২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

‘দেশের প্রতিটি সংবেদনশীল মানুষের অন্তরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে’

‘দেশের প্রতিটি সংবেদনশীল মানুষের অন্তরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে’ -

- দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে এই আন্দোলন ঘিরে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। ইতোমধ্যে কোটা বাতিল করে আপিল বিভাগ রায়ও দিয়েছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফলে চলমান এ পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন দেশের জনপ্রিয় কয়েকজন শোবিজ তারকা। লিখেছেন আলমগীর কবির

আবুল হায়াত : আমি খুব মর্মাহত। গত বৃহস্পতিবার আমি কেঁদেছিলাম। মৃত্যুর খবরে আমার কান্না থামাতে পারছিলাম না। বাচ্চাগুলোর একটার পর একটা মৃত্যুর খবর আসছিল, আমার কান্না কিছুতেই আটকে রাখতে পারিনি। আমি অসুস্থ, এখন বেশির ভাগ সময় বাসায় থাকি, কোথাও বের হই না- আমি তো ভাবতেই পারি না, ছোট ছোট বাচ্চার সাথে এমনটি হতে পারে! আমাদের পুলিশ বাহিনী তাদের সামনে দাঁড়ানো কাউকে এভাবে মারবে, এটি কল্পনারও অতীত। অনেক কিছু মনে আসে, লিখিও না, বলিও না- চুপচাপ থাকি কিন্তু আমাদের সহ্যেরও তো একটা সীমা আছে। মনেরও তো কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা থাকে। ওই দিন (বৃহস্পতিবার) কী যে কান্না কেঁদেছি, আমার মেয়েরা আমাকে ফোন করে কত সান্ত¡না দিয়েছে। বলেছে, কেঁদে কী লাভ, কেঁদে কী-ই-বা করবে কিন্তু তারপরও আমি কেঁদেছি। না কেঁদে থাকতে পারিনি। আমাদের বিল্ডিংয়ের একটি ফ্ল্যাটের একটা ছেলে মারা গেছে, ফারহান ফাইয়াজ। ওর মা-বাবা এবং আমরা একই বিল্ডিংয়ে থাকি। পুরো পরিস্থিতি নিয়ে আমার বলার কিছু নেই। সরকার অনেক দেরি করে ফেলেছে। যেটা এক দিনে সমাধান সম্ভব ছিল, সেটা তারা অনেক সময় নিয়ে করল- কষ্টটা এখানেই লাগে। সেই একই সমাধানে তো এলো তারা, যেটি বলেছিল সম্ভব না, সেটিই তো তারা এক দিনের ব্যবধানে করল! সুতরাং এটি সে দিনই সম্ভব ছিল, প্রথম দিন না হলে দ্বিতীয় দিনে সম্ভব হতো। এ জন্যই বলি, সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়। অনেক কষ্ট পেয়েছি। আমি আসলে এই কষ্ট প্রকাশ করতে পারব না। আমার চোখ এখনো ছলছল করছে। আমি এমন মৃতু্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারিনি।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী : আপনারা যারা ভাবছেন আন্দোলনটা স্রেফ একটি চাকরির জন্য, তারা বোকার স্বর্গে আছেন। আপনারা এর সবগুলো সে­াগান খেয়াল করেন। দেখবেন, এই আন্দোলন নাগরিকের সমমর্যাদার জন্য। এই আন্দোলন নিজের দেশে তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে না বাঁচার জন্য। এই আন্দোলন রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা আছেন তাদের মনে করিয়ে দেয়ার জন্য যে, দেশের মালিক তারা না। আসল মালিক জনগণ। সেই জনগণকে রাষ্ট্র যে পাত্তা দেয় না, এই আন্দোলন সেটার বিরুদ্ধেও একটি বার্তা। রাষ্ট্র জনগণকে কেন পাত্তা দেয় না এই আন্দোলনকারীরা সেটিও বোঝে। যে কারণে ভোটের বিষয়টিও সে­াগান আকারে শুনেছি। আমি এটিকে এভাবেই পাঠ করছি। পাবলিক সারভেন্ট শব্দটি বেশ ভালো। নির্বাচিত প্রতিনিধি বা যেকোনো সরকারি বেতনভুক্ত ব্যক্তিকে এই শব্দেই ডাকা উচিত সবসময়। এই আন্দোলন সেই পাবলিক সারভেন্টদের মনে করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে, আপনি আমার কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। অল পাওয়ার টু দ্যা পিপল। অল পাওয়ার টু দ্যা ইয়ুথ। প্রেয়ারস ফর মাই ফেলো সিটিজেনস। শহীদের রক্ত কখনো বিফলে যায় না।

সৈয়দ আবদুল হাদী : ক’দিন থেকে ঘুমাতে পারছি না। নানা এলোমেলো স্মৃতি, চিন্তা মস্তিষ্ককে ক্রিয়াশীল করে রাখছে। একসময় আমার বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার করার শখ ছিল। একবার আমি ও কাদেরি কিবরিয়া (রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী) ভোলার এক দুর্গম জায়গায় রাজহাঁস শিকার করতে গেলাম। দুটো রাজহাঁস দেখতে পেলাম। গুলি করলাম। একটি পড়ে গেল, অপরটি দাঁড়িয়ে রইল। পাখিটাকে আনতে এগিয়ে গেলাম কিন্তু তার সঙ্গী পাখিটি দুই ডানা বিস্তার করে আগলে রাখল। কিবরিয়া বন্দুক তাক করল মারার জন্য। তাকে সঙ্গে সঙ্গে নিবৃত্ত করলাম। এমন ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও সাহস মনুষ্য সমাজেও বিরল। এ দৃশ্য আমি আজো ভুলিনি। সে দিন থেকে আমিও শিকার করা ছেড়ে দিয়েছি। ক’দিন থেকে সেই দৃশ্য এবং সেই সাথে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অকুতোভয় তরুণ শিক্ষার্থী আবু সাঈদের বন্দুকের সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যটি এসে ভিড় করে। হৃদয় কেঁদে ওঠে, ঘুম চলে যায়। মাথার ভেতর প্রশ্ন এসে পীড়া দেয়, স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরও এই দৃশ্য দেখতে হলো? কী অপরাধে এতগুলো তরুণ প্রাণকে মা-বাবার বুক শূন্য করে, অকালে ঝরে যেতে হলো। আমার দীর্ঘ জীবনে একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া এমন মৃত্যুর মিছিল তো দেখিনি। এটা তো আমেরিকার গৃহযুদ্ধও নয় বা ফরাসি বিপ্লব নয়। একটি হিন্দি গানের কয়টি চরণ মনে পড়ল- ‘এটা কী হলো, কী করে হলো, কেন হলো, যা হবার হয়েছে, যেতে দাও...।’ না- যা হবার হয়েছে, যেতে দাও বলে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। আমাদেরকে এ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। নিজেদেরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। সন্দেহ নেই দেশের প্রতিটি সংবেদনশীল মানুষের অন্তরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। সন্তান হারানো প্রত্যেক পিতা-মাতার প্রতিটি অশ্রুফোঁটার মূল্য দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ, সমাজের সর্বক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাসের প্রতিফলনই পারে এই মূল্য পরিশোধ করতে।

মোশাররফ করিম : আধুনিক সময়ে এসে দেশের এমন স্থবির অবস্থা একেবারেই কাম্য নয়। আমরা আশা করব, দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে। দেশ আবার আগের মতো সুন্দর ও স্বাভাবিক হবে। কারফিউর এই সময়ে তো সব কাজ বন্ধ। বাসায় বসে বই পড়ে, টিভিতে খবর দেখে সময় কাটছে। মানুষ এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নির্ভর হয়ে পড়েছে। এখন তারা সেই মাধ্যম থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এতে করে কিছুটা অন্ধকারে বসবাসের মতো মনে হচ্ছে তাদের কাছে। ফলে তারা বেশ উৎকণ্ঠা নিয়ে বসবাস করছে। আমার কাছের অনেক মানুষের মধ্যেও এটা লক্ষ করছি। ইন্টারনেটনির্ভর এই পৃথিবীতে দেশে ইন্টারনেট না থাকায় যাপিত জীবনেও বেশ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অনেকেই বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল দিতে পারছেন না। ফলে তারা অবর্ণনীয় দুর্ভোগে জীবনযাপন করছেন। তবে আমি বলব, এর একটা ইতিবাচক প্রভাবও পড়েছে। মানুষের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নির্ভরশীলতা কমে আসছে। জীবনকে নতুনভাবে উপলব্ধি করা হচ্ছে। অনেকেই বই পড়ায় ফিরে গিয়েছে।

মেহজাবীন চৌধুরী : ছাত্র-ছাত্রীরা কি-ই বা করেছিল? তারা তাদের অধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছিল। কোটা সংস্কারের দাবি তুলেছিল। তাই তো? একটি গণতান্ত্রিক দেশে স্বঅধিকারের দাবি যে কেউ তুলতে পারে। কিন্তু তাই বলে নারীর গায়ে হাত তোলা, ‘আবু সাঈদ’-এর মতো সম্ভাবনাময় তরুণকে হত্যা করা- এসব কি সভ্যতার পর্যায়ে পড়ে? সমাধানের অন্য কোনো উপায় কি ছিল না? গুলি কেন করতে হলো? পরিস্থিতি হয়তো আজ কিংবা কাল স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু যে মায়ের বুক খালি হলো, যে পরিবারের মুখের হাসি চলে গেল, আমরা কি সেই শূন্যতা অন্য কিছুর বিনিময়ে পূর্ণ করতে পারব? কখনো না। তাছাড়া ইতিহাস সাক্ষী : শক্তি যত বড়ই হোক, ছাত্রসমাজের ওপর চড়াও হয়ে যুগে যুগে কেউ কখনো কিছুই অর্জন করতে পারেনি। তাহলে কেন এই ব্যর্থ আস্ফালন? দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, প্রশ্নপত্র ফাঁস থেকে দুর্নীতি- প্রায় সব ইস্যুতেই তো আমরা চুপ থাকি। রক্ষক ভক্ষক হয়ে গেলেও আমরা নীরবে সয়ে যাই। অপেক্ষা করি, হয়তো একটা না একটা সমাধান আসবে। আজ না হলেও দু’দিন পরে আসবে। অন্যান্য ইস্যুতে আমরা সামাজিক মাধ্যমেও এতটা সোচ্চার হই না। তাহলে ইদানীং কেন হচ্ছি? কেন কোটা সংস্কার ইস্যুতে দলমত নির্বিশেষে আমাদের মতো সাধারণ জনগণ সরকারের পদক্ষেপের নিন্দা করছি? কারণ একটাই : কোটা সংস্কার এখন সময়ের দাবি।


আরো সংবাদ



premium cement