বিদায়বেলা মনের কথা গেলেন নেইমার...
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৮ জুলাই ২০১৮, ১৪:৪৬, আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৮, ১৫:১৩
কানে হেডফোন। পিঠে স্বর্ণে মোড়ানো ব্যাগ। এভাবেই রাশিয়ায় পা রেখেছিলেন বিশ্বজয়ের লক্ষ্যে। রাশিয়া ছাড়লেনও একই ভঙ্গিতে। কিন্তু বদলে গেছে মেজাজটা। চোখে মুখে হতাশার ছাপ স্পষ্ট। কারণ এবারও খালি হাতেই দেশে ফিরতে হচ্ছে নেইমারকে।
গত বিশ্বকাপের তুলনায় এবারের দল অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। সে কথা মেনে নিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরাও। তিতে জমানায় দুর্দান্ত ফর্মে ছিল পেলের দেশ। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সব রসদই ছিল এই দলটার মধ্যে। কিন্তু অঘটনের বিশ্বকাপে সবই উলটপালট হয়ে গেছে।
সেমিফাইনালের আগেই টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে গেছে লাতিন আমেরিকার সব দেশ। যাদের মধ্যে সর্বশেষ ছিল ব্রাজিল। ১৬ বছরের খরা এবারও কাটল না। আর তাই মর্মাহত দলের স্তম্ভ নেইমার। বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ের পর সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট করে সমর্থকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলেন। সেই সাথে জানালেন নিজের মনের কথা।
নেইমার লিখেছেন, এটাই তার ফুটবল জীবনের সবচেয়ে দুঃখের মুহূর্ত। ইনস্টাগ্রামের পোস্টে তিনি লেখেন, “ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কারণ আমরা জানতাম এই দল ইতিহাস তৈরি করতে পারত। কিন্তু এবার তা হলো না। নতুন করে ফুটবল খেলার শক্তিটাই আর পাচ্ছি না। তবে আমার বিশ্বাস, ঈশ্বর যে কোনো পরিস্থিতি থেকে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি দেবেন। তাই এই পরাজয়ের মুহূর্তেও তাকে ধন্যবাদ জানাই৷”
তিনি আরো লিখেছেন, “৬ষ্ঠ বিশ্বকাপ ঘরে তোলার পথে ধাক্কা খেলাম। কিন্তু মাথায় ও মনে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার খিদে রয়েই গেলো।”
গত বিশ্বকাপে চোটের জন্য অনেকগুলো ম্যাচ রিজার্ভ বেঞ্চেই বসে কাটিয়েছিলেন নেইমার। এবার তাই জয়ের তাগিদটা বেশি ছিল। কিন্তু লক্ষ্যপূরণ হলো না।
চলতি বিশ্বকাপে তার প্লে-অ্যাক্টিংই ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। মাঠে তার চোট পাওয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা মিম। নেটদুনিয়ায় হাসি-ঠাট্টা চলেছে লাগাতার। যা দেখে শেষমেশ মুখ খুলেছিলেন ২৬ বছরের স্ট্রাইকার। বলেছিলেন, “সবার যন্ত্রণা ক্ষমতা একরকম হয় না। ব্যথা লাগলে কী করব?”
তবে ভুললে চলবে না, এই নেইমারের পা থেকে এসেছে দুটি গোলও। একাধিক গোলের নেপথ্যেও ছিলেন এই পিএসজি তারকা। কিন্তু বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে তার প্রদর্শন প্রশংসনীয় ছিল না। আর সেই ম্যাচেই ছিটকে যেতে হয়েছে ব্রাজিলকে। দলের মিডফিল্ডার ফার্নান্দিনহোও আন্দাজ করতে পেরেছেন, যেভাবে তার আত্মঘাতী গোল দলকে বিপাকে ফেলেছিল, তারপর দেশবাসী হাসি মুখে তাকে বরণ করবেন না। তাই জানিয়েছিলেন, সবরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে প্রস্তুত তারা।
আরো পড়ুন : নেইমার পাকা অভিনেতা নাকি ফাউলের শিকার?
ব্রাজিলের সুপারস্টার নেইমারকে নিয়ে এবারের বিশ্বকাপে বিতর্ক কম হয়নি। প্রতিদিনই নানা কারণে সংবাদ হয়েছেন তিনি। কিন্তু ইউরোপীয় গণমাধ্যমের বিচারে, নেইমার হচ্ছেন আসলে পাকা অভিনেতা, খেলার মাঠে পড়ে গিয়ে মারাত্মক চোট পাওয়ার অভিনয়ে তার জুড়ি মেলা নাকি ভার। ব্রাজিল এখন ছিটকে পড়েছে বিশ্বকাপ থেকে। কিন্তু তাই বলে নেইমারকে নিয়ে আলোচনা থেমে নেই।
ইন্টারনেটে তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের শেষ নেই। এরকম একটি বিদ্রুপাত্মক পোস্ট এক কথিত ফুটবল স্কুল নিয়ে, যেখানে নাকি ছেলেদের ডাইভ দিয়ে পড়ে গিয়ে কিভাবে চিৎকার করতে হবে তার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়!
ফ্রান্সের খেলোয়াড় এবং অভিনেতা এরিক ক্যানটোনা ইউরোস্পোর্ট চ্যানেলের বিশেষজ্ঞ কর্ণারে এরকম কিছু বিদ্রুপাত্মক ভিডিও আপলোড করেছেন। এরকম একটি ভিডিওতে তিনি নেইমারকে তুলনা করেছেন 'চার চাকা লাগানো স্যুটকেসের সাথে, যেটি সহজে এই চাকার ওপর ঘুরতে পারে।
অন্যদিকে মারাডোনার মতো কিংবদন্তী নেইমারের সমালোচনা করেছেন যেভাবে অন্য কোনো খেলোয়াড়ের ছোঁয়া লাগা মাত্র নেইমার যেভাবে ব্যাথা পাওয়ার অভিনয় করেছেন।
তবে মনে রাখতে হবে নেইমার হচ্ছে ব্রাজিলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। ব্রাজিলের জন্য টুর্নামেন্টে তিনি দুটি গোল দিয়েছেন। ২৭ গোলের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন। এবং ১৩ বার গোল মুখে শট নিয়েছেন।
তার পরিসংখ্যানের দিকে যদি মনোযোগ দেয়া যায়, তাহলে কথিত নাটুকেপনার বাইরে আরো অনেক মিশ্র চিত্রই কিন্তু আপনি দেখতে পাবেন।
সুইস টিভি চ্যানেল আরটিএস স্পোর্টস সম্প্রতি একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেছে। এতে তারা দাবি করছে, নেইমার এবারের টুর্নামেন্টে ব্রাজিলের চারটি ম্যাচে নাকি মোট ১৩ মিনিটি ৫০ সেকেন্ড মাটিতে বসে কাটিয়েছে। এর মধ্যে সুইজারল্যান্ডের বিরুদ্ধে তাদের প্রথম ম্যাচটিও রয়েছে।
এই পরিসংখ্যান এরপর আরো অনেক গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়। শেয়ার করা হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়।
সবচেয়ে বেশি ফাউলের শিকার?
তবে আরেকটি তথ্য হজম করার জন্য এক মিনিট সময় নেয়া যাক। ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে নেইমারের বিরুদ্ধেই কিন্তু এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ফাউল হয়েছে! মোট ২৬ বার!
লিওনেল মেসি বা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর চাইতে অনেক বেশি। মেসির বিরুদ্ধে ফাউল হয়েছে ১৫ বার, আর রোনালদোর বিরুদ্ধে ১৪ বার।
পরিসংখ্যান ওয়েবসাইট ফাইভ থার্টি এইট ডট কম দাবি করছে, গত তিনটি বিশ্বকাপের পরিসংখ্যান বিবেচনায় নিলে আসলে খেলার মাঠে নেইমারকেই সবচেয়ে বেশি তাড়া করা হয়েছে।
প্রতি খেলায় গড়ে তার বিরুদ্ধে ফাউল হয়েছে পাঁচ দশমিক দুই। অথচ নেইমার এ নিয়ে মাত্র দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ খেলেছেন। রোনালদো আর মেসি বিশ্বকাপ খেলেছেন চারবার করে।
এর আগেরবার ব্রাজিল বিশ্বকাপে নেইমারের বিরুদ্ধে ফাউল হয়েছিল ১৮ বার। মেসির বিরুদ্ধেও একই সংখ্যায়।
তবে মেসি গেল বিশ্বকাপে খেলেছিলেন সাতটি ম্যাচ। আর নেইমার পঞ্চম ম্যাচেই এমন গুরুতর আঘাত পান যে, মাটিতে পড়ে যান। তার পিঠে আঘাত লেগেছিল কলম্বিয়ার যুনিগার হাঁটুর গুঁতো লেগে।
মেরুদন্ডের একটি হাড়ে সাঙ্ঘাতিক আঘাত পান, তবে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন। এটি তার খেলোয়াড় জীবনের সমাপ্তি টেনে দিতে পারতো।
খেলার মাঠে কী ঘটে তা দেখা এবং এর মানে বোঝার নানা উপায় আছে। আমি নিজে বার বার সহিংস ফাউলের শিকার হয়েছি আমার খেলোয়াড় জীবনে, বলছেন সাবেক বর্ষসেরা বিশ্ব ফুটবলার এবং বিশ্বকাপ জয়ী তারকা রোনাল্ডো। তার মতে, 'যারা তার ওপর লাথি মারছে তাদের হাত থেকে নেইমার নিজেকে রক্ষা করছেন মাত্র।' আর রেফারিরাও এখানে নেইমারকে রক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
নেইমারের পক্ষে সবচেয়ে জোরালোভাবে দাঁড়িয়েছে তাদের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি আর্জেন্টিনার একটি সংবাদপত্র 'ওলে'। এই পত্রিকার বিরুদ্ধেই ব্রাজিল বিরোধী ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে উস্কানি দেয়ার অভিযোগ আছে।
গত ২ জুলাই ওলে তাদের ওয়েবসাইটে একটি ভিডিও প্রকাশ করে যেখানে নেইমার এ পর্যন্ত যত শারীরিক আঘাতের শিকার হয়েছেন, তা একসাথে দেখানো হয়েছে।
"হ্যাঁ, নেইমার অনেক সময় বাড়িয়ে দেখায় এবং তার নাটুকেপনা তার বিপক্ষেই যায়", বলছেন ডিয়েগো মাসিয়াস।
"কিন্তু সব দলই কিন্তু একটার পর একটা নেইমারের বিরুদ্ধে লেগে আছে। খেলার মাঠে তাকে ধারাবাহিকভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে, সারাক্ষণ তাড়া করা হচ্ছে।" - বিবিসি