২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ক্ষতিকর প্রসাধনী দিয়ে রং ফর্সা করতে চান লাখ লাখ নারী

রং ফর্সা করার জন্যে আছে ক্রিম থেকে শুরু করে ইনজেকশনও - ছবি : সংগৃহীত

আবেগময় কণ্ঠে শিরোমা পেরেইরা বলেন, ‘বিয়ের দিন আমাকে দেখতে সত্যিই খুব খারাপ লাগছিল। এতো খারাপ আর কখনো লাগেনি।’ এটা (শিরোমা পেরেইরা) তার আসল নাম নয়। সামাজিক কারণে এ প্রতিবেদনে তার নাম বদলে দেয়া হয়েছে।

শ্রীলঙ্কায় রাজধানী কলম্বোর কাছেই থাকেন ত্রিশোর্ধ বছর বয়সী শিরোমা। বিয়ের আগে তিনি তার ত্বকের রঙ ফর্সা করতে চেয়েছিলেন। তার মতো দক্ষিণ এশিয়ায় আরো অনেক নারীই তাদের গায়ের রঙ উজ্জ্বল করতে আগ্রহী।

তিনি বলেন, ‘বিয়ের দু'মাস আগে আমি একটি সেলুনে গিয়েছিলাম। রঙ ফর্সা করার জন্য তারা তখন আমাকে একটি ক্রিম দিয়েছিল। দু'সপ্তাহ ব্যবহার করার পর দেখলাম আমার মুখ জ্বলে গেছে। আমি ত্বক ফর্সা করতে চেয়েছিলাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা পুড়ে গেল। আমার মুখে প্রথমে শাদা রঙের ছোপ ছোপ দেখা গেল যা পরে কালো দাগে পরিণত হলো ‘

শিরোমার যখন তার বিয়ের কেনাকাটা ও অনুষ্ঠানে কারা কারা অতিথি হয়ে আসবেন সেদিকে নজর দেয়ার কথা ছিল তখন তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তার ত্বকের চিকিৎসায়। এর পেছনে অনেক অর্থও খরচ হলো তার।

সেলুন থেকে তাকে রং ফর্সাকারী যে ক্রিম দেয়া হয়েছিল সেটি কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত কোনো প্রসাধনী সামগ্রী ছিল না। এ ক্রিম অবৈধভাবে আমদানি করে কালোবাজারে বিক্রি করা হচ্ছিল।

এক বছর ধরে চিকিৎসার পর পেরেইরার গলায় এখনো ওই কালো দাগ রয়ে গেছে। এরকম আরো কিছু অভিযোগ পাওয়ার পর শ্রীলংকার কর্তৃপক্ষ এখন অনুমোদন নেই এরকম রং ফর্সাকারী ক্রিম বিক্রির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে।

কিন্তু এ সমস্যা শুধু শ্রীলঙ্কারই সমস্যা নয়। এশিয়া ও আফ্রিকাতে লাখ লাখ মানুষ, যাদের বেশিরভাগই নারী, গায়ের রং ফর্সা করার জন্যে এমন কিছু ব্যবহার করেন যা শেষ পর্যন্ত তাদের জন্যে ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়।

বাজার

সারা বিশ্বে গায়ের রং ফর্সা করার এই বাজারের আকার ২০১৭ সালে ছিল প্রায় ৪৮০ কোটি ডলার। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৭ সালের মধ্যে এই বাজার দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ৮৯০ কোটি ডলারে।

এর চাহিদা মূলত এশিয়া ও আফ্রিকার মধ্যবিত্ত পরিবারে।

রং ফর্সাকারী এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে সাবান, ক্রিম, ব্রাশ, ট্যাবলেট। এমনকি ইঞ্জেকশনও রয়েছে। মানব দেহে মেলানিন পিগমেন্টের উৎপাদন কমিয়ে দেয় এ ইঞ্জেকশন এবং এগুলো অনেক জনপ্রিয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক হিসেবে দেখা গেছে, আফ্রিকাতে প্রতি ১০ জন নারীর চারজন রং ফর্সাকারী পণ্য ব্যবহার করে থাকেন।

সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় নাইজেরিয়াতে। সেখানে ৭৭% নারী ত্বকের রং উজ্জ্বল করার জন্যে নানা ধরনের প্রসাধনী ব্যবহার করে থাকেন। তার পরেই রয়েছে টোগো, ৫৯% ও দক্ষিণ আফ্রিকা ৩৫%।

এশিয়ায় ৬১% ভারতীয় নারী ও চীনে ৪০% নারী এসব ব্যবহার করেন।

গবেষণায় দেখা গেছে, এসব জিনিসের প্রতি ভোক্তাদের চাহিদাও বাড়ছে। একই সাথে এসব মোকাবেলা করাও কঠিন হয়ে পড়েছে।

গত বছর ঘানাতে কর্তৃপক্ষ গর্ভবতী নারীদেরকে সতর্ক করে দিয়েছিল রং ফর্সাকারী ট্যাবলেট না খাওয়ার জন্যে। কারণ এসব ট্যাবলেটে পাওয়া গেছে এন্টিঅক্সিডেন্ট গ্লুটাথিওন।

গর্ভবতী নারীরা মনে করেন তারা যদি এই ট্যাবলেট খান তাহলে তাদের গর্ভে থাকা সন্তানের গায়ের রং ফর্সা হবে।

এ ধরনের পণ্য মোকাবেলার জন্যে দক্ষিণ আফ্রিকাতে আছে কঠোর কঠোর আইন। গাম্বিয়া, আইভরি কোস্ট ও রোয়ান্ডাতে রং ফর্সাকারী যেসব পণ্যে হাইড্রোকুইনোন আছে সেগুলো নিষিদ্ধ করেছে।

শরীরে মেলানিনের (বাদামী কিম্বা কালো পিগমেন্ট, যার কারণে ত্বকের রঙ নির্ধারিত হয়) উৎপাদন কমিয়ে দেয় হাইড্রোকুইনোন। একই সাথে এটি স্থায়ীভাবে ত্বকের ক্ষতিও করতে পারে।

চিকিৎসা

ব্রিটিশ স্কিন ফাউন্ডেশন বলছে, ‘চর্ম চিকিৎসকদের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে হাইড্রোকুইনোন আছে এরকম পণ্য নিরাপদে ব্যবহার করা যেতে পারে। ত্বকের যেসব স্থানে কালো দাগ পড়ে গেছে সেগুলো এর মাধ্যমে চিকিৎসা করা যায় এবং তাতে ভালো ফল পাওয়াও সম্ভব।’

ব্রিটিশ স্কিন ফাউন্ডেশনের একজন মুখপাত্র এন্টন আলেকজানড্রফ বলেন, রং ফর্সাকারী ক্রিমের কোনো কোনোটি হয়তো সহায়ক। কিন্তু সেটা একজন ত্বক বিজ্ঞানীর পরামর্শে ও তত্ত্বাবধানে ব্যবহার করতে হবে। অন্যথায় সেগুলো বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে।


কার্যকারিতা


তবে ব্রিটিশ স্কিন ফাউন্ডেশন বলছে, "পুরো ত্বক ফর্সা করার নিরাপদ কোন উপায় নেই।"

"দোকানে যেসব ক্রিম বিক্রি হয় সেগুলো যে আসলেই গায়ের রং ফর্সা করে এমন প্রমাণ নেই। এর উল্টো ফলও হতে পারে। এই ক্রিম আপনার ত্বককে অস্বাভাবিক রকমের শাদা অথবা আরো কালোও করে দিতে পারে। এর ফলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে ত্বকের স্বাভাবিক গুণাবলীও," সতর্ক করে দিয়েছেন আলেকজানড্রফ।

তবে ম্যালাসমার মতো কিছু কিছু সমস্যার চিকিৎসার জন্যে চিকিৎসকরা রং ফর্সাকারী পণ্য প্রেসক্রাইব করে থাকেন।

বয়স হলে শরীরে এরকম সমস্যা দেখা দেয়া খুবই সাধারণ বিষয়। এতে ত্বকে বাদামী কিম্বা ধূসর রঙের দাগ তৈরি হয়। বিশেষ করে মুখে। নারীদের দেহে এরকম হওয়ার হার বেশি। বিশেষ করে গর্ভধারণের সময়।

আলেকজানড্রফ বলেন, ‘একজন চর্ম চিকিৎসকের মাধ্যমে ত্বকের রং ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তবে সেজন্যে অনুমোদিত কিছু ক্রিম আছে যা ডাক্তারদের পরামর্শে ব্যবহার করা যেতে পারে।’


পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া

কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে নারীরা চিকিৎসকদের পরামর্শ ও নজরদারি ছাড়াই এসব রং ফর্সাকারী কসমেটিক ব্যবহার করতে শুরু করে দেন। কিন্তু এসব প্রসাধনীর গুরুতর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। যেমন:

১. ত্বকে চুলকানি
২. প্রদাহ
৩. জ্বালাপোড়া
৪. ফুলে যাওয়া
৫. ফুসকুড়ি পড়া


মার্কারি

কিছু কিছু পণ্য যেগুলো দ্রুত রং ফর্সা করার দাবি করে সেগুলোতে নানা রকমের ক্ষতিকর উপাদানও থাকতে পারে। যেসব পণ্যে মার্কারি আছে সেগুলো স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর," বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

কিন্তু তারপরেও মার্কারি আছে এরকম পণ্য চীন, লেবানন. মেক্সিকো, পাকিস্তান, ফিলিপিন, থাইল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত হচ্ছে।

শরীরে মেলানিন গঠনের প্রক্রিয়াকে শ্লথ করে দেয় এ হাইড্রোকুইনোন।

যেসব পণ্যে মার্কারি আছে সেগুলোর বিক্রি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আফ্রিকার বহু দেশে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফিলিপিন ও আরো কয়েকটি দেশ অল্প পরিমাণে মার্কারি আছে যেসব পণ্যে সেগুলো বিক্রির অনুমোদন দিয়ে থাকে।

স্বাস্থ্য

আলেকজানড্রফ বলেন, ‘মার্কারি হচ্ছে বিষ।’ তিনি বলেন, এর ফলে নানা রকমের স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি হতে পারে।

মার্কারি আছে যেসব সাবান ও ক্রিমে সেগুলো ব্যবহার করলে যেসব ক্ষতি হতে পারে। তা হলো:

১. কিডনির ক্ষতি

২. ত্বকে ফুসকুড়ি হওয়া, রং বদলে যাওয়া, কালশিটে দাগ পড়া

৩. ব্যাকটেরিয়া ও ফাংগাল সংক্রমণ প্রতিরোধের ক্ষমতা কমে যাওয়া

৪. উদ্বেগ উৎকণ্ঠা, বিষণ্ণতা, মানসিক অস্থিরতা থেকে বৈকল্য

৫. স্নায়ু-জনিত সমস্যা


ধারণা

মার্কিন ত্বক বিজ্ঞানী শুয়াই জু বলেন, ‘লোকেরা মনে করেন যে ত্বকের ক্রিম সাধারণত নিরাপদ। এর ফলে স্বাস্থ্যের কী ক্ষতি হতে পারে তা নিয়ে তারা চিন্তাও করেন না। এ মানসিকতা পরিবর্তনের প্রয়োজন। আমার কাছে যেসব রোগী আসেন তারা আমাকে বিভিন্ন রকমের ক্রিম দেখান যেগুলো তারা কোনো ধরনের প্রেসক্রিপশান ছাড়াই বাজার থেকে কিনেছেন। সেগুলো দেখে সত্যিই আমি অবাক হয়ে যাই।

তিনি যেখানে পড়ান সেখানে এসব ক্রিমের ব্যবহারের ওপর একটি গবেষণা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে স্টেরয়েড আছে এরকম কিছু কিছু ক্রিম ঠিকমতো ব্যবহার না করলে শরীরের ক্ষতি করতে পারে।


বিপদ

বিপদজনক এসব পণ্যের বিক্রি ঠেকাতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের পক্ষে শুয়াই জু।

তিনি বলেন, ‘ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প যেরকম নিয়ন্ত্রিত, কসমেটিক শিল্প সেরকম নয়। শীর্ষস্থানীয় যেসব কোম্পানি আছে তারা এ ধরনের বিপদজনক পণ্য তৈরি করে না। কিন্তু এধরনের পণ্য যখন বাইরে থেকে আমদানি করে আনা হয় তখনই নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। বাজারে এরকম অনেক জাল পণ্য বিক্রি হচ্ছে, সেগুলো চিহ্নিত করা কঠিন। যারা এসব উৎপাদন করে তাদেরকে পাকড়াও করা সহজ নয়। কিছু কিছু পণ্য আছে যেগুলোতে কী উপাদান আছে সেসবও উল্লেখ করা হয় না। আপনি জানতেও পারেন না কারা এসব উৎপাদন করেছে। পণ্যটি ধরে এর উৎপাদনকারীদের খুঁজে বের করাও সম্ভব হয় না।’

ফলে ত্বকের রং ফর্সা করার এরকম দ্রুত সমাধানের ব্যাপারে লোকজনকে তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন।


সামাজিক আন্দোলন

এসব পণ্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে অনেকে সিনেমা নাটকের মতো বিনোদন শিল্পকে দায়ী করে থাকেন। কারণ এগুলোতে বিশেষ ধরনের শারীরিক কাঠামো ও ত্বকের রং-এর ওপর জোর দেয়া হয়।

আর এর ফলে হুমকির মুখে পড়ে লাখ লাখ নারীর স্বাস্থ্য।

গায়ের রং ফর্সা হতে হবে - এ মানসিকতার পরিবর্তনের জন্যে বিভিন্ন সমাজে নানা ধরনের আন্দোলন চলছে।

ভারতে এরকম এক আন্দোলনের নাম: 'কালোই সুন্দর।'

পাকিস্তানে এরকম এক আন্দোলনের স্লোগান: ‘সুন্দর হতে হলে আপনার ত্বকের রং ফর্সা হতে হবে না।’

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
সচিবালয়ে আগুনের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে ৩ মন্ত্রণালয়ের কমিটি নিহত ফায়ার ফাইটার নয়নের পরিবারে শোকের মাতম এক কার্গো এলএনজি ও এক লাখ ৩০ হাজার টন সার কিনবে সরকার জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক পরিচালক বলরাম পোদ্দার কারাগারে ছুরিকাঘাতে গাজীপুর মহানগর জামায়াত সেক্রেটারি আহত কুলাউড়ায় নিষিদ্ধ পলিথিন রাখায় ২ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা সরকারি কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী দাখিলের সময় বাড়ল দেশে পৌঁছেই যা বললেন মিজানুর রহমান আজহারী অবৈধ বিদেশীদের বৈধতা অর্জনের সময় বেঁধে দিলো সরকার ষড়যন্ত্রে জড়িত কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না : এলজিআরডি উপদেষ্টা ফেসবুকে ১২ দিনের পরিচয়ে প্রেম, গণধর্ষণের শিকার কিশোরী

সকল