যার অভাবে ব্রাজিলের এই হার
- রফিকুল হায়দার ফরহাদ, রাশিয়া থেকে
- ০৭ জুলাই ২০১৮, ১৯:৩৪, আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৮, ১৯:৪৫
চার বিশ্বকাপ খেলে ফেললেন লিওনেল মেসি; কিন্তু তিনি বিশ্বকাপ উপহার দিতে পারেননি আর্জেন্টিনাকে। লাতিন ফুটবলে মেসির আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী নেইমার এবার শেষ করলেন দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। তার দেশ ব্রাজিলও তার উপস্থিতিতে জিততে পারেনি বিশ্ব সেরার মর্যাদা।
এবার রাশিয়া বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার বিদায় হয়েছে দ্বিতীয় রাউন্ডে, আর ব্রাজিলের কোর্য়াটার ফাইনালে। দুই বারের বিশ্ব সেরারা ফরাসিদের কাছে হেরেছিল ডিফেন্সের দুর্বলতার কারণে। অন্যদিকে বেলজিমারের কাছে পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের ১-২ গোলে হারের নেপথ্য এক কাসিমিরোর অনুপস্থিতি।
রিয়াল মাদ্রিদের এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের অনুপস্থিতি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে ব্রাজিল। কাসিমিরো শুধু দলের আক্রমণেই ভূমিকা রাখতেন না। বিপক্ষ আক্রমণ দানা বাধার আগেই তা অংকুরে বিনাশ করে দিতেন। অথচ দুই সপ্তাহের বেশি ব্যবধানে দুই হলুদ কার্ডই তার ও দলের এবারের বিশ্বকাপ শেষ করে দিয়েছে। তার দুটি ফাউলই ছিল প্রতিপক্ষ সীমানায়। ব্রাজিলের প্রথম ম্যাচ সুইজারল্যান্ডের এক ফুটবলারকে মারাত্মক ফাউল করেছিরেন কাসিমিরো। এতে তার কপালে জোটে প্রথম হলুদ কার্ড। তা ১৭ জুন রোস্তভ অন ডন মাঠে। ২ জুলাই তিনি আবার মারাত্মক ফাইল করেন মেক্সিকোর এক ফুটবলারকে। ফলে আসরে দ্বিতীয় হলুদ কার্ড। যার সূত্র ধরে বেলজিয়ামের বিপক্ষে কোর্য়াটার ফাইনালের মতো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে নিষিদ্ধ তিনি। তার এই অভাব পূরণ করতে পারেননি ব্রাজিলের কোচ তিতে।
বিকল্প হিসেবে ফার্নান্ডিনহোকে খেলান কোচ। অথচ সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ তিনি। আর এই সুযোগেই কাউন্টার অ্যাটাক থেকে দ্বিতীয় গোল আদায় বেলজিয়ামের। ম্যাচ শেষে এই গোলই হয়ে যায় জয় পরাজয় নির্ধারনী। বেলজিয়ামের পাওয়ার ফুল ফরোর্য়াড রোমেলো লুকাকুকে কোনো ভাবেই আটকাতে পারেননি ফার্নান্ডিনহো। কার্ড সমস্যায় কাসিমিরো যখন সাইড বেঞ্চে তখন ফার্নান্ডিনহোকে দাবিয়ে মাঠ দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছিলেন লুকাকু। বেলজিয়ামের কাউন্টার অ্যাটাকগুলোও হয়েছে এই কারণে।
ব্রাজিল দলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলার কাসিমিরো। তার উপস্থিতিতি মেক্সিকোতো সুবিধাই করতে পারেনি দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচে। তিনি বিপক্ষ আক্রমণ নষ্ট করতে সিদ্ধহস্ত। এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার পেনাল্টি এরিয়ার বাইরে রক্ষণ লাইনের অন্যতম দেয়াল। তিনি না থাকায় লাল জার্সির বেলজিয়ানদের উৎসব হয়েছে হলুদ জার্সির ব্রাজিলীয়দের উপর। আর এতে বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম জনপ্রিয় দলের বিদায় হলো বিশ্বকাপ থেকে। প্রথমে গেল আরেক জনপ্রিয় দল আর্জেন্টিনা। এবার ব্রাজিল। ফলে সিংহভাগ মানুষের জন্যই এই বিশ্বকাপ এখন আকর্ষণহীন হয়ে পড়েছে।
লাতিন ফুটবল কেন পিছিয়ে যাচ্ছে
এই নিয়ে টানা চার বিশ্বকাপের তিনটিতেই অল ইউরোপিয়ান ফাইনাল হতে যাচ্ছে। ২০০২ সাল পর্যন্ত মোটামুটি ফাইনালের লড়াই হতো লাতিন ও ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে। এখন সেখানে ইউরোপীয়দের রাজত্ব। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে ট্রফি জয়ের লড়াইটা করতো ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনাই, এরপরেই অবস্থান উরুগুয়ের। এখন তাদের ফুটবলে ভাটার টান। বিপরীতে জোয়ার বইছে ইউরোপের ফুটবলে। ফলে ২০০৬, ২০১০ এর মতো এবারও ফাইনালে থাকছে না ব্রাজিল আর্জেন্টিনার কেউ।
ফাইনাল তো দূরেরকথা এবার মেসি, নেইমারদের দল তো সেমি ফাইনালের টিকিটই পায়নি। তাদের একজনকে দ্বিতীয় রাউন্ডের শেষেই বাড়ি ফেরার টিকিট ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। আরেকজন দেশে ফেরার বিমানে উঠেছে কোর্য়াটার ফাইনালের ম্যাচ শেষে। গ্রুপ পর্বে দারুণ খেলা উরুগুয়েকে নিয়ে কিছুটা আশা জেগেছিল; কিন্তু তাদেরও বিদায় হলো কোর্য়াটার থেকে। প্রত্যেকেরই ছিটকে পড়াটা কোন না কোন ইউরোপীয় দেশের কাছে হেরে। এক ফ্রান্সই রাশিয়া ছাড়তে বাধ্য করেছে আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়েকে, ব্রাজিলকে কাঁদিয়েছে বেলজিয়াম।
কেন ল্যাতিন দেশগুলোর এই অবস্থা? কেন তারা পেরে উঠছে না ইউরোপীয়দের সাথে ? এর কারণও ব্যাখ্যা করলেন উরুগুয়ের বর্ষীয়ান কোচ অস্কার তাবারেজ। তার মতে, অবকাঠামো গত কারণেই ফুটবলে এগিয়ে গেছে ইউরোপের দেশগুলো। আর এতে ক্রমশ: পিছিয়ে পড়ছে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ।
২০০২ সাল পর্যন্ত মোটামুটি ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা বা উরুগুয়ে ছিল বিশ্বকাপের ফাইনালে। ২০০৬ থেকে ফের শুরু হয় ইউরোপিয়ান দাপট। ২০১৪ আর্জেন্টিনা ফাইনালে উঠে সে ধারায় ছেদ টানে; কিন্তু ওই পর্যন্তই। ফাইনালে তাদের যথারীতি হার জার্মানির কাছে। ১৯৯৮ সালের ফাইনালে ব্রাজিলকে পরাজিত করেছিল ফ্রান্স। এরপর ২০০২ ছাড়া প্রায় প্রতিবারই লাতিন দেশগুলোর ফাইনালে খেলার স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হয়েছে ইউরোপীয়দের কাছে হেরে। কখনও জার্মানি , কখনও ফ্রান্স, কখনও নেদারল্যান্ডস এবার সর্বশেষ সংস্করণ বেলজিয়াম ইতি ঘটালো তাদের। তাবারেজের মতে, ইউরোপের অবকাঠামো অনেক উন্নত। মাঠেও তারা অপেক্ষাকৃত খেলছে। ফলস্বরূপ এবারও হতে যাচেছ অল ইউরেপিয়ান ফাইনাল। ফ্রান্সের কাছে হারের পর নিঝনি নভগোরদ স্টেডিয়ামে এই কথা বলেন তিনি।
মূলত: দারিদ্রই সমস্যা লাতিন ফুটবলের। তাদের মানসম্পন্ন সব খেলোয়াড়ই চলে আসে ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবে খেলতে। এই অঞ্চলের দেশগুলোর মতো ফুটবল অ্যাকাডেমি নেই আটালান্টিকের পশ্চিম ও প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব পাড়ে। সাথে যোগ হয়েছে সংশ্লিষ্ট কিছু দেশের ফুটবল কর্মকর্তাদের অযোগ্যতা। তাই প্রতিভাশূন্য হয়ে যাচ্ছে লাতিন ফুটবল। এই স্থান দখল করছে অন্য অঞ্চলের খেলোয়াড়েরা। আর্জেন্টিনার সাংবাদিকদের দুশ্চিন্তা, মেসি অবসরে গেলে কে তাদের জাতীয় দলকে টেনে নিয়ে যাবে। এক সময় নতুন ম্যারাডোনাদের হিড়িক লেগে যেত আর্জেন্টিনার ফুটবলে। এখন কেউ নতুন ম্যারাডোনার উপাধি পাচ্ছেন না। একই অবস্থা ব্রাজিলেও। নতুন পেলের সম্মান আর কারো কপালে জুটছেনা। মেসি, নেইমারের পর কে হাল ধরবে এই দুই লfতিন ফুটবল শক্তির?
ফুটবলে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ হচ্ছে ইউরোপে। তাদের ফুটবলারেরা মেটামুটি একই ক্লাব বা একই লিগে খেলেন। ফলে তারা পরস্পর সম্পর্কে অবগত; কিন্তু ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা বা উরুগুয়ে কিংবা কলম্বিয়ার ফুটবলারদের অবস্থান বিশ্বের নানা দেশের লিগে। কেউ ইংল্যান্ডে, কেউ স্পেনে, কেউ ফ্রান্স বা ইতালিতে খেলছেন। কেউ কেউ চলে গেছেন চীন-জাপানের লিগে। এতে জাতীয় দলে এদের মধ্যে বোঝাপড়ার সমস্যাও হচ্ছে।
এদিকে মেক্সিকোর হয়ে এবার পাঁচ বিশ্বকাপে খেলা রাফায়েল মাকুয়েজের মতে, ফুটবলে মেক্সিকোকে এগোতে হলে অবকাঠামো উন্নয়নে হাত দিতে হবে। কনকাকাফ অঞ্চলের এই ফুটবলারদের আরো বেশী বেশী ইউরোপের লিগে খেলতে হবে। আর্জেন্টিনার বিদায়ের পর ফুটবলে এগুতে আবকাঠামোই কথা বলেছিলেন আর্জেন্টিনার সাবেক অধিনায়ক রবার্তো আয়ালা।