আরএএফ : জার্মানিতে সন্ত্রাসবাদের অমীমাংসিত এক অধ্যায়
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১২ মার্চ ২০২৪, ০৯:৫৪
রেড আর্মি ফ্যাকশন (আরএএফ) ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে জার্মানিকে নাড়িয়ে দিয়েছিল বামপন্থD এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি। বিলুপ্তির আড়াই যুগ পরেও এখনো তাদের নিয়ে কূল-কিনারা করতে পারেনি জার্মানির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
জার্মানিতে আজও আরএএফ নিয়ে কথা বলা তুমুল বিতর্কের এক বিষয়। ফেডারেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ন্যান্সি ফেজা ফেব্রুয়ারির শেষে বলেছেন, আরএএফ-এর অপরাধ আজও ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানিতে বামপন্থী চরমপন্থা এবং বামপন্থী সন্ত্রাসবাদের বিপদের অনন্য উদাহরণ।
সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি নিজেদের বিলুপ্ত ঘোষণার পর ২৫ বছরের বেশি অতিক্রান্ত হয়েছে। তারপরও আরএএফ-এর সদস্যদের নিয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর অজানা রয়ে গেছে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শেষে আরএএফ-এর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে সবশেষ জড়িতদের খোঁজে অনুসন্ধান শুরু করেছে পুলিশ।
আরএএফ-এর গোড়াপত্তন হয় ১৯৭৭ সালের দিকে। যদিও তার আগেই ফ্রাঙ্কফুর্টে বামপন্থী গেরিলাদের তৎপরতা শুরু হয়। বিভিন্ন জায়গায় ডিপার্টমেন্ট স্টোরে তারা অগ্নিসংযোগ ঘটায়। এসব ঘটনায় জড়িত হিসেবে আন্দ্রেয়াস বাডাকে অভিযুক্ত করা হয়। ১৯৭০ সালে তিনি জেল পালিয়ে আরএএফ-এর জন্ম দেন। তিনি ছাড়াও শুরুর দিকে দলটির গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মধ্যে ছিলেন উলরিকে মাইনহফ এবং গুডরুন এনসলিন। সবচেয়ে উল্লেযোগ্য দুই নেতার নামে তখন দলটি পরিচিত ছিল ‘বাডা-মাইনহফ গ্রুপ’ নামে।
কুখ্যাত ব্যক্তিরা
১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত দলটি জার্মানিতে অসংখ্য হামলা চালায় তারা, যেসব ঘটনায় ৩৫ জন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও ছিলেন।
১৯৭৭ সালে তাদের হাতে নিহত হয়েছেন দেশের চিফ প্রসেকিউটর সি সিগফ্রিড বুবাক, ড্রেসডনার ব্যাংকের প্রধান ইয়্যরগেন পন্টো। দ্বিতীয় প্রজন্মের আরএএফ সদস্যদের হাতে অপহৃত হন পশ্চিম জার্মানির জাতীয় কর্মী সংস্থার প্রধান হান্স মার্টিন শ্লেয়ার এবং নাৎসি জার্মানির প্রধান আধাসামরিক সংস্থা এসএস-এর একজন সাবেক কর্মকর্তা। আরএএফ-এর বন্দী নেতাদের মুক্ত করা ছিল তাদের লক্ষ্য। কিন্তু এ চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর আরএএফ-এর তিন নেতা আন্দ্রেয়াস বাডা, গুডরুন এনসলিন এবং ইয়ান-কার্ল রাসপে জেলখানায় আত্মহত্যা করেন। অন্যদিকে অপহরণের ৪৪ দিনের মাথায় হান্স মার্টিন শ্লেয়ারকে হত্যা করা হয়।
এর বাইরেও তাদের হাতে নিহত হয়েছেন কোম্পানির গাড়িচালক, দেহরক্ষী, সাধারণ পুলিশ কর্মকর্তারা। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে ১৯৭৭ সালের হেমন্তে জার্মানিতে অচলাবস্থা নেমে এসেছিল। মহাসড়কগুলোতে নিয়মিত যানবাহনে তল্লাশি এবং বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র পুলিশ সদস্যদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। পুরো দেশের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল।
১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের আরএএফ সদস্যরা তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখে। জার্মানিতে মার্কিন ঘাঁটিগুলোকে তারা একের পর এক লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। ১৯৯৮ সালের বসন্তে দলটি দীর্ঘ একটি চিঠি প্রকাশ করে নিজেদের বিলুপ্ত ঘোষণা করে।
যেসব প্রশ্নের উত্তর নেই
তবে অপরাধীদের খোঁজে অনুসন্ধান অব্যাহত রাখে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ১৯৭০ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সংগঠিত বেশিভাগ অপরাধের এখনো কোনো সুরাহা করতে পারেনি তারা। যেসব আরএএফ সদস্যরা গ্রেফতার হয়েছেন বা যাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে তাদের কাছ থেকে সংগঠনটির সাথে সম্পৃক্ততার বিষয়ে কোনো বিবৃতি পাওয়া যায়নি। আর তাই আরএএফ আর তার রক্তপাতের বিচারকাজের অধ্যায়ের এখনো ইতি ঘটেনি।
যেসব প্রশ্নের উত্তর এখনো মেলেনি তার মধ্যে অন্যতম হলো ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা বিভাগের কী ভূমিকা ছিল।
হামবুর্গের রাজনীতি বিশেষজ্ঞ ভলফগাং ক্রাউশার মনে করেন, গোয়েন্দা বাহিনীর অ্যাজেন্ট পিটার উরবাখ এক্ষেত্রে মূল চরিত্রের ভূমিকায় ছিলেন।
২০১৮ সালে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘অমীমাংসিত হলেও উরবাখ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন, যা প্রতিবাদের ছোট কিন্তু কঠিন একটি নিউক্লিয়াসকে একটি উগ্রবাদী দল এবং নেটওয়ার্কে রূপ দিয়েছিল, যা পরবর্তীতে সন্ত্রাবাদের আকার পেয়েছে।’
তিনি বলেন, উস্কানিদাতা হিসেবে উরবাখ বামপন্থী বিক্ষোভকারীদের মোলোটভ ককটেল এবং আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহ করেছিলেন।
ফেব্রুয়ারির শেষে তৃতীয় প্রজন্মের সন্দেহভাজন আরএএফ সন্ত্রাসী সন্দেহে ডানিয়েলা ক্লেটেকে গ্রেফতারের পর তাদের নিয়ে আবারো নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই আরএএফকে নিয়ে মন্তব্য করেছেলিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ন্যান্সি ফেজা। দলটিকে ঘিরে এখন অধিকতর তদন্ত সম্ভব বলে জানিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘আরএএফ-এর হাতে হতাহত হওয়াদের পরিবারকে জবাব দেয়ার এই ঋণ আমাদের রয়ে গেছে।’
আরএএফকে কম-বেশি মোকাবিলা করতে হওয়া ১৫তম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তিনি। সম্ভবত তিনি এই অধ্যায়ের ইতি টানতে পারা শেষ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন না।
সূত্র : ডয়চে ভেলে