এবার কি নতুন চ্যাম্পিয়ন পাবে ফুটবলবিশ্ব?
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১০ জুলাই ২০১৮, ১২:১৬
রাশিয়া বিশ্বকাপ কি এবার নতুন কোনো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন উপহার দেবে? চার সেমি-ফাইনালিস্ট দলের মধ্যে ইংল্যান্ড ৫২ বছর আগে ১৯৬৬ সালে তাদের দেশে আয়োজিত বিশ্বকাপে প্রথম ও শেষবার জুলে রিমে ট্রফি জয়ের স্বাদ পেয়েছিল। ১৯৯৮ সালে ফ্রান্সকে রাজধানী প্যারিসের ‘স্তেড দ্য ফ্রঁসে’তে আমি আইমে জাঁকের প্রশিক্ষণে এবং বর্তমান ফরাসি ব্রিগেডের কোচ দিদিয়ের দেশ্যামের নেতৃত্বে বিশ্বকাপ জিতছিল। বাকি দুই সেমি-ফাইনালিস্ট বেলজিয়াম ও ক্রোয়েশিয়া এখনও অবধি কোনো বিশ্বকাপ সেমি-ফাইনালের গণ্ডি টপকাতে পারেনি। এবার তাদের সামনে বিশ্বকাপ জয়ের অধরা স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুবর্ণ সুযোগ।
ফ্রান্স ও বেলজিয়াম দুটি দলই চরম আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলতে সক্ষম। কারণ দুই দলেরই পর্যাপ্ত ফায়ার পাওয়ার রয়েছে। তাই এই ম্যাচে গোল উৎসব দেখতে পারে ফুটবলপ্রেমীরা।
বেলজিয়াম এখনও পর্যন্ত মোট ১৪টি গোল করেছে, যা এই বিশ্বকাপে সর্বাধিক। তবে কার্ডজনিত সমস্যায় বেলজিয়াম মঙ্গলবার সেমি-ফাইনালে পাবে না উইং ব্যাক টমাস মিউনিয়েরের সার্ভিস। তার বিপজ্জনক ওভারল্যাপিং অবশ্যই ঝামেলায় ফেলতে পারত ফরাসি রক্ষণকে। পিএসজির হয়ে গত মৌসুমে নজর কেড়েছিলেন মিউনিয়ের। নেইমারকে ফাউল করে গত ৬ জুলাই কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে টুর্নামেন্টে দ্বিতীয় হলুদ কার্ডটি দেখেছিলেন মিউনিয়ের। এই কারণেই বেলজিয়াম দলের স্প্যানিশ কোচ রবার্তো মার্টিনেজ ব্রাজিলের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত ৩-৫-২ ফর্মেশন পালটে চার ব্যাক সিস্টেমে ফিরতে পারেন।
বেলজিয়াম ফুটবলের এই সোনালী প্রজন্মের ফুটবলারদের ব্যক্তিগত স্কিল নিয়ে কারও মনে বিন্দুমাত্র সংশয় ছিল না। রবার্তো মার্টিনেজের আসল কৃতিত্ব হলো এই ব্যক্তিগত স্কিলের বিচ্ছুরণকে টিম গেমে পরিণত করা। যে কাজ তিনি গুডিসন পার্কে প্রায় তিন মৌসুমে এভার্টনের কোচ থাকাকালীন করে উঠতে পারেননি। বেলজিয়াম দলে তার পূবসূরি মার্ক উইলমটস একই মানের প্রতিভাসম্পন্ন দল নিয়ে ব্রাজিলে আয়োজিত গত বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনার কাছে হেরে বিদায় নিয়েছিলেন। তারপর ২০১৬ সালে ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে উইলমটের প্রশিক্ষণে বেলজিয়াম হেরেছিল ওয়েলসের কাছে।
বেলজিয়ামের কোচ হিসাবে প্রথম ম্যাচে স্পেনের কাছে ০-২ গোলে হেরেছিলেন রবার্তো মার্টিনেজ। কিন্তু তার পর থেকে রবার্তো মার্টিনেজের প্রশিক্ষণে একটানা ২৩টি ম্যাচে অপরাজিত এই বেলজিয়াম দল। আজ ফ্রান্স কি পারবে বেলজিয়ান ঘোড়ার এই অপরাজিত দৌড়ে ইতি টানতে?
রাশিয়া বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে পানামার বিরুদ্ধে প্রথমার্ধে কোনো গোল করতে পারেনি বেলজিয়াম। শেষ পর্যন্ত তারা ম্যাচটি জেতে ৩-০ ব্যবধানে। এরপর তিউনিসিয়াকে ৫-২ গোলে চূর্ণ করেছিল বেলজিয়াম। প্রথমার্ধেই তারা লিড নিয়েছিল ৩-১ গোলে। গ্রুপের শেষ ম্যাচে প্রথম একাদশের নয়জনকে বিশ্রাম দেন বেলজিয়ান কোচ রবার্তো মার্টিনেজ। তবুও আদনান জানুজাজের দেয়া একমাত্র গোলে বেলজিয়াম হারিয়েছিল ইংল্যান্ডকে।
নক-আউট পর্বে জাপানের বিরুদ্ধে ৬০ মিনিটের মধ্যে ০-২ গোলে পিছিয়ে পড়েও অন্তিম মুহূর্তে বেলজিয়াম ম্যাচটি জিতে নিয়েছিল ৩-২ গোলের ব্যবধানে। আর কোয়ার্টার ফাইনালে ‘ফলস নাইন’ নিয়ে খেলে ৩-৫-২ ছকে বেলজিয়াম পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলকে ২-১ গোলে হারিয়ে এই বিশ্বকাপে সবচেয়ে বড় অঘটনটি ঘটায়। তবে ফ্রান্সকে যদি মঙ্গলবার সেন্ট পিটার্সবার্গে বেলজিয়াম হারিয়ে দেয়, তবে সেই ফলকে কোনোভাবেই অঘটন বলা যাবে না।
অন্যদিকে, ফ্রান্স প্রথম রাউন্ডে তিনটি ম্যাচে মাত্র তিন গোল করেছিল। তবুও সাত পয়েন্ট পেয়ে তারা গ্রুপশীর্ষে থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডে উন্নীত হয়। বিশ্বকাপে ফ্রান্স ও বেলজিয়াম শেষবার মুখোমুখি হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। সেটি ছিল তৃতীয়-চতুর্থ স্থান নির্ণায়ক ম্যাচ। ফ্রান্স জিতেছিল ৪-২ গোলে। দু’দলের শেষ প্রীতি ম্যাচে স্টেড দ্য ফ্রঁসেতে ফ্রান্সকে বেলজিয়াম হারিয়েছিল ৪-৩ গোলে। শুরুতে ৩ গোলে লিড নিয়েও শেষ অবধি বেলজিয়ামের অনুকূলে ম্যাচের ফল ছিল ৪-৩।
দ্বিতীয় রাউন্ডে আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে ম্যাচে ফ্রান্সের ১৯ বছরের কিলিয়ান এমবাপে ‘উইথ দ্য বল’ প্রায় ৭৭ গজ ‘বক্স টু বক্স’ স্প্রিন্ট টেনেছিলেন মাত্র সাত সেকেন্ডে। তিনি সর্বোচ্চ গতিবেগে দৌড়লে ঘণ্টায় ৩৭ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে সমর্থ। তার এই গতির বিষ্ফোরণের মোকাবিলা করতে হবে বেলজিয়ান রক্ষণকে। ফ্রান্সের কোচ দিদিয়ের দেশঁ ভরসা রেখেছেন তার দলের দুই ২২ বর্ষীয় তরুণ উইং ব্যাক বেঞ্জামিন পাভার্ড ও লুকাস হার্নান্ডেজের ওপর। পাভার্ড আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে একটি চোখ ধাঁধানো গোল করেছিলেন।
ফরাসি ফুটবল সংস্থার প্রেসিডেন্ট নোয়েল লে গ্রেট বলেছেন, ‘দেশ্যামের কোচিংয়ে ফ্রান্স এবার বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।’ তবে সাবেক ফরাসি স্ট্রাইকার থিয়েরি অঁরি বেলজিয়াম দলের সহকারী কোচরূপে কেভিন ডে ব্রুইন, ইডেন হ্যাজার্ড, রোমেলু লুকাকুদের অ্যাটাকিং ড্রিল নিয়মিত অনুশীলন করিয়ে আরো ক্ষুরধার করে তুলেছেন। তাই অনেকেই অঁরিকে বলছেন ‘ঘরশত্রু বিভীষণ’।
এখনও অবধি চলতি বিশ্বকাপের দুই সেরা পারফরমার গোলরক্ষক থিয়াবুট কোর্তোয়া এবং হুগো লরিসের লড়াই মঙ্গলবার এই ম্যাচের অন্যতম আকর্ষণ। উরুগুয়ের বিরুদ্ধে হুগো লরিস অসাধারণ গোলরক্ষা করেছিলেন। একইভাবে ব্রাজিলের মুহূর্মুহূ আক্রমণের মুখে একের পর এক অনবদ্য সেভ করে ম্যাচের নায়ক হয়ে উঠেছিলেন বেলজিয়ান গোলরক্ষক থিয়াবুট কোর্তোয়া। উচ্চতাজনিত সুবিধা বেশি পাবে বেলজিয়াম। কারণ তাদের প্রথম একাদশে নয় জনের উচ্চতা ছ’ফুটের বেশি। এখনও অবধি ফ্রান্সের প্রধান স্ট্রাইকার অলিভার জিরু কোনো গোল পাননি। তবে তার ওপর দেশ্যামের ভরসা অটুট। আঁতোয়া গ্রিজম্যান দুটি গোল করেছেন পেনাল্টি থেকে। এছাড়া তার অ্যাসিস্ট থেকে উরুগুয়ের বিরুদ্ধে গোল করেছিলেন রাফায়েল ভারানে। তবে গত ইউরোয় গ্রিজম্যান যেমন দুরন্ত ফর্মে ছিলেন তা এখনও অবধি এই বিশ্বকাপে দেখা যায়নি।
বেলজিয়ান আক্রমণের ত্রিফলা রোমেলু লুকাকু, কেভিন ডে ব্রুইন এবং ইডেন হ্যাজার্ড যে কোনো রক্ষণ ভাঙতে সমর্থ। তাই দুই ফরাসি সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার স্যামুয়েল উমতিতি ও রাফায়েল ভারানেকে নিজেদের দক্ষতা অতিক্রম করে মঙ্গলবার খেলতে হবে। এই ম্যাচটি পরিচালনা করবেন উরুগুয়ের রেফারি আন্দ্রে কুনহা। আশা করা যায়, তিনি পরিপূর্ণ নিরপেক্ষতা বজায় রেখে ম্যাচটি পরিচালনা করবেন।
আরো পড়ুন : শিরোপা জিতবে বেলজিয়াম!
"আমি নির্দ্বিধায় মঙ্গলবারের সেমিফাইনালে (ফ্রান্সের বিরুদ্ধে) বেলজিয়ামকে এগিয়ে রাখবো," বিবিসিকে বললেন ফুটবল ভাষ্যকার একেএম মারুফুল হক।
এবারের বিশ্বকাপে আগাম ধারণা করতে গিয়ে বিশ্লেষকদের যেখানে ঘাম ছুটে যাচ্ছে, সেখানে বেলজিয়ামকে ফেভারিট মনে করতে কোনো দ্বিধা দেখালেন না বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক এই কোচ।
কেন বেলজিয়াম?
মারুফুল হক বলছেন, ব্রাজিলের মত 'অলরাউন্ড" দলকে যেভাবে তারা কোয়ার্টার ফাইনালে হারালো, তাতে বেলজিয়াম এখন শিরোপার এক নম্বর দাবিদার।
"দল, কোচ, ডিফেন্স, মিডফিল্ড এবং অ্যাটাক - এই পাঁচটি বিষয়ের বিবেচনায় গ্রুপ স্টেজে ব্রাজিলকে পাঁচের মধ্যে পাঁচ দিতেই হতো। কিন্তু শেষ দুই ম্যাচে (জাপান এবং ব্রাজিলের বিরুদ্ধে ম্যাচ দুটো) বেলজিয়ামকে সাড়ে পাঁচ দিতে হবে।"
বেলজিয়ান কোচ মার্টিনেজকে নিয়ে মুগ্ধ মারুফুল। "শেষ দুই ম্যাচে কৌশল প্রয়োগে অসামান্য বিচক্ষণতা দেখিয়েছেন তিনি।"
বিশ্বের বহু সাবেক ফুটবলার এবং ফুটবল ভাষ্যকাররা এখন সম্ভাব্য কাপ জয়ী হিসাবে বেলজিয়ামের নাম করছেন।
ইংল্যান্ড এবং ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ক্লাবের সাবেক ডিফেন্ডার রিও ফার্ডিনান্ড বলছে, অন্য তিনটি দলের এখন এক নম্বর প্রতিদ্বন্দ্বি বেলজিয়াম। "বেলজিয়ামকে হারাতে হবে তাদের।"
এডিন আজা, কেভিন দ্য ব্রাইনা বা রোমেরু লুকাকু বর্তমানে ইউরোপীয় ফুটবলের তিন নক্ষত্র। কিন্তু তারপরও বেলজিয়াম সম্পর্কে অনেকের একটাই দ্বিধা ছিল যে, তারা কখনো বিশ্বকাপ বা বড় কোনো টুর্নামেন্ট জেতেনি।
রিও ফার্ডিনান্ড এখন বলছেন, "টুর্নামেন্টের আগে এ দলটির মেন্টালিটি নিয়ে প্রশ্ন ছিল, দুই বছর আগে ইউরোতে তারা হতাশ করেছে। কিন্তু এখন তারা সমালোচকদের সঠিক জবাব দিতে পারছে, ব্রাজিলের মত দলকে তারা যেভাবে নাস্তানাবুদ করে হারালো, তাতে পরিষ্কার যে তাদের দাঁত এখন কতটা ধারালো।"
বিবিসির ফুটবল ভাষ্যকার প্যাট নেভিন বলছেন, "বেলজিয়ামের কাপ জেতার সম্ভাবনা এখন সবচেয়ে বেশি... কোনো দলের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো দলের প্রধান খেলোয়াড়দের ফর্মে থাকা।" ব্রাজিলের সাথে ম্যাচে আজা, দ্য ব্রাইনা এবং লুকাকু সেই প্রমাণ দিয়েছেন।
কীভাবে মার্টিনেজ বদলে দিয়েছেন বেলজিয়ামকে?
জার্মানির বিশ্বকাপ (১৯৯০) জয়ী দলের তারকা ইয়োর্গেন ক্লিন্সম্যান বেলজিয়ামের কোচ রবার্তো মার্টিনেজের ব্যাপারে মুগ্ধ। "আপনি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন কী অসামান্য টিম স্পিরিট এখন তাদের, মার্টিনেজ দারুণ কাজ করেছেন।"
১৯৮৬ সালে বেলজিয়াম প্রথমবার বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওঠে। তারপর ৩২ বছর পর রবার্তো মার্টিনেজ আবারো তাদের সেই উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
দুই বছর আগে মার্টিনেজ ইংলিশ প্রিমিয়ারশিপ ক্লাব এভার্টন থেকে বরখাস্ত হন। কিন্তু বেলজিয়াম জাতীয় দলের দায়িত্ব নিয়ে তিনি ম্যাজিক দেখাতে শুরু করেছেন।
দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম ম্যাচে স্পেনের কাছে হেরেছিল বেলজিয়াম। কিন্তু তারপর পরপর গত ২৪টি ম্যাচে বেলজিয়াম কারো কাছে হারেনি।
রিও ফার্ডিনান্ড বলছেন, "আজা, দ্য ব্রাইনা বা লুকাকুর মত বড় বড় তারকাদের অহম বা ইগোকে ভালোভাবে সামলাতে পেরেছেন মার্টিনেজ। তিনি পুরো দলকে একত্রিত করতে পেরেছেন, প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ জেতার স্বপ্ন সত্যে পরিণত করার মত আস্থা আনতে পরেছেন।"
"আর সে কারণেই দুই বছর আগের বেলজিয়াম এবং এখনকার বেলজিয়ামের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত।"
ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যান বলছেন, "বেলজিয়াম দলের আত্মবিশ্বাস দেখার মতো, পুরো দলের মধ্যে খুব ভালো কেমিস্ট্রি কাজ করছে, সবাই যেন একটি পাতায়।
জাপান এবং ব্রাজিলের সাথে ম্যাচ চলার সময় যেভাবে মার্টিনেজ কৌশল পরিবর্তন করেছেন, খেলোয়াড় বদলেছেন, তাতে মুগ্ধ সাবেক ইংলিশ লেজেন্ড আ্যালান শিয়ারার। "যে যে সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছেন, সবগুলো কাজ করেছে।"
রবার্তো মার্টিনেজ নিজে সমস্ত কৃতিত্ব দিচ্ছেন তার দলের খেলোয়াড়দের। "আমি এখন বিশ্বের সবচেয়ে গর্বিত মানুষ...আমি তাদের কানে খুব কঠিন সব কৌশলের মন্ত্র দিয়ে মাঠে নামিয়ে দিই, এবং তারা যেভাবে তাতে আস্থা রেখে কাজ লাগানোর চেষ্টা করছে, তা অবিশ্বাস্য।