১০ জানুয়ারি ২০২৫, ২৬ পৌষ ১৪৩১, ৯ রজব ১৪৪৬
`

শাকিরির বুটে কসভোর পতাকা, উদযাপনে আলিবেনিয়া: কেন?

শাকিরির সেই প্রতিবাদী উদযাপন। (ইনসেটে) তার বুটের পেছনে আকা কসভোর প্রতীক - ছবি : সংগ্রহ

সার্বিয়ার বিপক্ষে গোল করে দলের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সুইস ফরোয়ার্ড জেরদান শাকিরি। ম্যাচের প্রায় শেষ মূহুর্তে জয়সূচক গোল করে দলকে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার পথে এক ধাপ এগিয়ে রেখেছেন এই তারকা খেলোয়াড়। ১-১ গোলে ড্র অবস্থায় ম্যাচ যখন শেষের পথে তখনই দারুণ এক গোল করে জয় নিশ্চিত করেন শাকিরি। ফলে প্রথম ম্যাচে ব্রাজিলের সাথে ড্র করা দলটি এখন মোট চার পয়েন্ট নিয়ে অবস্থান করছেন ব্রাজিলের সাথে যৌথভাবে গ্রুপের শীর্ষে।

তবে এই ম্যাচের পর সম্পূর্ণ অন্য কারণে আলোচনায় এসেছেন জেরদান শাকিরি। ম্যাচের পর শাকিরির উদযাপনের ভঙ্গি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে। আর তার পায়ের বুট জোড়াও জন্ম দিয়েছে আলোচনার। সুইস এ তারকা শুক্রবারের ম্যাচে যে বুটজোড়া ব্যবহার করেছিলেন তাতে বাম পায়েরটিতে ছিলো সুইজার‌ল্যান্ডের পতাকা, আর ডান পায়েরটিতে কসোভোর। যা এখন আলোচনার বিষয়। বলকান অঞ্চলের(দক্ষিণ ইউরোপ) দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বৈরিতায় নতুন ঝড় তুলেছে এই ঘটনা।

গোল করার পর শাকিরি তার দুই হাত বুকের কাছে ক্রস আকারে রেখে উদযাপন করেছেন, যাতে দুই হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলিও ছিলো একটি বিশেষ ভঙ্গিতে। এই ভঙ্গিটি মূলত আলবেনিয়ার জাতীয় পতাকার জোড়া ইগলের ছবির মত দেখতে। আর এতেই শুরু হয়েছে বিতর্ক। শুধু শাকিরি নয়, সুইজারল্যান্ডের হয়ে প্রথম গোল করা গ্রান্ট জাকাও একই ভঙ্গিতে গোল উদযাপন করেছেন। ফলে ঘটনাটি আলোচনার জন্ম দিয়েছে। আবার শাকিরি বুটে কসেভোর জাতীয় পতাকার ছবিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে।

আসলে এই ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে বলকান অঞ্চলের দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসের এক চিত্র। শাকিরির জন্ম কসভোয়। গঞ্জিলানের কসোভান শহরে জন্ম নেন শাকিরি। কসভোর অধিকাংশ জনগোষ্ঠি জাতিগত আলবেনীয়। পাশ্ববর্তী মুসলিম দেশ আলবেনিয়ার অধিবাসীদের একই জনগোষ্ঠির বাসিন্দা তারা। ২০০৮ সালে সার্বিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কসভো। যদিও এর আগে তাদের সইতে হয়েছে অনেক নির্যাতন নীপিড়ন। কসভোর মুসলিমদের ওপর ব্যাপক হত্যা ও নির্যাতন চালায় সার্বরা। এই যুদ্ধের সময় ১৯৯২ সালে আরো অনেক কসভোর বাসিন্দার মতো শাকিরির বাবাও জন্মস্থান ছেড়ে সুইজারল্যান্ডে চলে যান। গ্রানিত জাকার পরিবারও সে সময় দেশ ছেড়ে আশ্রয় নেয় সেখানে। সার্বিয়া ও কসভো যখন একত্রে বৃহত্তর যুগোস্লাভিয়ার অংশ ছিলো- সে সময় কসভোর স্বাধীনতার দাবিতে কথা বলায় প্রায় সাড়ে তিন বছর রাজবন্দী ছিলেন গ্রানিত জাকার বাবা। কারামুক্তি পেয়েই দেশ ছেড়ে সুইজারল্যান্ডে পাড়ি পরিবারসমেত পাড়ি জমান তিনি।

এখন সুইস ফুটবলের বড় তারকা হলেও নিজেদের শেকড় ভোলেননি জাকা বা শাকিরি। শুক্রবার সার্বিয়ার বিপক্ষে জিতে ‘আলবেনিয়ান ঈগল’ উদযাপনের মাধ্যমে ‘পুরনো হিসেব’ শোধ করেছেন এই দুই ফুটবলার। এর প্রায় ২ যুগ পরে সার্বিয়ার বিপক্ষে গোল করে সেই গণহত্যার কথাই মনে করিয়ে দিয়েছেন তারা। দুজনই নিজেদের গোলের পরে দুই হাত দিয়ে বানিয়েছেন ‘জোড়া ঈগল’। যা কিনা আলবেনিয়ার ঐতিহ্য ও গৌরবের প্রতীক। এই দুজনের গোলেই সার্বিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়েছে সুইজারল্যান্ড।

কসোভোর আলবেনীয় স্বাধীনতাপন্থীদের বিরুদ্ধে সার্ব বাহিনীর যুদ্ধ শেষ হয় ১৯৯৮-৯৯ সালে। ওই সময় কসভোর স্বাধীনতা আন্দোলনে সমর্থন করতে দেশটিতে অভিযান চালায় পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো।। এতে কসোভো থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয় দেশটি। এর এক দশক পর ২০০৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সার্বিয়া থেকে পৃথক হয় কসোভো। যদিও সার্বিয়া এখনো স্বীকৃতি দেয়নি কসভোকে।

অবশ্য এমন উদযাপনকে রাজনৈতিক বলছেন অনেকে। কেউ কেউ এই দুই তারকার শাস্তির দাবিও তুলেছেন। যদিও তাদের পাশে দাড়িয়েছেন কোন সুইস কোচ ভ্লাদিমির পেটকোভিচ। তিনি বলেন, ফুটবলকে রাজনীতির সাথে মেশাবেন না। আনন্দের সময় ফুটবলাররা তাদের আবেগ প্রকাশ করবেই। আমাদের সবাইকে রাজনীতি থেকে দূরে থেকে ফুটবলে মনোযোগী হওয়া উচিত’।

আরো পড়ুন : কে এই আহমদ মুসা
নাইজেরিয়ার হয়ে জোড়া গোল করে শুক্রবার আইসল্যান্ডকে প্রায় একাই পরাজিত করেছেন মোহাম্মাদ মুসা। ৪৯ ও ৭৫ মিনিটে দুর্দান্ত দুটি গোল করে দলকে টিকিয়ে রেখেছেন এই নাইজেরিয়া ফরোয়ার্ড। শুধু তাই নয়, এই জয়ের ফলে আর্জেন্টিনা ও আইসল্যান্ডকে পেছনে ফেলে ডি গ্রুপের দ্বিতীয় অবস্থানে আছে আফ্রিকার সুপার ইগলরা। পরের ম্যাচে আর্জেন্টিনাকে পরাজিত করতে পারলেই তারা পেয়ে যাবে দ্বিতীয় রাউন্ডের টিকিট।

শুক্রবারের ম্যাচে আহমদ মুসার জোড় গোলই শুধু নয়, তার পুরো খেলাই নজর কেড়েছে ফুটবল বিশেষজ্ঞদের। গতি, ড্রিবলিং, নিখুত ফিনিশিংসহ অনেক কিছু দিয়েই তিনি চিনিয়েছেন নিজেকে। ম্যাচের পরই বিশ্ব মিডিয়া নড়েচড়ে বসেছে। সাবার প্রশ্ন কে এই মুসা? অবশ্য খুঁজে পেতে খুব বেশি সময় লাগেনি। ২০১৪ বিশ্বকাপেও যে আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে জোড়া গোলের নজির রয়েছে তার।

প্রথম ম্যাচে ক্রোয়েশিয়ার কাছে ২-০ গোলে পরাজিত হওয়া নাইজেরিয়ার কাছে শুক্রবারের ম্যাচটি ছিলো ‘ডু অর ডাই’। হারলেই শেষ হয়ে যেত বিশ্বকাপ মিশন। এমন ম্যাচে শুরু থেকে প্রভাব বিস্তার করে খেললেও গোল পায়নি দলটি। দ্বিতীয়ার্ধে দেখা মেলে গোলের। ৪৯ মিনিটে ডান প্রান্ত দিয়ে কাউন্টার অ্যাটাকে যায় নাইজেরিয়া। ডান দিকের কর্নার ফ্ল্যাগের কাছ থেকে বক্সের মধ্যে ক্রসে বল ফেলেন ভিক্টর মোজেস। দৌড়ে বক্সে ঢুকে পা উঁচু করে বলটি মাটিতে নামান মুসা। বল মাটিতে পড়ে আবার উঠতে শুরু করার সাথে সাথেই হাফ ভলি শটে জালে জড়ান বল। আইসল্যান্ডের দুই ডিফেন্ডারের চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিলো না।

দ্বিতীয় গোলটি তো আরো নান্দনিক। ৭৫ মিনিটে বাম প্রান্ত দিয়ে ক্ষিপ্র গতিতে আইসল্যান্ডের ডিফেন্ডারকে হারিয়ে ঢুকে পড়লেন বক্সে। গোলরক্ষক ও দুই ডিফেন্ডারও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেননি মুসার সামনে। আবারো গোল।

নাইজেরিয়ার হয়ে মুসাই প্রথম খেলোয়াড় যিনি বিশ্বকাপে এক ম্যাচে জোড়া গোল করলেন। তবে পাঠক, সেটি শুক্রবারের ম্যাচে নয়। ২০১৪ সালে গ্রুপ পর্বের ম্যাচে আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে জোড়া গোল করেছিলেন মুসা। সেই ম্যাচেই বিশ্ব ফুটবল চিনেছিলো মুসা নামে এক ফুটবলারকে। তখন মুসার বয়স ছিলো মাত্র ২১ বছর। সেই ম্যাচে আর্জেন্টিনার হয়ে মেসির জোড়া গোলের গোলের জবাবে জোড়া গোল করেছিলেন আহমদ মুসা। ৩ মিনিটে মেসি গোল করে এগিয়ে দেন আর্জেন্টিনাকে। চতুর্থ মিনিটে গোল শোধ করেন মুসা। আবার প্রথমার্ধের ইনজুরি টাইমে(৪৫+১) মেসির গোলের জবাবে পরের মিনিটেই(৪৫+২) গোল করেছিলেন মুসা। অবশ্য দ্বিতীয়ার্ধে মার্কোস রোহোর গোলে জয় তুলে নিয়েছিলো মেসিদের দল।

২০১১ সালে নাইজেরিয়ান প্রিমিয়ার লিগের এক মৌসুমে রেকর্ড ২০ গোল করে আলোচনায় আসেন মুসা। বর্তমানে খেলছেন রাশিয়ান ক্লাব সিএসকেএ মস্কোর হয়ে। অবশ্য তিনি ইংলিশ ক্লাব লিস্টার সিটির চুক্তিভূক্ত খেলোয়াড়। ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত খেলেছেন সিএসকেএ মস্কোর হয়ে। এরপর সেই বছরই সাড়ে ১৬ মিলিয়ন পাউন্ডের ট্রান্সফার ফিতে যোগ দেন লিস্টার সিটিতে। লিস্টারে দুই মৌসুম খেলার পর চলতি বছর জানুয়ারিতে মুসাকে ধারে খেলতে নেয় পুরনো ক্লাব সিএসকেএ মস্কো। রাশিয়ায় দীর্ঘদিন খেলার কারণে দেশটির আলো বাতাসের সাথে ভালোই পরিচয় আছে মুসার। তাই তো মাঠে নেমেই নিজের জাত চিনিয়েছেন তিনি। এখন স্বপ্ন দেখছেন দলকে দ্বিতীয় রাউন্ডে নেয়ার।

নাইজেরিয়ার হয়ে ২০১০ সালে অভিষেক মুসার। সে বছরই ওয়েস্ট-আফ্রিকান নেশনস কাপ জয়ী দলের সদস্য ছিলেন তিনি। খেলেছেন বয়সভিত্তিক দলেও। জাতীয় দলের হয়ে এখন পর্যন্ত ৭৪টি ম্যাচ খেলেছেন মুসা, গোল পেয়েছেন ১৫টি।


আরো সংবাদ



premium cement