০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ২৫ পৌষ ১৪৩১, ৮ রজব ১৪৪৬
`

‘আমাদের ছেড়ে যেওনা, সালাহ’

মোহাম্মদ সালাহ - ছবি : এএফপি

চেচনিয়ার প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাতের পরই সংবাদ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়েছে- মিসর দলকে গুডবাই জানাতে পারেন সুপারস্টার মোহাম্মাদ সালাহ। মার্কিন সংবাদ মাধ্যম সিএনএনের একটি রিপোর্টের সূত্রেই এই খবরটি ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আর এরপরই সালাহ ভক্তরা তার প্রতি অনুরোধ করেছেন যাচ্ছেন এমন ‘অমানবিক সিদ্ধান্ত’ না নিতে।

এবারের বিশ্বকাপটি ভালো কাটেনি ‘মিসরীয় সম্রাট’ মোহাম্মাদ সালাহ’র। লিভারপুল এফসির হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদের বিরুদ্ধে ইনজুরিতে পড়ার কারণে প্রথম ম্যাচে মাঠে নামতে পারেননি। দল হেরে গেছে উরুগুয়ের কাছে। দ্বিতীয় ম্যাচে হাফ-ফিট সালাহ মাঠে নামলেও দলকে জেতাতে পারেননি রাশিয়ার বিরুদ্ধে। তৃতীয় ম্যাচেও সৌদি আরবের কাছে হেরে গেছে মিসর। ফলে ব্যক্তিগত ভাবে দুই ম্যাচে দুটি গোল করলেও দলীয়ভাবে কোন অজর্নই নেই সালাহ’র। ২৮ বছর পর খেলতে এসে খালি হাতে মিসর বিদায় নিয়েছে বিশ্বকাপ থেকে।

তবে রাশিয়ার চেচনিয়া প্রদেশের প্রেসিডেন্ট রমজান কাদিরভের সাথে ছবি তোলার ঘটনা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে সালাহ’র। রমজান কাদিরভ সালাহর ইমেজ ব্যবহার করে মুসলিম বিশ্বের কাছে নিজের ভাবমূর্তি বাড়াতে চান বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর এরপরই ওঠে সালাহ’র অবসরের গুঞ্জন। চেচনিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধীতা করে মস্কোর সাথে আতাতের ভিত্তিতে চেচনিয়ার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন রমজানের বাবা। বাবার মৃত্যুর পর রমজান হয়েছে প্রেসিডেন্ট। তাই মুসলিম বিশ্বের কাছে রমজান কাদিরভের রয়েছে নেতিবাচক ইমেজ। কাদিরভের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিরোধীমত দমনের ব্যাপক অভিযোগ আছে। মস্কোর সহায়তায় স্বাধীনতাপন্থীদের ওপর তার দমন-নিপীড়ন কারো অজানা নয়।

একটি সূত্র সিএনএনকে জানিয়েছে,সালাহ ফুটবলের বাইরে অন্য কোন বিষয়ে জড়াতে চান না। এবং কারো রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ারও হতে চান না। আর এ কারণেই তিনি অবসর নিতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

কিন্তু সালাহ ভক্তরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না প্রিয় তারকার জাতীয় দল ছাড়ার এই খবর। যদিও এখন পর্যন্ত এর সত্যতা মেলেনি, তবু তারা সরব হয়েছেন এর বিরুদ্ধে। সবাই সালাহকে অনুরোধ করছেন মিসরের হয়ে খেলা অব্যাহত রাখতে। টুইটারে ইতোমধ্যেই ‘আই অ্যাম উইথ সালাহ’ হ্যাশ ট্যাগ চালু হয়েছে। ব্যাপক সাড়া ফেলেছে ক্যাম্পেইনটি। ভক্তরা সালাহর ইমেজের এই অপব্যহারের জন্য দুষছে মিসরীয় ফুটবল ফেডারেশনকে। তারা মনে করছেন মিসরীয় ফুটবল ফেডারেশন রমজান কাদিরভকে সালাহ’র ইমেজ ব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে।

এসরা এম আয়মান নামে একজন টুইটারে লিখেছেন, ‘সালাহ আমাদের ছেড়ে যেওনা। এই দেশের সেরা সম্পদ তুমি, তুমি ছাড়া আমরা অর্থহীন।’ জিজো ভিক নামে আরেক সালাহ ভ্ক্ত লিখেছে, ‘বুঝতে পারছি কেন তুমি আর মিসরের হয়ে খেলতে চাওনা। যারা তোমার সুনাম ক্ষুন্ন করতে চাইছে তাদের বিরুদ্ধে সব সময় আমাদের পাশে পাবে। একশো মিলিয়ন লোকের স্বপ্ন তুমি।’

নাসরিন মুসা নামের এক নারীভক্ত লিখেছেন,‘তিনি শুধু ফুটবল খেলতে চান। আমরা তোমার সাথে আছি সালাহ’। বদি কিনাওয়ে নামের আরেকজন লিখেছেন, ‘সালাহ শুধুমাত্র একজন ফুটবলার। তাকে রাজনীতিতে জড়ানো বন্ধ করুন’।
করিম জিদান নামে একজন এই ঘটনার জন্য ফিফা ও মিসরীয় ফুটবল ফেডারেশনকে দুষছেন। তিনিও মনে করেন সালাহকে রাজনীতির হাতিয়ার বানানো হয়েছে।

মিসরীয় ফুটবল ফেডারেশন অবশ্য এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, সালাহ দলের সাথেই সার্বক্ষণিক আছেন। কাজেই তিনি অবসরের সম্ভাবনার কথা বা এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত ফেডারশনকে জানানি।

পূর্বেকার খবর : সালাহকে নিয়ে রাজনীতি
রফিকুল হায়দার ফরহাদ, রাশিয়া থেকে
ফুটবল মাঠে ঈর্ষণীয় পারফরম্যান্স ও বিনীত আচরণ মোহাম্মদ সালাহকে মুসলমানদের গর্বে পরিণত করেছে। এদিকে সালাহ’র ইমেজকে কাজে লাগিয়ে নিজের যত কুকর্ম ও অপরাধ আছে তাতে স্বচ্ছতার প্রলেপ দেয়ার চেষ্টা করছেন চেচনিয়ার প্রেসিডেন্ট রমজান কাদিরভ। তিনি শুরু করেছেন সালাহকে নিয়ে রাজনীতি।
প্রথমে এই চেচনিয়ার রাষ্ট্রনায়ক মিসর দলের অনুশীলনে গিয়ে সালাহকে সাথে নিয়ে আখমদ স্টেডিয়াম পরিদর্শন করেন। এরপর সালাহ’র হাত তুলে ধরে তার সাথে ছবি তুলেছেন। এখন এই ফুটবল স্টারকে দিয়েছেন চেচনিয়ার সম্মানসূচক নাগরিকত্ব। গত শুক্রবারের ঘটনা এটি।

চলমান বিশ্বকাপে মিসর দলের বেস ক্যাম্প ছিল রাশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্য চেচনিয়ার রজাধানী গ্রোজনিতে। আর এই সুযোগেই সালাহ’র ইমেজকে কাজে লাগিয়ে চেচনিয়ার প্রেসিডেন্ট রমজান কাদিরভ বর্হিবিশ্বে নিজের অবস্থান উন্নত করার চেষ্ট করছেন। রমজান কাদিরভের বিপক্ষে তার দেশে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিাযোগ রয়েছে। বিশেষ করে তার মতাদর্শ বিরোদীদের কঠোর হস্তে দমন করা, গুম করে ফেলার মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। বহুবিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ড তার নির্দেশে হয়েছে বলে ব্যাপক অভিযোগ। 
তাই এই লৌহ মানব বর্হিবিশ্বে ব্যাপক সমালোচিত এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য।

এদিকে চেচনিয়ার প্রেসিডেন্টের সাথে ছবি তুলে মোহাম্মদ সালাহও অনেকের অপ্রিয় হয়ে গেছেন। অনেকেই সালাহর সমালোচনায় সোচ্চার হয়েছে কাদিরভের সাথে ঘনিষ্ঠতার জন্য। আসলে সালাহ’র কী দোষ? একজন প্রেসিডেন্ট যদি তার সাথে দেখা করেন ও ছবি তুলতে চান তা হলে এড়িয়ে যাওয়ার তো উপায় থাকে না। তাছাড়া এই চেচনিয়ায় তো মিসর দল আতিথ্য গ্রহণ করেছে। গত শুক্রবার মিসর দলকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানান চেচনিয়ার প্রেসিডেন্ট। তখনই সালাহকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেয়ার ঘোষণ দেন রমজান কাদিরভ। সাথে চেচনিয়ার ক্লাব এফসি আখমদ গ্রোজনি দলের জার্সী উপহার দেয়া হয় সালাহকে। রমজানের বাবার নামেই এই ক্লাব।

এবারের বিশ্বকাপে মেসি, রোনালদো, নেইমারের চেয়ে কম আলোচনায় ছিলেন না সালাহ। বিশেষ করে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদের স্প্যানিশ ফুটবলার সার্জিও রামোস কর্তৃক ফাউলের শিকার হয়ে মারাত্মক আহত হওয়া ও পরবর্তীতে সালাহ’র বিশ্বকাপে খেলার অনিশ্চয়তা আরো ব্যাপক মাত্রায় আলোচনায় নিয়ে আসে তাকে। এই লিভারপুল তারকা শেষ পর্যন্ত সকল শঙ্কা কাটিয়ে রাশিয়া বিশ্বকাপে খেলেছেন মোহাম্মদ সালাহ। উরুগুয়ের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে সাইডলাইনে বসে থাকলেও রাশিয়ার বিপক্ষে পুরোপুরি ফিট না হওয়া সত্ত্বেও খেলেছেন। গোলও করেছেন পেনাল্টি থেকে। এই একটি বিষয়ে তিনি লিওনেল মেসির চেয়ে এগিয়ে। এবারের বিশ্বকাপে মেসি এখনও গোলশূন্য। মিস করেছেন পেনাল্টি। অন্যদিকে সালাহ’র ভাণ্ডারে এক গোল। সোমবার সালাহর মিসরের শেষ ম্যাচ সৌদি আরবেব বিপক্ষে। ভলগোগ্রাদে অনুষ্ঠিতব্য এই্ ম্যাচটি দুই দলেরই নিয়ম রক্ষার। তবে সালাহ’র শেষ সুযোগ গোল করে বিশ্বের কোটি কোটি দর্শকদের প্রত্যাশা পূরণ করা এবং দলকে জেতানো।

রাশিয়ার বিপক্ষে দুই দফা স্বাধীনতা যুদ্ধ করে চেচনিয়া। ১৯৯৩ সালে চেচনিয়া পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষনা করে রাশিয়া থেকে। এর ক্ষুদ্ধ রুশ বাহিনী চেচনিয়া আক্রমণ করলে ১৯৯৪ সাল থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। তাতে জয় হয় চেচেন মুসলিমদের । এরপর রুশবাহিনী ফের চেচনিয়া আক্রমণ করে ১৯৯৯ সালে। তখন এই রমজান কাদিরভের বাবা আখমদ কাদিরভ তার বাহিনী নিয়ে দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থা নিয়ে হাত মেলায় রুশদের সাথে। ফলে ২০০০ সালে পরাজয় হয় চেচনিয়ার যোদ্ধাদের। আখমাদ কাদিরভ হন চেচনিয়ার প্রেসিডেন্ট। পরে স্বাধীনতাকামীদের স্টেডিয়ামে পেতে রাখা বোমায় নিহত হন আখমাদ। এরপর দেশের প্রেসিডেন্ট হন ছেলে রমজান। তখনই তিনি বিরোধীদের দমনে লঙ্ঘন করতে থাকেন মানবাধিকার। তাই সারা বিশ্বেই রয়েছে তার সমালোচনা। উল্লেখ্য ১৯১৭ সালে চেচনিয়া দখল করে সোভিয়েত রাশিয়ার অন্তর্ভূক্ত করা হয়। তখন চেচেনদের শুরু করা স্বাধীনতা যুদ্ধ হারের মাধ্যমে শেষ হয় ১৯২১ সালে।


আরো সংবাদ



premium cement