বিতর্কিত সেই রিভাল্ডো এবার পরামর্শ দিলেন নেইমারকে
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৫ জুলাই ২০১৮, ১৪:১৪, আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৮, ১৪:২৭
ঘটনা ২০০২ সালের বিশ্বকাপের। ব্রাজিলের বিপক্ষে মাঠে নেমেছিল তুরস্ক। সেদিন ম্যাচ জয়ের জন্য বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন ব্রাজিলের তারকা মিডফিল্ডার রিভাল্ডো। কর্নার কিক নিতে যাচ্ছিলেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই বলটি কিক করে তার দিকে দিচ্ছিলেন তুর্কি স্ট্রাইকার হাকান উনসাল। তখনই তার ছোড়া বলে আঘাত পাওয়ার নাটক শুরু করেন রিভাল্ডো। মুখ চেপে পড়ে যান তিনি। সাথে সাথেই উনসালকে লাল কার্ড দেখান রেফারি। পরে ভিডিও রিপ্লেতে দেখা যায়, বলটি আসলে লেগেছিল রিভাল্ডোর হাঁটুতে, মুখে নয়! এই ঘটনার জন্য কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন রিভাল্ডো। পরে জরিমানাও গুণতে হয়েছিল তাকে। সেই বিতর্কিত রিভাল্ডো এবার পরামর্শ দিলেন নেইমারকে, যিনি চলতি বিশ্বকাপে একই ধরণেই ঘটনার জন্য কড়া সমালোচনার শিকার হচ্ছেন।
গ্রুপ পর্ব থেকে শুরু করে নক আউট পর্ব, সব ম্যাচেই সামান্য আঘাতেই মাঠে গড়াগড়ি শুরু করেন নেইমার। যা নিয়ে অনেক কথাও শুনতে হচ্ছে তাকে। ফুটবলবিশ্বের তাবড় তাবড় খেলোয়াড়রা তার সমালোচনা করছেন। তবে বরাবরই তাকে সমর্থন করছেন ব্রাজিলের সাবেক এবং বর্তমান ফুটবলাররা। কিংবদন্তি রোনাল্ডো বলেছেন, ‘নেমারকে নিয়ে যা বলা হচ্ছে সবই ভুল। তাকে ইচ্ছাকৃত ফাউল করা হচ্ছে, যাতে সে সেরা পারফরমেন্স করতে না পারে। তারপরও তাকে আটকে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। নেইমারের সমালোচনা করে তাকে আটকে রাখা যাবে না।’
রোনাল্ডোর পর নেইমারের পক্ষ নিয়ে কথা বলেছেন ব্রাজিলের আরেক কিংবদন্তি ফুটবলার রিভাল্ডো। পরামর্শ দিয়েছেন, দলের প্রযোজনে যে কোনো কিছু করতে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নেইমারের উদ্দেশ্যে খোলা চিঠিতে লিখেছেন, 'যদি প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের হাত থেকে তোমাকে পালাতে হয়, পালিয়ে যাও। যদি তোমাকে বাড়তি কিছু করে দেখাতে হয়, দেখাও। যদি ফাউলের কারণে তোমাকে পড়তে হয়, পড়ে যাও। পড়ে গিয়ে যদি বাড়তি কিছু পাও তাহলে তো ক্ষতি নেই। সুযোগটা নিয়ে নাও।'
তিনি আরো লেখেন, 'নেইমার, তুমি তোমার স্বাভাবিক খেলাটা খেলে যাও। লোকে কে কি বলছে তা পাত্তা দিও না। অনেক মানুষই অনেক কথা বলবে, কারণ তাদের দেশ বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছে।'
সবশেষে তিনি বলেছেন, 'তোমার ভালো খেলাই মূলত মানুষকে এতো হয়রান করে তুলেছে। তুমি তাদের কথায় কান দিও না। বরাবরেই মতো আক্রমণ করতে থাকো এবং পায়ের জাদুতে আমাদের বিমোহিত করো।'
আরো পড়ুন : নেইমারের 'অভিনয়' : এবার মুখ খুললেন রোনাল্ডো
মাঠের ভেতর ব্যাথা পাওয়ার 'অভিনয়' করে এখন বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম শিরোনাম ব্রাজিলের অধিনায়ক নেইমার। চলতি বিশ্বকাপ ফুটবলে মাঠের ভেতর প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের ফাউলে ব্যাথা পেয়ে যেভাবে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছেন নেইমার, সেটিকে অভিনয় বলছেন প্রতিপক্ষের খেলোয়া-কোচ, সাবেক খেলোয়াড়রাসহ আরো অনেকে। তবে এই সমালোচনায় কান দিতে রাজি নন নেইমার, তা আগেই জানিয়েছেন। এবার নেইমারের পক্ষ নিয়ে কথা বললেন ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার রোনাল্ডো। তিনি বলেন, ‘নেমারকে নিয়ে যা বলা হচ্ছে সবই ভুল। তাকে ইচ্ছাকৃত ফাউল করা হচ্ছে, যাতে সে সেরা পারফরমেন্স করতে না পারে। তারপরও তাকে আটকে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। নেইমারের সমালোচনা করে তাকে আটকে রাখা যাবে না।’
মাঠের ভেতর প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের ফাউলে ব্যাথা পেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন নেইমার। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এমন আচরন করেন, যাতে অন-ফিল্ড রেফারি প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে কার্ড দেখাতে বাধ্য হন বা ব্রাজিলের পক্ষে পেনাল্টি-ফ্রি কিক দিয়ে দেন।
তেমনই একটি ঘটনা চলতি বিশ্বকাপের শুরুতে। গত ২২ জুন সেন্ট পিটার্সবুর্গে মুখোমুখি হয়েছিলো ব্রাজিল-কোস্টারিকা। ওই ম্যাচের ৭৯ মিনিটে বল নিয়ে কোস্টরিকার ডি-বক্সের ভেতর ঢুকে যান ব্রাজিলের অধিনায়ক নেইমার। এসময় তাকে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করেন কোস্টারিকার ডিফেন্ডার জিয়ানকার্লো গঞ্জালেজ। ফলে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন নেইমার। সাথে সাথে ফাউলের কারণে পেনাল্টির নির্দেশ দেন ওই ম্যাচের অন-ফিল্ড রেফারি।
রেফারির এই সিদ্বান্তের প্রতিবাদ করে কোস্টারিকার খেলোয়াড়। ফলে মাঠের ভেতর থাকা টিভিতে ভিডিও রেফারির সহায়তা নিয়ে পেনাল্টি বাতিল করে দেন অন-ফিল্ড রেফারি। টিভি রিপ্লেতে দেখা গেছে, কোস্টারিকার গঞ্জালেজ বাঁধা দেয়ার সময় নেইমারের গায়ে স্পর্শই করেননি। ব্যাথার ভান করে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন নেইমার। যাতে পেনাল্টির পাওয়া যায়। পেনাল্টি ঠিকই পেয়েছিলেন নেইমার। কিন্তু ভিডিও রেফারির সহায়তায় সেই পেনাল্টি বাতিল হয়।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই রিও ডি জেনিরিও’তে সার্বিয়ার বিপক্ষেও ম্যাচের আগে ব্রাজিলের একটি রেস্টুরেন্ট মজার ঘোষণা দেয়। তাহলো- সার্বিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে নেইমার যতবার মাঠে লুটিয়ে পড়বেন ততবার সেদেশের ক্রেতাদের ফ্রি বিয়ার দেয়া হবে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, সাবেক খেলোয়াড়-কোচ ও বর্তমান কোচরা নেইমারের কর্মকাণ্ডে বেশ ক্ষিপ্ত। নেইমারকে পাক্কা অভিনেতা হিসেবে অভিহিত করছেন তারা। এসব অভিমতের সাথে একমত নন রোনাল্ডো।
ক্ষিপ্ত হয়ে সংবাদ মাধ্যমেরও এক হাত নিলেন তিনি, ‘নেইমারকে নিয়ে এইসব সমালোচনার কোনো ভিত্তি নেই। রেফারি নেইমারকে রক্ষা করতে পারছেন না। প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়রা ইচ্ছাকৃতভাবে ফাউল করছে নেইমারকে। টিভির অনুষ্ঠানে সময় পূর্ণ করতে বা খবরের কাগজের শিরোনাম আর্কষণীয় করতেই এই সমালোচনা। তবে এসব সমালোচনা আমলে নিচ্ছেন না নেইমার। ঠিকই নিজের সেরা পারফরমেন্স করছে সে।’
নেইমারের বুদ্ধিমত্তার কারণে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা তাকে আটকে রাখতে পারছে না। নয়তো বড় ধরনের ইনজুরিতে নেইমার পড়তো বলে মনে করেন রোনাল্ডো।
তিনি বলেন, ‘নেইমার একজন বুদ্ধিমান ও চৌকস ফুটবলার। বল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় কীভাবে বিপক্ষের খেলোয়াড়দের ট্যাকল থেকে নিজেকে বাঁচাতে হয়, এ ব্যাপারে ভালো জানে নেইমার। নয়তো অনেক আগেই বড় ধরনের ইনজুরিতে পড়তে পারতো সে। নেইমারের মত অন্যান্য দলের খেলোয়াড়দের সাথে এমন আচরণ করে না প্রতিপক্ষে খেলোয়াড়রা।’
আরো পড়ুন : শুধু নেইমার নন, এমন নাটক আরো অনেকেই করেছেন
বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে কোস্টারিকার বিপক্ষে ২-০ গোলে জিতেছে ব্রাজিল। এই ম্যাচে জয়ের ফলে শেষ ১৬'র দৌড়ে এগিয়ে আছে তারা। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আলোচনায় নেইমারের পড়ে যাওয়ার নাটক।
ঘটনাটি ঘটে ম্যাচের ৭৮ মিনিটে। কোস্টারিকার ডি বক্সে রক্ষণভাগের খেলোয়াড় গঞ্জালেজের সাথে কোনো সংঘর্ষ না হওয়ার পরও মাটিতে পড়ে যান নেইমার, যেন বড় ধরণের কিছু একটা হয়েছে। রেফারিও বুঝতে পারেননি যে এটি ছিল নেইমারের অভিনয় মাত্র, ফলে বাঁশিও বাজান তিনি। কিন্তু কোস্টারিকার খেলোয়াড়দের তীব্র প্রতিবাদে ভিএআরের সহায়তা নেন রেফারি। আর রিপ্লেতে দেখা গেলো রীতিমত নাটক করেই পড়ে গেছেন নেইমার। তখন বাতিল হয়ে যায় পেনাল্টির সুযোগ। এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠে নেট দুনিয়ায়।
তবে এই ঘটনা এবারই প্রথম নয়। একমাত্র নেইমারই এমন কাণ্ড করেননি, এই তালিকায় আছে আরো অনেকে। জানুন-
ঈশ্বরের হাত : এই তালিকায় প্রথমই আছেন আর্জেন্টিনার কিংবদন্তি ফুটবলার দিয়েগো ম্যারাডোনা। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে তার অসাধারণ পারফরমেন্সে শিরোপা জিতেছিল আর্জেন্টিনা। তবে কোয়াটার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দেয়া ম্যারাডোনার গোলটি ছিল বিতর্কিত। পেনাল্টি এরিয়ায় বাম হাতের ছোঁয়ায় গোল করেছিলেন ম্যারাডোনা! 'গোলটি পরবর্তী সময়ে ‘ঈশ্বরের হাতে গোল’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
সুয়ারেজের নাটক : লুইস সুয়ারেজ। গত বিশ্বকাপে কামড়ের জন্য কুখ্যাত ছিলেন তিনি। তবে তার আগের বিশ্বকাপে ভিলেন হিসেবে পরিচিত ছিলেন উরুগুয়ের এই তারকা ফুটবলার। ২০১০ সালের বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে প্রায় পৌঁছেই গিয়েছিল ঘানা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ঘানার স্ট্রাইকার আসামোয়া গিয়ানের সাথে চ্যালেঞ্জে সুয়ারেজের হাতে আঘাত পাওয়ার নাটকে পেনাল্টি পায় উরুগুয়ে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে গোল করে সেমিফাইনালে পৌছে উরুগুয়ে। পরে অবশ্য সুয়ারেজকে আঘাত পাওয়া হাতে জয়োল্লাস করতে দেখা যায়।
বল লেগেছিল হাটুতে, ব্যাথা মুখে : ২০০২ সালের বিশ্বকাপে ব্রাজিলের রিভাল্ডোর কাণ্ড ধরা পড়েছিল রিপ্লেতে। তুরস্কের বিপক্ষে ম্যাচে স্ট্রাইকার হাকান উনসালকে তার কারণে লাল কার্ড দেখানো হয়। কী করেছিলেন তিনি? কিছুই না। পুরো নাটক করেছিলেন রিভাল্ডো। কর্নার কিক নিতে যাচ্ছিলেন রিভাল্ডো। বলটি কিক করে তার দিকে দিচ্ছিলেন উনসাল। তার ছোড়া বলে আঘাত পাওয়ার নাটক করেন রিভাল্ডো। মুখ চেপে পড়ে যান। সাথে সাথেই তাকে লাল কার্ড দেখান রেফারি। পরে ভিডিও রিপ্লেতে দেখা যায়, বলটি আসলে লেগেছিল রিভাল্ডোর হাঁটুতে, মুখে নয়! এই ঘটনার জন্য জরিমানার মুখে পড়তে হয় রিভাল্ডোকে।
ক্লিন্সম্যানের ডাইভ : সর্বকালের সেরা স্ট্রাইকারদের একজন পশ্চিম জার্মানির জার্গেন ক্লিন্সম্যান। ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে নাটক করেন তিনিও। আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডার পেদ্রো মোনজোনের সাথে চ্যালেঞ্জে শূন্যে লাফিয়ে উঠে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়েন তিনি। তার এই নাটক এতোটাই সত্যি মনে হয়েছিল যে রেফারি সাথে সাথেই মোনজোনকে লাল কার্ড দেখিয়ে দেন। বিশ্বকাপে সেইবার প্রথম কোনো ফাইনাল ম্যাচে লাল কার্ড দেখানো হয়েছিল। পরে পেনাল্টি থেকে পাওয়া একমাত্র গোলে শিরোপা জিতে পশ্চিম র্জামানি।
রোনালদোর চোখের ইশারা : ২০০৬ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল ম্যাচে পর্তুগালের প্রতিপক্ষ ছিল ইংল্যান্ড। সেই ম্যাচ ৬২ মিনিট পর্যন্ত গোলশূন্য ছিল। তখন রেফারি হোরাসিয়া ইলজোন্দোকে পটানোর চেষ্টা করেছিলেন রোনালদো। কেন করেছিলেন? তিনি রেফারিকে ওয়েন রুনিকে সরিয়ে দেয়ার জন্য পটিয়েছিলেন। কারণ এই ইংলিশ স্ট্রাইকার পর্তুগালের রিকার্দো কারভোলোর সামনেই দাড়িয়ে ছিলেন। এরপর রেফারি রুনিকে সরিয়েও দিয়েছিলেন। পরে রোনালদো চোখ মেরে কোচ লুইস স্কোলারিয়াকে সেটি বুঝিয়ে দেন। ওই ম্যাচে পেনাল্টি থেকে গোল করে জয়লাভ করে পর্তুগাল। কিন্তু পরে টিভি ক্যামেরায় সে ঘটনা ধরা পড়লে সমালোচনার মুখে পড়েন রোনালদো।