২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`
বিদ্যুৎ বিভাগ পরিণত হয় প্রতিমন্ত্রীর পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে

কমিশনের মাধ্যমে শতাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন

-

দেশের বিদ্যুৎ খাত যেন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। আর এ খাত থেকে অর্থ বের করে নিতে তার অনুসারী বিদ্যুৎ বিভাগের কিছু অসাধু আমলা ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি সহযোগিতা করার অভিযোগ উঠেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এ খাতে গত দেড় দশকে কী পরিমাণ অর্থ চুরি হয়েছে, কিভাবে শতাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে সব অনিয়মের চিত্রই দেশবাসীর সামনে আনা প্রয়োজন। আর এজন্য একটি শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন তারা।
সংশ্লিষ্টদের মতে বিদ্যুৎ খাতের অপকর্মের নেপথ্যে ছিল একটি মাফিয়া সিন্ডিকেট। এক যুগ ধরে এর (সিন্ডিকেট) নেতৃত্ব দিয়েছেন খোদ সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। লুটপাটের সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্য ছিলেন পিডিবির সদ্যবিদায়ী চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমানসহ সাবেক দুই চেয়ারম্যান ও একাধিক প্রধান প্রকৌশলী, সাবেক অতিরিক্ত সচিব আনোয়ার হোসেন, প্রতিমন্ত্রীর ছোট ভাই ইন্তেখাবুল হামিদ অপু এবং সাবেক সেতুমন্ত্রীর এক ভাতিজা।
বিদ্যুৎ খাতের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নানাভাবে এ খাত থেকে টাকা বের করে নিয়েছে স্বয়ং সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ও তাদের আত্মীয় স্বজনরা। পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই বেশির ভাগ অর্থ বের করে নেয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নসরুল হামিদের ছোট ভাই ইন্তেখাবুল হামিদ অপু এবং সেতুমন্ত্রীর এক ভাতিজা মিলে অন্তত চারটি কোম্পানির মাধ্যমে পাঁচ বছরে বাগিয়ে নিয়েছেন আট হাজার কোটি টাকার কাজ। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর সব খাতে ব্যাপক ওলটপালট হলেও বিদ্যুৎ সেক্টর থেকে এই ভূত এখনো দূর হয়নি। অভিযোগ আছে, শুধু আইটি সেক্টরে তারা বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন ১২টি বড় মেগা প্রকল্প।
জানা গেছে, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ঢাকা পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও নর্দার্ন ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) থেকে অ্যাডভান্সড মিটারিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার (এএমআই) নামের দু’টি প্রকল্প হাতিয়ে নেয়। এ দু’টি প্রকল্পের অর্থমূল্য ছিল দুই হাজার কোটি টাকা।
এছাড়া ২০২১-২০২২ অর্থবছরে একই কোম্পানি মোবাইল অ্যাপস অ্যান্ড কাস্টমার পোর্টাল প্রতিষ্ঠার নামে ডিপিডিসির কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় আরো একটি বড় মেগা প্রকল্প। এ প্রকল্পটির ব্যয়মূল্য ছিল ৫০০ কোটি টাকা। এছাড়া গত পাঁচ অর্থবছরে নসরুল হামিদ বিপুর ভাই একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিলিং প্রকল্পের নামে ডিপিডিসি, নেসকো, বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (পিডিবি), ঢাকা ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো), পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) থেকে প্রায় সাতটি মেগা প্রকল্প হাতিয়ে নেয়। প্রকল্পগুলোর মোট মূল্য ছিল পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি। অপরদিকে ডাটা সেন্টার স্থাপনের নামে বিদ্যুৎ খাতের এ ৬ কোম্পানি থেকে তারা দুটি বড় টেক কোম্পানির মাধ্যমে হাতিয়ে নেন ৮টি মেগা প্রকল্প। শুধু তাই নয়, নসরুল হামিদ বিপুর ক্ষমতার অপব্যবহার করে তার ছোট ভাই একটি কোম্পানির মাধ্যমে নেটওয়ার্ক অ্যান্ড সিকিউরিটি নামে ৮টি মেগা প্রকল্প হাতিয়ে নেন। এর মধ্যে ২০২৩ সালের ১ জুন পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড আরইবির কাছ থেকে হাতিয়ে নেন ৫০ লাখ মিটার স্থাপনের কাজ। এই প্রকল্পটির মোট ব্যয় ছিল দুই হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
জাপানের মারুবেনি করপোরেশন, ডাচ-সুইস জ্বালানি কোম্পানি ভিটল এবং পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি কোম্পানির একটি যৌথ ব্যবসায়িক জোট বা কনসোর্টিয়াম কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে দেশের বৃহত্তম এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণের কাজ পায়। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) সাথে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের ভিত্তিতে ৩০৫ মিলিয়ন ডলার বা আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে টার্মিনালটি নির্মাণে কার্যাদেশ পায় এ কনসোর্টিয়াম। যদিও এখন পর্যন্ত প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি।
অভিযোগ আছে, এই পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানিটির বেশির ভাগ মালিকানায় ছিল নসরুল হামিদ বিপুর পরিবারের লোকজন ও আত্মীয়স্বজন। কোম্পানিটি সিঙ্গাপুর ও বাংলাদেশে নিবন্ধিত। প্রতিমন্ত্রীর পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হামিদ গ্রুপের সাথে সংশ্লিষ্ট নির্বাহীরাই পাওয়ারকোর হর্তাকর্তা। একসময় নসরুল হামিদ নিজেই হামিদ গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পারিবারিক এ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সাবসিডিয়ারি কোম্পানির মাধ্যমে একাধিক ব্যবসা পরিচালনা করে। এর কয়েকটিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবেও ছিলেন বিপু। পাশাপাশি কোম্পানিগুলোর বিপুল পরিমাণ শেয়ারের মালিক তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যরা।
সিঙ্গাপুর ও বাংলাদেশের ব্যবসা নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানে দাখিলকৃত নথিপত্র অনুযায়ী, পাওয়ারকোর প্রধান শেয়ারধারী হলেন কামরুজ্জামান চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি। তিনি হলেন নসরুল হামিদ বিপুর আপন মামা। কামরুজ্জামান চৌধুরী নিজেও দীর্ঘদিন হামিদ গ্রুপের সাথে জড়িত ছিলেন। তার ছেলে, ভাই ও ভাইয়ের ছেলেরা হামিদ গ্রুপের শীর্ষ নির্বাহী হিসাবে কাজ করেছেন ও করছেন। সিঙ্গাপুরে দাখিলকৃত নথিপত্র অনুযায়ী পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনালের একজন বিকল্প পরিচালক হলেন মুরাদ হাসান। পাশাপাশি তিনি কোম্পানিটির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা বা সিওও হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
সরকারি নথিপত্র অনুযায়ী, পাওয়ারকোর সিওও হিসাবে তিনি বিপিসির সাথে সরাসরি মাতারবাড়ী এলপিজি টার্মিনাল প্রকল্পের দরকষাকষিতে অংশ নিয়েছিলেন। এই মুরাদ হাসানই আবার ‘ডেলকো বিজনেস অ্যাসোসিয়েট’ নামে হামিদ গ্রুপের একটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও ছিলেন।
২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের সময় নসরুল হামিদ নির্বাচনী হলফনামায় জানান, তিনি নিজেই ডেলকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। সেসময় তিনি কোম্পানিটির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শেয়ারেরও মালিক ছিলেন। বর্তমানে ডেলকোর মালিকানা তার ছেলে জারিফ হামিদ ও ছোট ভাই ইন্তেখাবুল হামিদের হাতে। বিপুর ছোট ভাই ইন্তেখাবুল হামিদ নিজেও হামিদ গ্রুপের একাধিক অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এই ইন্তেখাবুল হামিদের সাথে পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাবিল খানের সংযোগ রয়েছে। এই ভারতীয় নাগরিক দুবাইভিত্তিক একটি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ও সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি শিপিং লাইনের মধ্যপ্রাচ্য শাখা পরিচালনা করেন। পাওয়ারকোর সাথে জড়িত আরেক ব্যক্তি হলেন কোম্পানিটির সহকারী মহাব্যবস্থাপক তারেক খলিল উল্লাহ, যিনি দীর্ঘদিন হামিদ গ্রুপে কর্মরত ছিলেন। তিনি ইন্তেখাবুল হামিদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে হামিদ গ্রুপের আরো দু’জন কর্মকর্তা পাওয়ারকো গঠনের সময় আরজেএসসি অফিসে উপস্থিত ছিলেন। কোম্পানি হিসাবে পাওয়ারকোর নিবন্ধনের সময় এ দু’জনকে সাক্ষী হিসাবে রাখা হয়। জাহাঙ্গীর আলম নামে একজন সাক্ষীর পরিচয়পত্র ও লিংকডইন প্রোফাইল অনুযায়ী তিনি হামিদ গ্রুপের একজন সহকারী ব্যবস্থাপক।
এ বিষয়ে পাওয়ার সেলের সাবেক ডিজি বিডি রহমত উল্লাহ বলেন, গত দেড় দশকে বিদ্যুৎ খাতের মহাচুরি হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ও তার দোসররা জড়িত ছিল। এটা সবারই জানা। এখন এ খাত থেকে কী পরিমাণ অর্থ চুরি হয়েছে, দেশের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা বের করা প্রয়োজন। এজন্য একটি শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন তিনি।


আরো সংবাদ



premium cement