জার্মানি পেনশন ব্যবস্থা কিভাবে ঠিক হবে
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৭ মার্চ ২০২৪, ১৩:০১
জার্মানিতে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এদিকে কর্মজীবীদের সংখ্যা কমছে। পেনশন বা অবসরকালীন ভাতা ব্যবস্থাকে ভবিষ্যতের উপযুক্ত করার জন্য নতুন পরিকল্পনা রয়েছে, কিন্তু সমালোচকেরা বলেছেন সেগুলো হয়তো ভবিষ্যতে কাজ করবে না।
জার্মানির অনেক মানুষ অবসর নিচ্ছেন। ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণকারীরা মূলত অবসর নিচ্ছেন। তখন জন্মহার সর্বকালের সর্বোচ্চ ছিল, তারা দীর্ঘজীবী। তবে কর্মশক্তির হার অনেক কমেছে। তাহলে বয়স্ক মানুষদের অবসরকালীন ভাতা কে দেবে?
জার্মানির অবসরকালীন ভাতার ব্যবস্থাটি ১৮৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। পাবলিক রিটায়ারমেন্ট ইন্স্যুরেন্স প্রকল্পের ওপর ভিত্তি করে বর্তমানে কর্মরতদের কাছ থেকে বিমার অবদানের টাকা ব্যবহার করে অবসরপ্রাপ্তদের পেনশন দেয়া হয়। এই সিস্টেম ‘আন্তঃপ্রজন্ম চুক্তি’ নামে পরিচিত।
ষাটের দশকের শুরুতে প্রত্যেক বয়স্ক-অবসরভাতাভোগীর জন্য ছয়জন সক্রিয় কর্মী ছিলেন, যারা বিমায় অবদান রাখতেন। এখন সেই অনুপাত ২:১। এ সংখ্যাটা আরো কমে যাচ্ছে।
ফেডারেল বাজেটের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ অবসরকালীন ব্যবস্থাকে বজায় রেখে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ১২৭ বিলিয়ন ইউরো ২০২৪ সালে অবসর তহবিলে প্রবাহিত হবে, যা সমস্ত সরকারি ব্যয়ের এক তৃতীয়াংশ। এই যোগফল ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় দ্বিগুণ হবে বলে অনুমান করা হয়েছে। প্রতিরক্ষার মতো অন্যান্য ক্ষেত্রে উচ্চ ব্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে এটি নেতিবাচক।
একই সময়ে, পেনশনভোগীরা উল্লেখযোগ্য এবং ক্রমবর্ধমান ভোটার ভিত্তি গঠন করে। তাই পেনশন ব্যবস্থা রক্ষা করা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
জার্মানির তিন-দলীয় মধ্য-বাম জোট সরকার পেনশন কমাতে চায় না, পেনশনের অবদান বাড়াতে চায় না।
নতুন ‘প্রজন্মের পুঁজির’ পরিকল্পনা
সমস্যা সমাধানের জন্য নিওলিবারেল ফ্রি ডেমোক্র্যাটসের (এফডিপি) অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়ান লিন্ডনার ফেডারেল সরকারের জন্য প্রাথমিকভাবে এক হাজার ২০০ কোটি ইউরো ঋণ নেয়ার এবং শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়ে এসেছেন।
বিশেষ করে জনগণের স্বাধীন প্রতিষ্ঠান তথাকথিত ‘জেনারেশন ক্যাপিটাল’-এর মাধ্যমে তহবিল তৈরি করে পরিচালনা করতে হবে। যা রিটার্ন দেবে এবং প্রথম রাষ্ট্রীয় অর্থভাণ্ডারে লাভসহ বিশ্বব্যাপী বহুমুখী ভিত্তিতে শেয়ারে বিনিয়োগ করবে।
সামাজিক যোগযোগমাধ্যম এক্স প্ল্যাটফর্মে (সাবেক টুইটার) লিন্ডনার লেখেন, ‘এক শতকেরও বেশি সময় ধরে পুঁজিবাজারের প্রস্তাবিত সুযোগগুলো আশপাশে পড়ে ছিল। এখন আমরা এই সমাজের ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ করছি।’
২০৩০ সালের মাঝামাঝি নাগাদ বিধিবদ্ধ অবসরভাতার প্রকল্পকে সমর্থন করার জন্য স্টকের মূল্য কমপক্ষে ২০ হাজার ইউরো হওয়া উচিত।
প্রধান বিরোধী দল মধ্য-ডান ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটস (সিডিইউ) এই পরিকল্পনাকে অকার্যকর বলে সমালোচনা করেছে।
জার্মান সংসদের শ্রম ও সামাজিকবিষয়ক কমিটির ডেপুটি চেয়ারম্যান এক্সেল ন্যোরিগ ইপেনডট মিডিয়াকে বলেন, ‘তথাকথিত পেনশন প্যাকেজ ২ অর্থাৎ রেন্টেনপাকেট স্যোয়াই কোনোভাবেই দীর্ঘমেয়াদিভাবে অবসরকালীন ভাতার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেবে না।’
তার মতে, ‘এটা ভবিষ্যতে ক্রমবর্ধমান অবদানের দিকে পরিচালিত করবে, যা কর্মীদের জন্য একটি অতিরিক্ত বোঝা হয়ে উঠবে।’
যদিও সিডিইউ সুদের মাধ্যমে অতিরিক্ত আয়ের জন্য পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ধারণার মৌলিকভাবে বিরোধিতা করে না। আক্সেল উল্লেখ করেছেন, বর্তমান পরিকল্পনা অতিরিক্ত ঋণের বোঝা শোধ করতে কোনো উল্লেখযোগ্য রিটার্ন দেয় না।
স্টক মার্কেটে বিনিয়োগও ঝুঁকিমুক্ত নয়, তবে জার্মান অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতে, ফাউন্ডেশনের সম্পদ রক্ষার জন্য নিরাপদ এলাকা স্থাপন করা হবে।
জার্মান ইক্যুইটিজ ইনস্টিটিউট অনুসারে, বিস্তৃতভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ ইক্যুইটি বিনিয়োগ প্রতিবছর ছয় থেকে আট শতাংশ রিটার্নের গড় দেয়।
অর্থমন্ত্রী লিন্ডনার বলেন, তিনি তিন বা চার শতাংশের বেশি রিটার্ন আশা করেন।
জার্মানির বিধিবদ্ধ অবসরকালীন ভাতার ব্যবস্থা যেমন
জার্মানিতে অবসরকালীন ভাতার প্রকল্পকে বিধিবদ্ধ পেনশন বীমা হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। এটা শুধু কর্মজীবীদের জন্য বাধ্যতামূলক। স্ব-উপার্জিত (সেলফ এমপ্লয়েড) ব্যক্তিরা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অর্থ প্রদান করতে পারে বা সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিগত বিমা প্রকল্পের ওপর নির্ভর করতে পারে। সাধারণ কর্মচারীদের নিজস্ব অবসরকালীন ভাতার ব্যবস্থা আছে। এই দুটি গোষ্ঠী কর্মরত জনসংখ্যার প্রায় ১২ শতাংশ।
অনেক বামপন্থী রাজনীতিবিদ জোর দিয়ে বলছেন, রাষ্ট্র পরিচালিত ব্যবস্থাকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় হলো উচ্চ বেতনভোগী গোষ্ঠীর সকল সদস্যকে রাষ্ট্রীয় অবসর তহবিলে অর্থ দিতে বাধ্য করা।
একজন কর্মচারীর মোট মাসিক বেতনের ১৮ দশমিক ছয় ভাগ রাষ্ট্রীয় অবসর তহবিলে যায়। কর্মী এবং নিয়োগকর্তা প্রত্যেকে অর্ধেক অর্থ প্রদান করে। মাসিক অবদান এক হাজার ৪০৪ ইউরো ৩০ সেন্টের বেশি হতে পারে না।
সরকারের আশা, এই আর্থিক অবদানের হার দুই হাজার ২৮ থেকে ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। ২০৩৫ সালের মধ্যে ২২ দশমিক তিন শতাংশ হবে, এটা ২০৪৫ সাল পর্যন্ত থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বর্তমান ‘অবসরকালীন ভাতার স্তর’ অর্থাৎ প্রতিমাসে অবসরপ্রাপ্তদের দেয়া টাকার পরিমাণ জার্মানিতে গড় মাসিক বেতনের ৪৮ শতাংশ। এই পরিমাণ টাকা ফেডারেল সরকার ‘স্তরের সুরক্ষা ধারা’-সহ ২০৪০ সাল পর্যন্ত আইনে গ্যারান্টি দিতে চায়।
২০২৩ সালে জার্মান অবসরকালীন ভাতার বীমা অনুসারে, জার্মানিতে গড়ে মাসিক বার্ধক্য অবসরভাতা ছিল এক হাজার ৫৫০ ইউরো অর্থাৎ প্রায় এক লাখ ৫৫ হাজার টাকা।
রাষ্ট্রীয় অবসর ভাতা যথেষ্ট না হলে কী হবে?
জার্মান পেনশন ইন্স্যুরেন্সের বর্তমান পরিসংখ্যান অনুযায়ী পেনশনভোগীদের ৬১ শতাংশ তাদের বিধিবদ্ধ রাষ্ট্রীয় পেনশন থেকে প্রতি মাসে এক হাজার ২০০ ইউরোর কম অর্থ পান। তিনজনের মধ্যে একজন পেনশনভোগী ৭৫০ ইউরোর তুলনায় কম অর্থ পান।
জার্মানিতে অনেক নারীই অনেক কম পেনশন পান বা একেবারেই পান না। এর কারণ তারা কম বেতনের চাকরিতে কাজ করতেন। অনেকে গৃহবধূ হিসেবে বছরের পর বছর শুধু বাড়ি সামলে গিয়েছেন। সন্তান মানুষ করার জন্য দীর্ঘ সময় কাজে ফেরেননি।
বহু বছর পর শ্রমবাজারে পুনঃপ্রবেশ করা সহজ নয় এবং অনেকের জন্য অবসরকালীন ভাতার পরিমাণ যথেষ্ট নয়। তারা এর পরিপূরক বা রাষ্ট্রীয় কল্যাণ সুবিধা পেতে কাজ করে।
সারা ভাগেনেখট বাম দলের সাবেক রাজনীতিবিদ। চলতি বছরে নিজস্ব জনপ্রিয় দল বিএসডাব্লিউ প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। সারা ঘোষণা করেছেন, তিনি আসন্ন নির্বাচনে অবসরকালীন ভাতার সুরক্ষার বিষয়ে প্রচারণা চালাতে চান। তার জোট হবে ‘জার্মান পেনশনভোগীদের কণ্ঠস্বর’।
মার্চ মাসে আউগসবুর্গার আলগেমাইনে জাইটুং পত্রিকাকে বলেন, ‘অবসরকালীন ভাতা সম্ভবত আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় সামাজিক সমস্যা। কয়েক দশক ধরে আর্থিক অবদান থাকা সত্ত্বেও অনেক লোক কম পরিমাণে অর্থ পান। এটা একটি আর্থ-রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি।’
সরকার-চালিত সংবিধিবদ্ধ অবসরকালীন ভাতার বীমা ব্যবস্থার পাশাপাশি ব্যক্তিগত কোম্পানির পরিকল্পনা এবং ব্যক্তিগত অবসর বিনিয়োগ পরিকল্পনার জন্য বিভিন্ন বিকল্প রয়েছে।
অবদানমূলক কর্মসংস্থানের সময়কালের পাশাপাশি শিশুদের লালন-পালন, শিক্ষা, বেকারত্ব বা অসুস্থতার সময় ব্যয় করা অর্থও পেনশনের জন্য গণনা করা হয়।
যে বিদেশীরা ৬০ মাসেরও বেশি সময় ধরে জার্মানিতে কাজ করেছেন, আর্থিক অবদান রেখেছেন, তারা জার্মান সরকারের অবসরকালীন বয়সে পৌঁছানোর পরে ভাতা পাওয়ার অধিকারী।
সূত্র : ডয়চে ভেলে