে কোনো আইন না থাকা এবং প্রথাগত জ্যেষ্ঠতার নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন ইত্যাদি বিষয়গুলো আমাদের বারবার পিছিয়ে দিয়েছে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, বিগত বছরগুলোতে বিচার বিভাগের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। ন্যায়বিচারের মূল্যবোধকে বিনষ্ট ও বিকৃত করা হয়েছে। শঠতা, বঞ্চনা, নিপীড়ন ও নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে বিচার বিভাগকে ব্যবহার করার চেষ্টা করা হয়েছে। এতে বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থার সঙ্কট তৈরি হয়েছে। অথচ বিচার বিভাগের সবচেয়ে শক্তির জায়গা হচ্ছে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস। তাই নতুন এই বাংলাদেশে আমরা এমন একটা বিচার বিভাগ গড়তে চাই, যেটি সততা ও অধিকারবোধের নিশ্চয়তার একটি নিরাপদ দুর্গে পরিণত হবে।
অভিভাষণে প্রধান বিচারপতি বলেন, বর্তমানে বিচারকদের পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো ঘোষিত নীতিমালা নেই। ফলে পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনেকসময়ই বিচারকরা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। এ বিষয়ে যথোপযুক্ত নীতিমালা দ্রুত প্রণয়ন করব। শুধু বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করলেই হবে না, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা হিসেবে সংবিধানের ৯৫(২) অনুচ্ছেদে যে বিধান রয়েছে কেবল সেটুকু নিশ্চিত করে বিচারক নিয়োগের ফলে সুপ্রিম কোর্টে এক অভূতপূর্ব অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হিসেবে পালন করেছে। এটি ন্যায়বিচারের ধারণার সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।
আমরা প্রকৃত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চাই : আইন উপদেষ্টা
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, আমরা প্রকৃত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চাই। আমরা ঢালাও মামলা, বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে মানুষকে হয়রানি করা, মানুষের জীবন জীবিকাকে নিশ্চিহ্ন করা, মানুষের মধ্যে ক্রমাগত ক্ষত, ক্রোধ, কোন্দল সৃষ্টি করা থেকে বের হতে চাই।
হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকদের উদ্দেশে ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘বিচারপতিদের কাছে মানুষ বিচার চাইতে আসে। তারা বিব্রত বোধ করেন। কেন বিব্রত বোধ করেন আপনি? বিব্রত বোধ করবেন তখন যখন আপনার ভাইবোন বিচার চাইতে আসে। বিচারপ্রার্থী মানুষ কোথাও বিচার না পেয়ে আপনার কাছে এসেছে। আপনি কিভাবে বিব্রত বোধ করেন?’
আইন উপদেষ্টা আরো বলেন, আপনারা বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের আরজি গ্রহণ করতে বিব্রত বোধ করেছিলেন। কেন করেছিলেন? আপনার এটা দায়িত্ব না? আপনার এটা সাংবিধানিক দায়িত্ব না? আপনি শুনে (শুনানি গ্রহণ করে) রিজেক্ট করে দেন। সমস্যা নেই। আপনি শুনবেনই না। আপনাদের সুনাম কিছু বিচারপতির কারণে ক্ষুণœ হয়েছে। এগুলো আর করবেন না। মানুষ বোকা না। মানুষের বিচার-বুদ্ধি আছে। তিনি আরো বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকার গায়েবি মামলা ও ঢালাও মামলার কালচার শুরু করেছিল। আমরা সেটি থেকে বের হতে চাই। অনেকের বিরুদ্ধে ঢালাও মামলা হয়ে গেছে।
ফ্যাসিবাদের দোসর বিচারক এখনো গুরুত্বপূর্ণ পদে : অ্যাটর্নি জেনারেল
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অ্যাটর্নি জেনারেল মো: আসাদুজ্জামান বলেন, আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছি, বিগত সময়ে যেসব বিচারক ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে মানুষের অধিকার হরণে ভূমিকা পালন করেছেন, তারা এখনো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রয়েছেন। এ বিষয় চলমান থাকলে জাতির কাছে ভুল মেসেজ যাবে। আইন উপদেষ্টা ও প্রধান বিচারপতির অফিসকে এ বিষয়ে যথাযথ সতর্ক থাকার জন্য বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বিগত দেড় দশক খুন, গুম, হামলা, মামলা, দমন, পীড়ন ও লুটপাটের মাধ্যমে নাগরিকদের ন্যূনতম মানবাধিকার কিংবা ভোটের অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। দেশী ও আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট) পর্যন্ত চার হাজারের বেশি মানুষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। ৭০০-এর বেশি মানুষ গুমের শিকার হয়েছে। ৬০ লক্ষাধিক মানুষ গায়েবি মামলার আসামি হয়েছিল। কথা বলার স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশের স্বাধীন ও মৌলিক অধিকারগুলো হরণের মাধ্যমে বিরোধী মত দমনের নিকৃষ্টতম ইতিহাস রচিত হয়েছিল।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘সেই দুঃসময়ে আমাদের বিচার বিভাগ ন্যায়বিচারের ঝান্ডা তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। হয় দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন, নয়তো নতজানু অবস্থান নিয়েছিলেন, যা আমরা অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ করেছি। আপনারা জেনে আনন্দিত হবেন, ৩৬ জুলাই থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের কেউ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়নি। তার মূল কৃতিত্ব যেতে পারে আমাদের শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক আসিফ নজরুলের নেতৃত্বের প্রতি।’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, জাতি প্রত্যাশা করে, বিচার বিভাগ যেকোনো ধরনের দুর্নীতি কিংবা সিন্ডিকেটমুক্ত থাক। দুর্নীতির প্রচলিত ধারণা অর্থনৈতিক লেনদেন বোঝালেও, বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি ডিনামাইটের চেয়েও ধ্বংসাত্মক, অ্যাটম বোমার চেয়েও ভয়াবহ; ক্যান্সারের চেয়েও প্রাণঘাতী। সুতরাং শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে বিচার বিভাগের সব স্তর থেকে দুর্নীতি দূর করা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নৈতিক দায়িত্ব ও বড় চ্যালেঞ্জ বলে আমি বিশ্বাস করি।
অনুষ্ঠানে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতি, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান, আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান ও অধস্তন আদালতের বিচারকেরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমদ ভূঞা। অধস্তন আদালতের বিচারকদের পক্ষে খুলনার জেলা ও দায়রা জজ মাহমুদা খাতুন ও নওগাঁর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বিশ্বনাথ মণ্ডল বক্তব্য দেন।


আরো সংবাদ



premium cement