২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১০ মাঘ ১৪৩১, ২৩ রজব ১৪৪৬
`
রক্তাক্ত বায়তুল মোকাররম

মুসল্লিদের ওপর মুফতি রুহুল আমিন সমর্থকদের হামলা

বায়তুল মোকাররম মসজিদে মুসল্লিদের উপর পলাতক খতিবের সমর্থকদের হামলা : নয়া দিগন্ত -

খতিব মুফতি রুহুল আমীনের ফিরে আসাকে ঘিরে বায়তুল মোকাররমে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। গওহরডাঙ্গা থেকে আসা মুফতি রুহুল আমিনের সমর্থকদের হামলায় অনেক সাধারণ মুসল্লি আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ছয়জন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
জানা যায়, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়োগকৃত খতিব মুফতি রুহুল আমিন আত্মগোপনে চলে যান। গওহরডাঙ্গা মাদরাসার এ মহাপরিচালক বিগত সময়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন এবং শেখ হাসিনাকে কওমি জননী উপাধি দিয়েও সমালোচিত হয়েছিলেন। এ কারণে তিনি বায়তুল মোকাররমে এলে বিক্ষোভ হতে পারে আশঙ্কায় মসজিদে আসা বন্ধ করে দেন। এ কারণে ইসলামিক ফাউন্ডেশন হাফেজ মুফতি ড. ওয়ালীয়ুর রহমান ও হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহকে জুমার নামাজ পড়ানোর অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়। এর মধ্যে মুফতি রুহুল আমিন মসজিদে না আসায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন গত ২৯ আগস্ট তাকে শোকজ করে। এ ছাড়া হাফেজ মুফতি ড. ওয়ালীয়ুর রহমানকে নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়ায় গত ৩১ আগস্ট ইসলামিক ফাউন্ডেশন এক অফিস আদেশে সেপ্টেম্বর মাসের চার শুক্রবার জুমার নামাজ পড়াতে চারজনকে দায়িত্ব দেয়। এর মধ্যে ৬ সেপ্টেম্বর মুফতি মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ এবং ১৩ সেপ্টেম্বর সিনিয়র পেশ ইমাম মিজানুর রহমান নামাজ পড়ান। গতকাল শুক্রবার ইফার আদেশ অনুসারে মুফাসিসর ড. মো: আবু ছালেহ পাটোয়ারী নামাজ পড়ান এবং আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার পেশ ইমাম এহসানুল হকের দায়িত্ব দেয়া রয়েছে। এ দিকে মুফতি রুহুল আমিন শোকজের জবাব না দিয়ে গত ৪ সেপ্টেম্বর অসুস্থতা দেখিয়ে তিনি দুই সপ্তাহের ছুটির আবেদন করেন। ৬ ও ১৩ সেপ্টেম্বরের জুমার নামাজ পড়াতে পারবেন না বলে জানান তিনি। সে অনুসারে গতকাল শুক্রবার তিনি জুমার নামাজ পড়াতে আসেন। এ সময় তার সাথে গওহরডাঙ্গা মাদরাসার বিপুল ছাত্র ও তার অনুসারী ছাত্রলীগ-যুবলীগের ক্যাডাররাও মসজিদে আসেন। তবে এর আগেই ইফার নির্ধারিত ইমাম মুফাসসির ড. মো: আবু ছালেহ পাটোয়ারী নামাজ পড়াতে মিম্বরে আসেন। এ সময় মুফতি রুহুল আমিন সেখানে এলে সাধারণ মুসল্লিরা বিক্ষোভ করতে থাকেন। তারা ফ্যাসিবাদের দোসর মুফতি রুহুল আমিনকে খতিব হিসেবে দেখতে চান না বলে জানান। এ সময় মুফতি রুহুল আমিনের সাথে আসা মাদরাসা ছাত্র ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের ক্যাডাররা সাধারণ মুসল্লিদের ওপর হামলা চালায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সংঘর্ষ চলাকালে ছাত্রলীগ-যুবলীগের ক্যাডাররা সাধারণ মুসল্লিদের ওপর জুতা, জুতা রাখার র‌্যাক ছুড়তে থাকে। মসজিদের ভেতর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পরে পরিস্থিতি মোকাবিলায় র‌্যাব, পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর সদস্যরা ছুটে আসেন। পরে সেনাবাহিনীর নিরাপত্তায় জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। বিরোধিতার মুখে মুফতি রুহুল আমিন জুমার নামাজ পড়াতে পারেননি। ইফার নির্ধারিত ইমাম মুফাসসির ড. মো: আবু ছালেহ পাটোয়ারী নামাজ পড়ান। প্রত্যক্ষদর্শী মুসল্লি হামিদ বলেন, মসজিদের মতো পবিত্র স্থানে এমন হামলা ঘটনা ন্যক্কারজনক। খতিব যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বসে সমস্যা সমাধান করতে পারতেন। কিন্তু তিনি লোকজন নিয়ে এসে হামলা চালান, যা অত্যন্ত ঘৃণীত কাজ।
নুরুল হক নামে একজন বলেন, আজ স্বাভাবিকভাবে আমরা নামাজে এসেছিলাম। মুফতি রুহুল আমিনের সন্ত্রাসীরা মসজিদের ভেতরে ভাঙচুর করেছে। রুহুল আমিন সাহেব জোর করে নামাজ পড়াবেন, নামাজ পড়াক, কিন্তু মুসল্লিদের ওপর আক্রমণ কেন করল? মসজিদের ভেতরে মুসল্লিদের মেরেছে।
নামাজ পড়তে আসা আরেকজন বলেন, আমি নামাজ পড়তে এসেছিলাম, আমাদের ওপর আক্রমণ করা হয়। মসজিদের ভেতর থেকে কাচ ভাঙা আমাদের ওপর নিক্ষেপ করা হয়।
এ দিকে ঢাকা মেডিক্যাল সূত্রে জানা যায়, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে মুসল্লিদের মধ্যে মারামারির ঘটনায় আহত অন্তত ৬ জন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। আহতরা হলেন- মোস্তাইন বিল্লাহ (১৭), লিমন (১৩), এনামুল হাসান (১৬), শাকিল (২১), ফেরদৌস (২২) ও হাবিবুর রহমান (২০)।
সংঘর্ষের বিষয়ে ইফার নির্ধারিত খতিব ড. মো: আবু ছালেহ পাটোয়ারী নয়া দিগন্তকে বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত অফিস আদেশ রয়েছে। তারপরও মুফতি রুহুল আমিন লোকজন নিয়ে এসে পরিস্থিতি ঘোলাটে করেছেন, যা অনাকাক্সিক্ষত।
এ বিষয়ে মফতি রুহুল আমীন নয়া দিগন্তকে বলেন, অসুস্থতার কারণে আমি দুই সপ্তাহ ছুটি নিয়েছিলাম। সুস্থ হওয়ায় নামাজ পড়াতে গিয়েছিলাম। কিন্তু মসজিদে যাওয়ার পর মুসল্লি কমিটির পরিচয়ে তিন ব্যক্তি আমাকে বলেন, নামাজ না পড়ানোর জন্য। তারা নতুন খতিব আবু ছালেহ পাটোয়ারীকে মিম্বরে নিয়ে যান। পরে আমি মিম্বরে গেলে মুসল্লিরা হট্টগোল শুরু করেন। এতে পরিস্থিতি খারাপ হলে লোকজনের সহায়তায় আমি গাড়িতে করে বায়তুল মোকাররম ত্যাগ করে চলে আসি।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে খতিবের নামাজ পড়ানো না পড়ানোর বিষয়ে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য না থাকায় এই বিশৃঙ্খলা হয়েছে বলে মনে করেন মুসল্লিরা। তবে এ বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি ড. মোহাম্মদ বশিরুল আলমকে কয়েকবার ফোন করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
মুসল্লিরা অভিযোগ করেছেন, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে একের পর এক ঘটনা ঘটছে। গতকাল মারামারির মতো ঘটনা ঘটতে পারে এ আশঙ্কার কথা অনেকে আগে থেকেই জানতেন। বিগত সরকারের আমলে নিয়োজিত খতিব মুফতি রুহুল আমিন তার মাদরাসা থেকে লোক ভাড়া করে নামাজ পড়াতে আসবেন এ কথাও প্রায় সবাই জানতেন। কিন্তু কোনো পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করেননি ধর্ম সচিব এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক। তারা কেন নীরব ছিলেন তা এখনো রহস্যাবৃত। মুসল্লিরা অভিযোগ করেন, একজন চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত ব্যক্তি পালিয়ে গেলে তার চুক্তি বাতিল করে দিবে এটি স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু পালিয়ে যাওয়ার এক মাস পরেও কেবল একটি কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে চুপ থাকে ধর্ম মন্ত্রণালয়। এ জন্য গতকালের সংঘর্ষের ঘটনায় অনেকেই ধর্ম সচিব এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালকের নীরবতাকে দুষছেন। তারা পরিকল্পিতভাবে একটি পবিত্র স্থান বায়তুল মোকাররমকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছেন বলেও অনেকে মনে করেন। তারা বলেন, ধর্ম মন্ত্রণালয় এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশন এখনো চালাচ্ছে শেখ হাসিনা সরকারের অনুগত লোকেরা। ধর্ম সচিব, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সচিব সবাই বিগত সরকারের আমলেই নিয়োজিত। তারা এখনো বিগত সরকারের আমলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত। এমনকি জাতীয় মসজিদে ঈদে মিলাদুন্নবী সা: উপলক্ষে ইসলামী বইমেলা নিয়ে আগুন ধরানোর হুমকি দেয়া হয়েছে মসজিদের পূর্ব ও দক্ষিণ শাহানে। সবগুলো ঘটনায় ধর্ম সচিব এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশন ডিজির ব্যর্থতা প্রকাশ্য। অতি দ্রুত তাদের না সরালে আরো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটতে পারে বলেও অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।


আরো সংবাদ



premium cement