০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ২২ পৌষ ১৪৩১, ৫ রজব ১৪৪৬
`

টাইব্রেকারে সবচেয়ে সফল কারা

টাইব্রেকার এমন এক নাম যেখানে এলে নিরব হয়ে যায় উত্তেজনাময় ফুটবলের সব উদ্দামতা - ছবি : সংগ্রহ

জার্মানি, আর্জেন্টিনার পর রোববার বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিলো আরেক ফেবারিট স্পেন। দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলায় স্বাগতিক রাশিয়ার কোছে টাইব্রেকার নামক লটারিতে হেরে বিদায় নিলো ২০১০ সালের চ্যাম্পিয়নরা। পাঁচটি শটের মধ্যে দুটিতে গোল করতে ব্যর্থ হয়েছে স্পেনের ফুটবলাররা। স্পেনের হয়ে তৃতীয় টাইব্রেকার মিস করেন কোকে। শেষ শটে ইগো আসপাসও গোল করতে ব্যর্থ হন। রাশিয়ান গোলরক্ষক ইগর আকিনফিয়েভের দৃঢ়তায় এই দুই মিসেই বিদায় নিশ্চিত হয়ে যায় স্পেনের।

টাইব্রেকারে দল হিসবে সবচেয়ে সফল ইউরোপিয়ান জায়ান্ট জার্মানি। যদিও এবার তারা টাইব্রেকার রাউন্ড আসার আগেই বিদায় নিয়েছে বিশ্বকাপ থেকে। তবে অতীতে চারবার এই অগ্নিপরীক্ষায় নেমে প্রতিবারই হাসিমুখে মাঠ ছেড়েছে তারা। আর সবচেয়ে ব্যর্থ দল ইংল্যান্ড। এখন পর্যন্ত তিনটি বিশ্বকাপে টাইব্রেকারে অংশ নিয়েছে ইংলিশরা। তবে একবারও জয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারেনি তারা। আর্জেন্টিনা মোট পাঁচবার টাইব্রেকারে অংশ নিয়ে জয়ী হয়েছে চারবার।

এর মধ্যে ১৯৯০ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে যুগোস্লাভিয়াকে ৩-২ ব্যবধানে হারানোর পর সেমিফাইনালে ইতালিকে পেছনে হারায় ৪-৩ ব্যবধানে। ১৯৯৮-এ দ্বিতীয় রাউন্ডে ৪-৩ ব্যবধানে হারায় ইংল্যান্ডকে। অন্যদিকে ২০০৬-এ জার্মানির কাছে কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে যায় ৪-২ ব্যবধানে। আবার গত ২০১৪ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনা হারিয়েছিলো নেদারল্যান্ডকে।

ব্রাজিল চারবার মুখোমুখি হয় টাইব্রেকারের। একবার মাত্র হেরেছে তারা। এর মধ্যে প্রথমবার ১৯৮৬-র কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্সের কাছে ৩-৪ ব্যবধানে হারে তারা। এরপর ১৯৯৪-এর ফাইনালে ইতালিকে (৩-২) আর ১৯৯৮-এর সেমিফাইনালে হারিয়েছিল নেদারল্যান্ডসকে (৪-২)। গত বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে হারিয়েছিলো চিলিকে।

টাইব্রেকার ভাগ্যটা মোটেও সুবিধার ছিল না ইতালির। চার বারের মধ্যে তিনবারই হারতে হয়েছে তাদের। ১৯৯০ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ৩-৪, ১৯৯৪-এর ফাইনালে ব্রাজিলের সঙ্গে ২-৩ আর ১৯৯৮-র কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে তারা হারে ৩-৪-এ। বিশ্বকাপ ইতিহাসে আর কোনো দলই টানা তিনবার বাদ পড়েনি টাইব্রেকারে হেরে। তবে ২০০৬ এর ফাইনালে তারা এ ধারা পাল্টে ঘরে তোলে শিরোপা। স্পেন এ যুদ্ধে আজকের রাশিয়া ম্যাচ নিয়ে চারবারে মধ্যে তিনবার পরাজিত হলো।

নেদারল্যান্ড তিনবারের দুইবার হেরেছে। এর মধ্যে গত বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে কোস্টারিকাকে হারিয়ে, সেমিফাইনালে হেরেছে আর্জেন্টিনার কাছে।

ফ্রান্স মোট চারবার অংশ নিয়ে জয় পরাজয় ২-২। ১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলকে হারানো ফ্রান্স ২০০৬ সালের ফাইনালে এসে ইতালির কাছে পরাজিত হয় টাইব্রেকারে। এছাড়া দুইবার করে অংশ নেয়া মেক্সিকো ও রোমানিয়ার ফলাফলও শূন্য। কোস্টারিকার গত আসরে দুইবার মোকাবেলা করে দ্বিতীয় রাউন্ডে গ্রিসকে হারালেও, কোয়াটার ফাইনালে হেরে গেছে নেদারল্যান্ডের কাছে। চিলি একবার টাইব্রেকারের মুখোমুখি হয়ে (২০১৪) হেরেছে ব্রাজিলের কাছে। রোববার বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো রাশিয়া মুখোমুখি হলো টাইব্রেকারের, জয় তুললো ঘরে। পৌছে গেল কোয়ার্টার ফাইনালে।

আরো পড়ুন : যেভাবে এলো টাইব্রেকার

বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম রাউন্ড শেষে শনিবার শুরু হচ্ছে দ্বিতীয় রাউন্ড। দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে পরবর্তি সবগুলো পর্ব হবে নক আউট পদ্ধতিতে। তাই নির্ধারিত সময়ে কোন খেলা অমীমাংসীত থাকলে, দেয়া হয় অতিরিক্ত ৩০ মিনিট সময়। তাতেও জয়-পরাজয় নির্ধারিত না হলে প্রয়োগ হয় পেনাল্টি শুট আউটের মাধ্যমে টাইব্রেকিং পদ্ধতি। টাইব্রেকার এমন এক নাম যেখানে এলে নিরব হয়ে যায় উত্তেজনাময় ফুটবলের সব উদ্দামতা, থমকে যায় স্টেডিয়ামসহ পুরো ফুটবল দুনিয়া। গোল লাইন আর ১২গজ দুরত্বের একটি বিন্দুর মধ্যে পেন্ডুলামের মত দুলতে থাকে ম্যাচের ভাগ্য।

আশা নিরাশার দোলাচালে দুলতে থাকে পক্ষ বিপক্ষের সবাই। মূহুর্তের সফলতা-বিফলতা কাউকে হাসায় আবার কাউকে কাঁদায়। কেউ হিরো হয় কেউ বা ভিলেন। কিক নিতে যাওয়া খেলোয়ারটি কিংবা প্রতিপক্ষ দলের গোল রক্ষক দুজনকেই দিতে হয় চরম পরীক্ষা। দুজনের যে কারও পরবর্তি কয়েক সেকেন্ডের উপর ভিত্তি করে তৈরি হতে পারে ইতিহাস, পাল্টে যেতে পারে ফুটবলের দুঃখ সুখের কাব্য। টাইব্রেকারকে অনেকে 'কিক অব ডেথ' বলেও সম্মোধন করে থাকেন। তাই তো ফুটবল বিশ্বকাপের সাথে টাইব্রেকার জড়িয়ে আছে অনেক আনন্দবেদনার স্মৃতি হয়ে।
যেভাবে এলো টাইব্রেকার

গুরুতর ফাউল ঠেকাতেই ফুটবলে পেনাল্টি কিক চালু করা হয়। ১৮৯১ সালের সেপ্টেম্বরে এক ম্যাচে ওলভহার্মটন ওয়ান্ডারার্সের জন হিথ ফুটবল ইতিহাসে প্রথম পেনাল্টি নিয়েছিলেন একরিংটন স্ট্যানলির বিপক্ষে।  পরবর্তিতে এই পেনাল্টি কিককেই টাইব্রেকার হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। কোনো আন্তর্জাতিক আসরের ম্যাচে প্রথমবারের মতো টাইব্রেকারে নিষ্পত্তি হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। সেবারের ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে চেকোস্লোভাকিয়া ৫-৩ ব্যবধানে হারায় পশ্চিম জার্মানিকে। ঐতিহাসিক প্রথম শটটা ঠিকমতোই জালে পাঠিয়েছিলেন চেকোস্লোভাকিয়ার মারিয়ান ম্যাসনি

বিশ্বকাপে টাইব্রেকার

১৯৭৮ সালের আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে প্রথম প্রচলন হয় টাইব্রেকারের। অবশ্য সেবার মূলপর্বে কোন ম্যাচ টাইব্রেকারে গড়ায়নি। তবে আফ্রিকান অঞ্চলের বাছাই পর্বে (১৯৭৭ সালের ৯ জানুয়ারি) তিউনিসিয়া টাইব্রেকারে হারিয়েছিল মরক্কোকে। পরের বার অর্থাৎ ১৯৮২ সালের স্পেন বিশ্বকাপে দ্বিতীয় সেমিফাইনালে ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানির ম্যাচটি বিশ্বকাপ ইতিহাসে প্রথম টাইব্রেকারে মিমাংসা হয়।
নির্ধারিত সময়ে খেলায় ৩-৩ গোলে সমতা ছিল। টাইব্রেকারে পশ্চিম জার্মানি ৫-৪ ব্যবধানে ফ্রান্সকে হারিয়ে ফাইনালে উঠে। ফ্রান্সের পক্ষে স্তাইলাইক তৃতীয় শট ও ম্যাক্সিম বসিস ষষ্ঠ শটটা মিস করেন। জার্মানীর পক্ষে চতুর্থ শট মিস করেন দিদিয়ের সিক্স যার ফলে ব্যবধান দাড়ায় ৫-৪। জার্মানির গোলরক হারাল্ড টনি শুমাখার সেবার নায়ক বনে যান।

এ পর্যন্ত বিশ্বকাপ ইতিহাসের ৯টি আসরের মোট ২৬টি ম্যাচ গড়িয়েছে টাইব্রেকারে। ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপে তিন-তিনটি কোয়ার্টার ফাইনালের নিষ্পত্তি হয়েছিল টাইব্রেকারে। সেবারও ফ্রান্সকে নামতে হয়েছিল এই পরীক্ষায়। তবে তাতে তাড়া উৎরে যায় ভালো ভাবেই। ভাগ্য সঙ্গ দেয় ফ্রান্সকে। ব্রাজিলকে তারা টাইব্রেকারে হারায় ৩-৪ ব্যবধানে। ১৯৯০ বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই শুরু হয় টাইব্রেকার পরীক্ষা। সেবার আয়ারল্যান্ড-রোমানিয়ার ম্যাচ গোলশূন্য ড্রর পর টাইব্রেকারে ৫-৪ ব্যবধানে জিতে কোয়ার্টার ফাইনালের ছাড়পত্র পায় আইরিশরা।

একই বিশ্বকাপে সেমিফাইনালের জমজমাট ম্যাচে ইংল্যান্ডের কপাল পোড়ে জার্মানির কাছে টাইব্রেকারে হেরে। স্টুয়ার্ট পিয়ার্স ও ক্রিস ওয়াডেল দুজনেই কিক মিস করায় ইংল্যান্ডের আশা ভঙ্গ হয়। অন্য সেমিফাইনালেও ইতালিকে টাইব্রেকারে পরাজিত করে ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা। ১৯৯৪ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সব আসরেরই ২য় রাউন্ডের একটি করে ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছিল টাইব্রেকারে। এর মধ্যে ১৯৯৮-এ আর্জেন্টিনার কাছে ইংল্যান্ডের পরাজয় বিশ্বকাপ দর্শকদের অনেক দিন মনে থাকবে।

২০১৪ বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ডে ব্রাজিল-চিলি, কোস্টরিকা-গ্রিস, কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ড-কোস্টারিকা ও সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনা-নেদারল্যান্ড ম্যাচ নিষ্পত্তি হয় টাইব্রেকারে। বিশ্বকাপ ফাইনাল ম্যাচ টাইব্রেকারে মীমাংসা হওয়ার ঘটনা এপর্যন্ত দুটি। ঘটনাক্রমে দুবারই ইতালি ছিল এই ঘটনার স্বাক্ষী। ১৯৯৪ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে রবার্তো ব্যাজিও'র কিক মিস হলে চতুর্থবার শিরোপার স্বাদ পায় ডুঙ্গার ব্রাজিল(৩-২)। ২০০৬ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে আবারও টাইব্রেকার পরীক্ষায় নামতে হয় ইতালিকে। এবার অবশ্য ফ্রান্সকে ৫-৩ ব্যবধানে হারিয়ে শেষ হাসি হাসে আজ্জুরিরা।

আরো কিছু তথ্য

এ পর্যন্ত বিশ্বকাপ ইতিহাসে ২৬টি ম্যাচ গড়িয়েছে টাইব্রেকারে। কিক হয়েছে ২০০টির কিছু বেশি। এর মধ্যে মিস হয়েছে শতকরা ৩০ ভাগ। বিশ্বকাপ ইতিহাসে প্রথম টাইব্রেকারে গোল করতে ব্যর্থ হন জার্মানির উলি স্টিলাইক। ১৯৮২ সালে স্পেন বিশ্বকাপের ঘটনা সেটি। তবে এরপর আর জার্মানির কেউ টাইব্রেকারে গোল মিস করেনি। ইংলিশরা বিশ্বকাপে মোট ১৪টি টাইব্রেকার কিক নিযেছে, যার মধ্যে ৭টিতেই ব্যর্থ তারা।

মেয়েদের বিশ্বকাপেও দুটি ফাইনালে শিরোপার নিষ্পত্তি হয়েছে টাইব্রেকারে। ভিন্ন ভিন্ন ভুমিকায় দুইবারই এই ঘটনার স্বাক্ষী যুক্তরাষ্ট্র। এই জায়গায় তারা পুরুষদের বিশ্বকাপে ইতালির মত একই অবস্থানে। ১৯৯৯ মেয়েদের বিশ্বকাপ ফাইনালে যুক্তরাষ্ট্র ৫-৪ ব্যবধানে হারায় চীনকে। তবে এশিয়ারই আরেক দল জাপানের বিপক্ষে গত বিশ্বকাপের ফাইনালে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র হেরে যায় ১-৩-এ।


আরো সংবাদ



premium cement