যে কারণে হেরে গেল ব্রাজিল
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৭ জুলাই ২০১৮, ১০:২৬, আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৮, ১০:৫৫
বল পজিশনে ব্রাজিল বনাম বেলজিয়াম ৫৯: ৪১। গোলমুখী শট? ব্রাজিল ৯, বেলজিয়াম ৩। কর্নার ব্রাজিল ৮, বেলজিয়াম ৪!
তবু ফল বলছে দিনের শেষে বেলজিয়াম ২, ব্রাজিল ১!
হবেই বা না কেন? ব্রাজিলের যে একজন রোনালদো নেই। আর বেলজিয়ামের যে একজন থিবো কুর্তোয়া আছে।
রোনালদোর মতে একজন ফিনিশারের অভাব আর বিপক্ষের গোলে কুর্তোয়ার মতো একজন গোলকিপারই যেন ব্রাজিলকে ছিটকে দিল রাশিয়া বিশ্বকাপের দৌড় থেকে। নইলে নেইমার দ্য সিলভা স্যান্টোস জুনিয়র, মার্সেলোরা শুরু থেকই কম গোলের সুযোগ তৈরি করেননি। কিন্তু গোল হলো কই? কখনও বল জমা পড়ল কুর্তোয়ার দস্তানায়, কখন বা তেকাঠির মধ্যেই বল রাখতে পারলেন ব্রাজিলীয়রা। মাঝখান থেকে ভিনসেন্ট কোম্পানির মারা কর্নার থেকে আত্মঘাতী গোল করে বসলেন ফার্নান্দিনহো। এই প্রথম গোলটার কারণেই ম্যাচ থেকে পিছিয়ে পড়ল ব্রাজিল। নইলে ২৯ মিনিট পর্যন্ত তো ভয়ঙ্কর ফর্মে থাকা বেলজিয়াম তো গোলে কোনো শটই মারতে পারেনি।
তবে যে কাউন্টার অ্যাটাকে ভর করে জাপানের বিরুদ্ধে অভাবনীয় জয় ছিনিয়ে নিয়েছিল বেলজিয়াম, দেখা গেল সেই একই অস্ত্র তারা ব্যবহার করে গেল ব্রাজিলের বিরুদ্ধেও। এডেন অ্যাজার, রোমেলু লুকাকু, মারুয়ান ফেলাইনিদের কাউন্টার অ্যাটাকে বারবার গলদঘর্ম হচ্ছিল ব্রাজিলের ডিফেন্স। গোলও এলো সেই কাউন্টার অ্যাটাকেই। লুকাকুর পাস থেকে কেভিন দে ব্রুইনের পা থেকে গোল যখন হল, ততক্ষণে ব্রাজিল ডিফেন্সের নাছোড় মনোভাব প্রায় উধাও! একের পর এক সুযোগ নষ্টের প্রদর্শনী চলছে ব্রাজিলের আক্রমণভাগে।
কোস্টারিকা ম্যাচে যেখানে নিজেদের মধ্যে ২৭৮টি পাস খেলেছে, সেখানে ব্রাজিল পাস খেলেছিল ৭০৫টি। তারপরেও কেন সমস্ত আক্রমণ গিয়ে থমকে গিয়েছিল পেনাল্টি বক্সের সামনে?
সব ভালো যার, শেষ ভালো ফর্মুলায় আস্থা রেখে তিতে এই প্রশ্নগুলোকে উপেক্ষা করেছিলেন? না হলে কোস্টারিকা ম্যাচের ভুল কেন ফের দেখা যাবে বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে? প্রশ্ন কিন্তু উঠেই গেছে এখন।
আরো পড়ুন : সেই কাজানেই কাঁদল ব্রাজিল
কাজান! এবারের বিশ্বকাপে বড় দলগুলোর জন্য যেন সমাধিক্ষেত্র। এখানে দক্ষিণ কোরিয়া কাঁদিয়েছে জার্মানিকে, ফ্রান্স বিদায় করেছে আর্জেন্টিনাকে আর শুক্রবার পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলেরও বিদায় ঘণ্টা বাজলো এখানে। দারুণ খেলও কাজান এরিনা স্টেডিয়ামে বেলজিয়ামের বিপক্ষে ব্রাজিল হারলো ১-২ গোলে।
ইউরোপিয়ান দলের বিপক্ষে একনাগাড়ে তিনবার হারের রেকর্ড রয়েছে লাতিন আমেরিকার দল ব্রাজিলের। ২০০৬ সালে ফ্রান্সের বিপক্ষে, ২০১০ সালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে এবং ২০১৪ সালে জার্মানির বিপক্ষে। ব্যতিক্রম হলো না এবারো। ২১তম বিশ্বকাপে ইউরোপের বেলজিয়ামের কাছে ২-১ গোলে হেরে টানা চতুর্থবারের মতো বিদায় নিলো লাতিন আমেরিকার ফেবারিট ব্রাজিল।
এর আগে সাবেক চ্যাম্পিয়ন জার্মানি, স্পেন, আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ের বিদায়ে রঙ হারিয়েছে বিশ্বকাপ। এবার ব্রাজিলের হারে পুরোপুরিই পানসে হলো রাশিয়া বিশ্বকাপ। কোয়ার্টারের প্রথম ম্যাচে ইউরোপের আরেক শক্তি ফ্রান্স ২-০ গোলে হারায় লাতিনের উরুগুয়েকে। ফলে বিদায় হলো লাতিনদের। সেমিফাইনাল হবে অল ইউরোপের। বেলজিয়ামের এই জয়ে সেমিফাইনালে মুখোমুখি হবে ফ্রান্সের।
১৯৩৮ সালে বিশ্বকাপে একবারই ২-০ ব্যবধানে পিছিয়ে থেকে ম্যাচ জিতেছিল ব্রাজিল। ওই বিশ্বকাপে সুইডেনের বিপে পিছিয়ে থেকেও জিতেছিল ব্রাজিল। এবারের বিশ্বকাপে ব্রাজিল ভক্তরা আশায় বুক বেঁধে ছিলেন শেষ পর্যন্ত। কিন্তু ৮০ বছর আগের সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারেনি নেইমার অ্যান্ড কোং। ইতি ঘটল হেক্সা মিশনের। দ্বিতীয় ব্রাজিলিয়ান হিসেবে বিশ্বকাপে আত্মঘাতী গোল করলেন ফার্নান্দিনহো। আর রাশিয়ার বিশ্বকাপের ১০০তম গোলদাতা হলেন কেভিন ডি ব্রুইন।
কাজানে ম্যাচ শুরুর পর থেকেই ভাগ্য বিরূপ আচরণ করে ব্রাজিলের সাথে। ম্যাচের ৭ মিনিটে নেইমারের কর্নার থেকে থিয়াগো সিলভার হেড গিয়ে লাগে বেলজিয়ামের গোল বারে। বিপরীতে নিজেদের প্রথম কর্নার কিকেই গোল তুলে নেয় দুরন্ত বেলজিয়াম। ম্যাচের ১৩ মিনিটে বেলজিয়ামের কর্নারে নিজেদের জালেই জড়ান ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডার ফার্নান্দিনহো। আত্মঘাতী গোলে পিছিয়ে পড়ে ব্রাজিল (১-০)। পিছিয়ে পড়ে পাল্টা আক্রমণে যেতে থাকে ব্রাজিলও। কিন্তু বেলজিয়ামের জমাট রণ ভাঙতে ব্যর্থ হয় নেইমার, জেসুস, কুতিনহোরা। বিপরীতে ম্যাচের ৩১ মিনিটে অবিশ্বাস্য এক গোল করেন কেভিন ডি ব্রুইন। পাল্টা আক্রমণে লুকাকু বল টেনে নিয়ে পাস দেন ব্রুইনকে।
তিনি ফাঁকায় থাকা কোম্পানিকে মাইনাস না করে নিজেই কোনাকুনি শটে সবাইকে বোকা বানিয়ে গোল করেন (২-০)। এর আগে ১৩, ১৫, ২০ ও ২৬ মিনিটে সহজ গোলের সুযোগ নষ্ট করেন মার্সেলো, নেইমার ও কুতিনহো। দুই গোল হজমের পর ৩৬ মিনিটে কুতিনহোর শট কর্নারের বিনিময়ে রক্ষা করেন বেলজিয়ামের কিপার কোরটয়েজ। ৩৮ মিনিটে ব্রুইনের ফ্রি কিক একটুর জন্য রক্ষা করেন ব্রাজিলের কিপার আলিসন। সেই কর্নার কিক থেকে কোম্পানির হেডের বল গোলমুখ থেকে সেভ করেন আলিসন। এগিয়ে থেকেই বিরতিতে বেলজিয়াম।
দ্বিতীয়ার্ধেও একের পর এক আক্রমণ করেও ফল পাচ্ছিল না ব্রাজিল। কোচ তিতের একাধিক পরিবর্তনও কাজে আসছিল না। কিন্তু ৭৬ মিনিটে হিসাব পাল্টে দিলেন ওই বদলি হিসেবে নামা রেনাতো অগাস্তো। ৭৫ মিনিটে পাউলিনিয়োর বদলি হিসেবে নামেন তিনি। এক মিনিট পর কুতিনহোর ক্রস থেকে অগাস্তোর হেডেই প্রথম গোলের স্বাদ পায় ব্রাজিল (২-১)। এরপরই নির্ভার ব্রাজিলকে দেখা যায়। কিন্তু কাক্সিত গোলের দেখা পায়নি। ৮০ ও ৮৩ মিনিটে সমতায় আসার দারুণ সুযোগ নষ্ট করেন অগাস্তো ও কুতিনহো। দু’টি পাসই ছিল নেইমারের। কুতিনহো ও অগাস্তো ডি সীমানা থেকে বল পাঠিয়ে দিলেন পোস্টের বাইরে। শেষ পর্যন্ত শত চেষ্টা করেও আর কোনো গোল না হলে সেমিফাইনালে ওঠার আনন্দে মাঠ ছাড়ে বেলজিয়াম।
রাশিয়া বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত নিজেকে শতভাগ মেলে ধরতে পারেননি নেইমার। চার ম্যাচে করেছেন দুই গোল। একটিতে করেছেন অ্যাসিস্ট। কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিল বনাম বেলজিয়ামের ম্যাচটি ছিল কাজান অ্যারিনায়। আর এই ম্যাচে বিশ্বের সবচেয়ে দামি ফুটবলারকে একখণ্ড জমি উপহার দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন কাজান অ্যারেনার মেয়র আইলাসার ম্যাস্টিন। জমি তো দূরের কথা, বেলজিয়ামের কাছে বিশ্বকাপ থেকেই বিদায় হলো নেইমারের ব্রাজিল।