ফ্রান্সে নির্বাচন : কারা এই নিউ পপুলার ফ্রন্ট
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৮ জুলাই ২০২৪, ১২:৪৭, আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২৪, ১২:৫০
ফ্রান্সের জনগণ আবারো জানিয়ে দিলো যে, তারা কট্টর ডানপন্থীদেরকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় দেখতে চায় না।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনে বড় জয় পেয়েছিল ডানপন্থীরা। এমনকি, ফ্রান্সের পার্লামেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রেও প্রথম দফায় এগিয়ে ছিল তারা।
কিন্তু রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যে নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করাটা সবচেয়ে বেশি জরুরি ছিল, সেখানেই পিছিয়ে পড়লো কট্টর ডানপন্থীরা।
ফ্রান্সের দ্বিতীয় ধাপের পার্লামেন্ট নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে যে, দেশটির কট্টর ডানপন্থী রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল র্যালি (আরএন) সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি তারা দ্বিতীয় অবস্থানেও নেই।
দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে নাটকীয়ভাবে জয় পেয়েছে বামপন্থী দলগুলোর জোট নিউ পপুলার ফ্রন্ট (এনপিই)।
আর তাদের পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে দেখা যাচ্ছে, ফ্রান্সের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর মধ্যপন্থী দলকে। এর আগে, প্রথম দফার নির্বাচনে প্রায় ৩৩ শতাংশ ভোট নিয়ে এগিয়ে ছিল ন্যাশনাল র্যালি (এনআর)।
এর বিপরীতে, ২৮ শতাংশ ভোট নিয়ে ফ্রান্সের বামপন্থী জোট নিউ পপুলার ফ্রন্ট (এনপিএফ) দ্বিতীয় অবস্থানে এবং প্রায় ২১ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে ছিল ম্যাক্রোঁর নেতৃত্বাধীন অনসম্বল অ্যালায়েন্স।
এই অবস্থায় ডানপন্থীদের ঠেকাতে ফ্রান্সের মধ্যপন্থী ও বামপন্থী দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ।
এরপর আপসের ভিত্তিতে বাম ও মধ্যপন্থী দলগুলোর প্রার্থীদের অনেকেই একে অন্যকে একাধিক আসন ছেড়ে দেন। আর এর ফলেই ডানপন্থীরা পিছিয়ে পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কে কত আসন পেল?
বুথফেরত জরিপের তথ্যে বলা হচ্ছে, ফ্রান্সের পার্লামেন্টের ৫৭৭টি আসনের বামপন্থীদের জোট নিউ পপুলার ফ্রন্ট পেয়েছে ১৮২টি। এরপর ১৬৮টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মধ্যপন্থী জোট অনসম্বল অ্যালায়েন্স। আর কট্টর ডানপন্থী ন্যাশনাল র্যালি জয় পেয়েছে ১৪৩টি আসনে।
বুথফেরত জরিপের ফল আসার পর বাম জোটের অন্যতম শরিক দল সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতা অলিভিয়ের ফাউরে বলেন, ‘ফ্রান্স বলেছে, ন্যাশনাল র্যালিকে ক্ষমতায় যেতে দেয়া হবে না। কারণ এখানে নিউ পপুলার ফ্রন্টের জয় নিশ্চিত হয়েছে।’
এ দিকে, নির্বাচনে পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে ফ্রান্সের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী গ্যাব্রিয়েল আতাল পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। জানা যাচ্ছে, দু’এক দিনের মধ্যেই তিনি পদত্যাগপত্র জমা দিতে পারেন।
অন্যদিকে, ডানপন্থী দল ন্যাশনাল র্যালির নেতা মারি লা পেন বলেন, এবারের নির্বাচনের ফলাফলের মধ্যে তিনি আগামী দিনের বিজয়ের বীজ দেখতে পাচ্ছেন।
দলটির আরেকজন নেতা জর্ডান বারডেলা বাম ও মধ্যপন্থীদের ইঙ্গিত করে বলেন, ‘অস্বাভাবিক’ এবং ‘মর্যাদাহীন’ জোট ফ্রান্সের জনগণকে ‘ন্যাশনাল র্যালির বিজয়’ থেকে বঞ্চিত করেছে।
দ্বিতীয় দফার এই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করতে পারলে জর্ডান বারডেলা ফ্রান্সের পরের প্রধানমন্ত্রী হবেন বলে শোনা যাচ্ছিলো।
কারা এই নিউ পপুলার ফ্রন্ট?
প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ গত ৯ জুন আগাম নির্বাচন ঘোষণা করার পর সোশ্যালিস্ট (সমাজতান্ত্রিক), পরিবেশবাদী, কমিউনিস্ট ও কট্টর বামপন্থী দল ফ্রান্স আনবোয়েড পার্টি (এলএফআই) মিলে নতুন যে জোটটি গড়ে তোলেন, সেটিই ‘নিউ পপুলার ফ্রন্ট’ নামে পরিচিতি পায়।
এই দলগুলো আগে একে অপরের সমালোচনা করত এবং তাদের আদর্শ ও কর্মপদ্ধতির মধ্যেও বেশ ব্যবধান রয়েছে।
তারপরও তারা জোট গঠন করেছে যেন কট্টর ডানপন্থীরা কোনোভাবেই রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে না পারে।
মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কট্টর ডানপন্থী কোনো দল ফ্রান্সের রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসতে পারেনি।
নিউ পপুলার ফ্রন্টের পক্ষ থেকে বর্তমান সরকারের পাশ করা পেনশন ও অভিবাসন বিষয়ক সংশোধিত আইন বাতিলের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।
সেইসাথে অবৈধ অভিবাসীদের ব্যবস্থাপনা এবং ভিসা আবেদনের বন্দোবস্ত করার জন্য একটি সহায়তাকারী সংস্থা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।
এছাড়া জীবনযাপনের ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নির্ধারণ করা এবং ন্যূনতম বেতন বাড়ানোরও ঘোষণাও দিয়েছে বামপন্থীদের নতুন এই জোট।
প্রথম ধাপে ডানপন্থীদের জয় কেন?
ফ্রান্সের প্রবীণ রাজনৈতিক বিশ্লেষক অ্যালাইন ডুহামেল মনে করেন, বেশ কিছু কারণে ফ্রান্সের পার্লামেন্ট নির্বাচনের প্রথম ধাপে মারি লা পেন এবং জর্ডান বারডেলার নেতৃত্বাধীন দল এনআর জয় পেয়েছিল।
তার মতে, ডানপন্থীদের ওই বিজয় ফ্রান্সের ইতিহাসে রীতিমতো একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। কিন্তু ফরাসিরা মারি লা পেন ও জর্ডান বারডেলার নেতৃত্বাধীন দল এনআরকে নির্বাচনের প্রথম দফায় জিতিয়ে দেয়ার মতো এত ভোট দেয়ার প্রকৃত কারণ কী?
ভোট দেয়ার আগে যেসব বিষয় ভোটাররা বিবেচনা করেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, জীবনযাত্রার ব্যয় সংক্রান্ত সঙ্কট, যা তাদের ক্রয় ক্ষমতাকে প্রভাবিত করছে। পাশাপাশি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসুবিধা নিয়ে অনিশ্চয়তা ও ক্রমবর্ধমান অপরাধ নিয়েও শঙ্কিত ছিলেন ফরাসিরা যেটিকে তারা ‘নিরাপত্তাহীনতা’ বলে উল্লেখ করছে।
যদিও সামগ্রিকভাবে ফ্রান্সের অর্থনীতি ভালো। কিন্তু প্রধান শহর থেকে দূরে বসবাস করা মানুষ বলেন যে তারা উপেক্ষিত অনুভব করেছেন, কারণ সমস্ত তহবিল ও মনোযোগ শুধুমাত্র শহরগুলোকে ঘিরে।
ফ্রান্সের কোনো কোনো জায়গায় বেকারত্বের হার অনেক বেশি। এটি ২৫ শতাংশ পর্যন্তও হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
দেশটির অনেকের জন্য আবাসন ব্যবস্থা বেশ ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। বরাদ্দ সংকুচিত করার কারণে কোনো কোনো এলাকার স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে এবং স্থানীয় স্বাস্থসেবা কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকেই বিরক্ত।
অধ্যাপক থমাস পিকেটি বলেন, উপেক্ষিতরাই ডানপন্থীদের দিকে ঝুঁকছে।
সর্বাধিক বিক্রীত ‘ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি’ বইয়ের লেখক পিকেটি চিহ্নিত করেন, ‘ছোট শহরগুলোর শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং পরিষেবা পেতে জনসাধারণকে ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে, ট্রেন লাইনগুলো বন্ধ হয়ে গেছে, হাসপাতালগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। বড় শহরগুলো থেকে দূরে থাকলে আপনার শিশুদের শিক্ষিত করা কঠিন।’
৩৭ বছর বয়সী পরিচ্ছন্নকর্মী অরেলি দুই সন্তানের মা, যিনি উত্তর ফ্রান্সের অ্যামিয়েন্স শহরে থাকেন। তিনি বলেন, এনআর-এর নীতির সাথে তিনি একমত, মূলত যে কারণে সেটি হলো ‘নিরাপত্তা’। আমি প্রতিদিন ভোর সাড়ে ৪টায় ঘুম থেকে উঠে কাজের জন্য বের হই। এক সময় আমি অ্যামিয়েন্সের রাস্তায় সাইকেল চালাতে বা হাঁটতে পারতাম। কিন্তু এখন আর পারি না। এখন আমাকে গাড়ি ব্যবহার করতে হয়। কারণ এসব রাস্তাজুড়ে সবসময় যুবকরা ঘোরাফেরা করে এবং আমি এই বিষয়টি নিয়ে ভয় পাই।’
প্যারিসের পূর্ব দিকের শহর পন্টাল্ট-কম্বল্ট শহরের প্যাট্রিক এনআর-কে ভোট দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মানুষ এখন পরিবর্তন চায়, সেজন্য তারা ভোট দিতে আগ্রহী। তারা যখন রাস্তাঘাটে অনিরাপদ বোধ করে, তখন তারা খুশি হয় না।’
এছাড়াও, পেনশন নিয়ে ভোটাররা চিন্তিত। কারণ গত বছর ম্যাক্রোঁ আইন পাশ করে পেনশনের বয়সসীমা ৬২ থেকে ৬৪ বছরে উন্নীত করেন। ম্যাক্রোঁর সরকারের জনপ্রিয় সংস্কারগুলোর মাঝে এটি ছিল অন্যতম। কিন্তু ম্যাক্রোঁ বলেছিলেন যে পেনশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়া ঠেকাতে এই সংস্কার অপরিহার্য ছিল। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি ও ঘর গরম করার জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাসও ভোটারদের কাছে উদ্বেগের বিষয়।
এনআর নেতা জর্ডান বারডেলা বলেন যে, ক্ষমতায় গেলে তারা জ্বালানি ও ১০০টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর থেকে ভ্যাট কর্তনের বিষয়ে মনোনিবেশ করবেন। শুধু তাই নয়, তারা কয়েক মাসের মাঝে পেনশন ব্যবস্থাও সংস্কার করবেন বলেও ঘোষণা দিয়েছিলেন।
তাছাড়া বহু বছর ধরে ন্যাশনাল র্যালির নেতা মারি লা পেন তার দলকে মূলধারায় আনতে ও ভোটারদের কাছে দলকে আরো গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য কাজ করেছেন।
সব মিলিয়ে প্রথম ধাপে বড় জয় পেয়েছিল মারি লা পেন ও জর্ডান বারডেলার ডানপন্থী দল ন্যাশনাল র্যালি (এনআর)। তবে দ্বিতীয় ধাপে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত ফ্রান্সের রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে পারছে না তারা।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা