বাংলাদেশ তো মেসিভক্ত : ইভান জামোরানো
- রফিকুল হায়দার ফরহাদ, রাশিয়া থেকে
- ০১ জুলাই ২০১৮, ১২:৪৯, আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৮, ১৩:২৫
আর্জেন্টিনা-ফ্রান্স ম্যাচের আগে কাজানের মিডিয়া সেন্টারে একে একে আসতে থাকেন সাবেক তারকা ফুটবলাররা। আর্জেন্টিনার অস্কার রুজেরি, রবার্তো আয়ালা, হুয়ান পাবলো সরিন সবাই হাজির। কাল এ ম্যাচের আগে পাওয়া গেল ইভান জামোরানোকে। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপে চিলির খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। মার্সেলো সালাসের সাথে জুটি বেঁধে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে একের পর এক গোল করে হইচই ফেলে দেন। ২০০০-এর সিডনি অলিম্পিকে চিলি দলের অধিনায়ল ছিলেন তিনি। এবারের বিশ্বকাপে তিনি কাজ করছেন মেক্সিকো টেলিভিশনের হয়ে।
আমি বাংলাদেশের সাংবাদিক। এটা বলতেই জামোরানোর জবাব, ‘ওহ বাংলাদেশ, তোমরা তো মেসিভক্ত।’ পরে তাকে বললাম, ‘৯৮-এর বিশ্বকাপে আপনি এবং সালাসের অনেক ভক্ত তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশে।’ আর্জেন্টিনার পত্রিকা ওলে, কারিন, দি ন্যাশিওনসহ অন্য মিডিয়ায় বাংলাদেশের জনগণের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে নিয়ে মাতামাতির খবর ছাপা হয়েছিল। তার নাইজেরিয়ার বিপক্ষে জয়ের পর। সেই দেশের সাংবাদিকেরা জানান, সে নিউজ সবচেয়ে বেশি পড়া হয়েছিল। সম্ভবত জামোরানো সে খবর পড়েছেন। কারণ ওলে খুবই জনপ্রিয় ক্রীড়াবিষয়ক দৈনিক পত্রিকা।
ফুটবল দুনিয়ায় কে সেরা- পেলে না ম্যারাডোনা এ নিয়ে বিতর্ক চলছে। জামোরানো অবশ্য সেই পথে হাঁটলেন না। তার উত্তর, কাউকেই সেরা বলল না। আমার কাছে দু'জনই এক পাল্লায়।’ এরপর চিলির এ ফিফার সেরা ১০০ ফুটবলারের তালিকায় ঠাঁই পাওয়া ফুটবলার জানান, ‘এবার চ্যাম্পিয়ন হতে পারে মেক্সিকো, ব্রাজিল বা বেলজিয়াম।’
মেক্সিকো? এ শব্দ উচ্চারণ করতেই জামোরানোর জাবাব, আমি কাজ করি মেক্সিকোর টিভিতে। তাদের কেন ফেবারিট বলব না। তবে খুশি হবো যদি কোনো ল্যাতিন দেশ ফাইনালে খেলে এবং চ্যাম্পিয়ন হয়।
এবারের বিশ্বকাপে পর্তুগালের ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে সবার আগে এগিয়ে রাখলেন এ রিয়াল মাদ্রিদের সাবেক তারকা। বললেন, ‘আমি এক নম্বরে রাখছি রোনালদোকে। দ্বিতীয় স্থানে রাখছি লিওনেল মেসিকে।’ ব্রাজিলের নেইমার প্রসঙ্গে তার বক্তব্য, চলমান বিশ্বকাপে মোটেই ভালো করছে না নেইমার। বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত ঠিকই ছিল।
তার দেশ চিলি টানা দুইবারের কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন। অথচ কোয়ালিফাই করতে পারেননি রাশিয়া বিশ্বকাপে। জামোরানোর জবাব, এটা স্রেফই দুর্ভাগ্য। তবে নতুন কোচের অধীনে তৈরি হচ্ছে চিলি। নিশ্চিত থাকুন ২০২২ কাতার বিশ্বকাপে চিলি খেলবেই।
সিডনি অলিম্পিকে ৬ গোল দিয়ে জামোরানো হয়েছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতা। তার দল জিতেছিল ব্রোঞ্জ। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপে চিলি দ্বিতীয় রাউন্ডে বিদায় নেয় ব্রাজিলের কাছে হেরে। চার বছর রিয়াল মাদ্রিদে থেকে (১৯৯২-১৯৯৬) ১৩৭ ম্যাচে ৭৭ গোল করেছিলেন। চিলির হয়ে ৬৯ ম্যাচে ৩৪ গোল করেন তিনি।
আরো পড়ুন : অঘটন নয়- পারফর্ম করেই আলোচনায়
বড় বা ছোট দল বলে কিছু নেই বিশ্বকাপে। সবই মিডিয়া এবং সর্মথকদের সৃষ্টি। যারা শিরোপা জিতেছে তাদের পক্ষে জনমত বেশি থাকবে এটিই স্বাভাবিক। শিরোপা জয়ীদের যারা বিদেয় করে দিলো তারা কি অঘটন ঘটাল? মোটেই না। যারা বিশ্বকাপে সেরা ৩২-এ জায়গা করে নিয়েছে তারা যোগ্যতার ভিত্তিতেই এসেছে। তারা যদি একটা দলকে হারিয়েই দেয় সেটি অঘটন হবে কেন। কেন বলা হয় না মাঠের পজিশনে এগিয়ে থাকায় এবং সুযোগ মিস না করায় জয়ের ভাগিদার তারা। খুঁজে খুঁজে কেন বড় দলগুলোর ব্যর্থতার সুযোগে ছোট দলগুলোকে উৎসাহ দেয়া হয় না। এ ক্ষেত্রে বড় উদাহরণ হলো আর্জেন্টিনার তথা বার্সা তারকা লায়নেল মেসি। যে গোলকিপার তার বল ঠেকিয়ে দিলো তার নামটি একবার উচ্চারিত হয়েছে কি না সন্দেহ। এমনটা ঘটেছে রিয়াল তারকা পর্তুগালের রোনালদোর ক্ষেত্রেও। দক্ষতার সাথে পেনাল্টি ঠেকিয়েও নেই আলোচনায়। দেশের সাবেক কৃতী ফুটবলার আলফাজ মানছেন, অঘটন নয়- পারফর্ম করেই আলোচনায় কম শক্তির দলগুলো।
প্রবল চমকে ভরপুর রাশিয়া বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড শেষ। তারকা-মহাতারকা খেলোয়াড়সংবলিত কিছু বড় দল যেমন উরুগুয়ে, ক্রোয়েশিয়া, ফ্রান্স, ব্রাজিল মোটামুটি দাপটের সাথে পরের রাউন্ডে পা রাখছে, ঠিক তেমনি পর্তুগাল, স্পেন, সুইজারল্যান্ড খুব কষ্টে পার পেয়েছে প্রথম রাউন্ডে। বিশ্বকাপের অন্যতম হট ফেবারিট দল আর্জেন্টিনা প্রায় ধুঁকে ধুঁকে ভাগ্যের জোরে এ যাত্রা বেঁচে গেছে। পাদ-প্রদীপের আলোর বাইরে ছোট দলের তকমা পাওয়া কিছু দল একটু বেশিই ভালো পারফরম্যান্স করে দর্শকের দৃষ্টি কাড়তে সমর্থ হয়েছে। রাশিয়া বিশ্বকাপকে অঘটন না বলে কেউ যদি প্রবল চমক বলে তাহলে খুব একটা ভুল হবে না।
চারবারের চ্যাম্পিয়ন ইতালি, টোটাল ফুটবলের জনক হল্যান্ড কিংবা সর্বশেষ দুইবার কোপা শিরোপা জয়ী চিলির মতো দলগুলো এবারের বিশ্বকাপে আসতেই পারেনি। এর বদলে রাশিয়া বিশ্বকাপে পা রাখছে এমন কিছু দল যেমন ইরান, আইসল্যান্ড, মরক্কো, জাপান, নাইজেরিয়া, পেরু কিংবা স্বাগতিক রাশিয়া। যাদের দলে নেই কোনো আলোড়ন সৃষ্টিকারী তারকা। তারা একটি সঙ্ঘবদ্ধ দল হিসেবে খেলেছে বলেই ফলাফল অন্য রকম।
রাশিয়া বিশ্বকাপের বড় চমক আইসল্যান্ড। বিশ্বকাপের অন্যতম হট ফেবারিট তারকাভরপুর দল আর্জেন্টিনার সাথে ড্র। আইসল্যান্ডের বিপে দলে শুধু মেসি নামটাই যথেষ্ট ছিল। তার সাথে দলে ছিল ডি-মারিয়া, হিগুয়েন, অ্যাগুয়েরো, মাসতেরানো। অথচ বিপে দলে ছিল না এদের সমান একটাও খেলোয়াড়। প্রথমে গোল খেয়ে পিছিয়ে থাকার চার মিনিটের মধ্যে গোল শোধ করে ম্যাচ জমিয়ে তোলে। গোল মিসের মহড়া না করলে ম্যাচের ফলাফল হতো ভিন্ন। শেষ পর্যন্ত ম্যাচ ড্র হয় ১-১ গোলে। যার প্রভাব পরবর্তী দুই ম্যাচে।
দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে হেরে গত আসরের চ্যাম্পিয়ন জার্মানির প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায়। এ দিনও জার্মানির খেলোয়াড়রা গোল মিসের মহড়া দিয়েছিল। এ ছাড়াও ‘বি’ গ্রুপ থেকে স্পেন ও পর্তুগালকে প্রায় রুখে দিয়েছিল ইরান ও মরক্কো। গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে ভাগ্যগুণে কোনো রকমে ম্যাচ ড্র করে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠতে সম হয় স্পেন ও পর্তুগাল। ভালো ফিনিশারের অভাবে এবং নিজেদের দুর্ভাগ্যে বিশ্বকাপ থেকে বাদ পরে ইরান ও মরক্কো। খেলায় হয়তো তারা হেরেছে; কিন্তু সারা বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের মন জয় করেছে ইরান ও মরক্কো। তাতে সমর্থকের সংখ্যা আরো বেড়েছে। এ ছাড়া জাপান, সার্বিয়া, পোল্যান্ড, মিসরের খেলোয়াড়রা ব্যাক্তিগত নৈপুণ্য দেখিয়ে দর্শকদের মন জয় করেছে।
বিশ্বকাপ হচ্ছে এমন একটি ক্রীড়ামঞ্চ যেখানে কোনো দলই নিশ্চয়তা দিতে পারবে না যে, তারা জিতবে। কারণ বড় দল হোক আর ছোট দল হোক সবাই নিজেদের সেরাটাই দিতে চায় ভালো ফলাফলের জন্য। বিশ্বকাপ আন্ডারডগ বা ছোট কোনো দলকেই বলা যাবে না। কারণ তারা একটি সঙ্ঘবদ্ধ দল হিসেবে পারফরম্যান্স করে, যে কাউকে ধরাশায়ী করার মতা রাখে। ইতিহাসে এমন উদাহরণ বহু রয়েছে।
ইউরোপ কিংবা ল্যাতিন আমেরিকার খেলোয়াড়রা যেভাবে বিশ্ব কাব ফুটবলে নিয়মিত খেলছে বা অংশ নিচ্ছে সে তুলনায় আফ্রিকা কিংবা এশিয়ার খেলোয়াড়রা সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত। তাদের নাম না হওয়ার পেছনে এটিও একটি কারণ। আজ যদি তারা ইংলিশ ফুটবলে কিংবা লা লিগায় নিয়মিত হতো তাহলে সাপোর্টারের সংখ্যা ছাড়িয়ে যেত ইউরোপকে। সালাহ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। লিভারপুলে সালাহ খেলে বলেই বিশ্বকাপে কোটি কোটি জোড়া দৃষ্টি অপেক্ষা করছিল তার কারিকুরি দেখার আশায়। তাই অঘটন বলে অপেক্ষাকৃত কম শক্তির দলগুলো নিরুৎসাহিত করার কোনো কারণ নেই।