২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

একজন কিংবদন্তির বিদায়

গাজী মাজহারুল আনোয়ার -

প্রখ্যাত গীতিকার ও পরিচালক গাজী মাজহারুল আনোয়ার গতকাল সকাল ৭টা ৫৫ মিনিটে মারা গেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। এটি নিশ্চিত করেছেন তার ভাগনে অভিনেতা শাহরিয়ার নাজিম জয়।
মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৯। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের স্ত্রী জোহরা গাজী জানান, আগের দিন রাত ১২টা পর্যন্ত তার সঙ্গে এবং ছেলে উপলের সঙ্গে গল্প করেছেন। সকাল ৬টায় অসুস্থ অনুভব করলে তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন। তার ছেলে উপল জানান, আজ সকাল ৮টায় হাসপাতাল থেকে রাজধানীর বারিধারা পার্ক রোডে তার বাসায় নিয়ে যাওয়া হবে। তারপর সেখান থেকে সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে রওনা দিয়ে শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে বেলা ১১টায় সর্বস্তরের মানুষের শেষশ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তার মরদেহ রাখা হবে। সেখানে গার্ড অব অনার প্রদানের পর নিয়ে যাওয়া হবে বিএফডিসিতে দুপুর ১২টা ৩০ মিনিটে। সেখানে বাদ জোহর নামাজে জানাজা শেষে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে রাজধানীর গুলশানের আজাদ মসজিদে। সেখানেই বাদ আছর মূল জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে তারই মায়ের কবরে তাকে দাফন করা হবে, জানালেন উপল। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের জন্ম কুমিল্লার দাউদকান্দি থানার তালেশ্বর গ্রামে। যুগের পর যুগ গানের অনুপ্রেরণার পৃথিবীতে গাজী মাজহারুল আনোয়ার লিখে গেলেন অনবদ্য এক ইতিহাস। প্রায় ৩০ হাজার গান লিখেছেন তিনি। যা অবিশ্বাস্য, বিস্ময়কর ও অসাধারণ এক সাফল্য। একটি বিশ্বরেকর্ডও। পৃথিবীতে আর কোনো গীতিকবি এত গান লিখেছেন বলে তথ্য পাওয়া যায় না। ২০২০ সালে নিজগৃহে এক ঘরোয়া আড্ডায় এমনটাই জানিয়েছিলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, প্রকৃতি, জীবনবোধ, পেপ্র, বিরহ, স্নেহ; অনুভূতির বৈচিত্রময় প্রকাশে গেল কয়েক দশক ধরেই এ দেশের মানুষের কাছে খুব প্রিয় গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা গান। অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা তিনি। বিবিসি বাংলার তৈরি করা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০টি বাংলা গানের তালিকায় রয়েছে তার লেখা তিনটি গান। এটাও এক বিরল সম্মাননা বটে। স্বাধীনতার জন্য ১৯৭১ সালে এ দেশের মানুষের যুদ্ধটা কেবল বন্দুক আর গোলাবারুদের ছিল না। সে যুদ্ধে অনেক বড় হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল সংস্কৃতি। যার মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে গান। সে সময় বহু গান তৈরি হয়েছে; যা দেশের মানুষ ও যোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছে, প্রেরণা দিয়েছে। সেসব গানকে আমরা স্বাধীনতার গান বলি, মুক্তির গান বলি। সে তালিকায় উজ্জ্বল ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটি। ১৯৭০ সালে যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আগুনঝরা যে গানটি তৈরি হয়েছিল আজও তার আবেদন ফুরায়নি। যেকোনো ক্রাইসিস, বিক্ষোভ-বিপ্লবে দাবি আদায়ের হাতিয়ার হয়ে ওঠে এই গান। তবে আফসোস, সবরকম দাবি-দাওয়ার ঊর্ধ্বে চলে গেলেন আজ এ গানের গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার। এ গানটি কীভাবে জন্মেছিল? কী তার প্রেক্ষাপট ও গল্প, জানতে চেয়েছিলাম স্রষ্টার কাছেই। ২০২০ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে নিজগৃহে এক আড্ডায় সেই গল্পটাই জানিয়েছিলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। তিনি বলেছিলেন, ‘১৯৭০ সালের ৭ মার্চ, রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিলেন। দেশের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ল স্বাধীনতার জন্য সেই ডাকে সাড়া দিয়ে। বঙ্গবন্ধু ভাষণ শেষ করলেন ‘জয় বাংলা’ দিয়ে। সেই জয় বাংলার বারুদ ছড়িয়ে গেল সর্বত্র। যেদিন ভাষণ দিলেন সে দিনের সন্ধ্যায় ফার্মগেটে একটি স্টুডিওতে বসে আছি। সেটি তখন খুব বিখ্যাত স্টুডিও। বড় বড় সব গানের মানুষদের আনাগোনা। সেখানে ছিলেন সালাহউদ্দিন স্যার। তিনি আমার স্কুলের স্যার ছিলেন।’ বললেন, ‘জয় বাংলা’ নিয়ে একটা কাজ করতে পারো। এই মুহূর্তে এটা প্রচার করা খুব জরুরি। মানুষকে উৎসাহ দেবে। আমি ভাবতে থাকলাম ‘জয় বাংলা’ নিয়ে কী লেখা যায়। শেষে বাংলা শব্দটা থাকলে ছন্দ মেলাতে কষ্ট হচ্ছে। ভালো শব্দ পাই না। বাংলা, হ্যাংলা....! তারপর সেটাকে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ করে নিলাম। দেখলাম দ্রুতই গান দাঁড়িয়ে গেল। আনোয়ার পারভেজকে ফোন করে বললাম স্টুডিওতে আসতে। সঙ্গে যেন শাহিনকেও (সঙ্গীতশিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ) নিয়ে আসে। আব্দুল জব্বারকেও আসতে বললাম। এ দিকে হঠাৎ ঢুকলেন আলতাফ মাহমুদ। তিনি দেখলেন আমি লিখছি। কাগজটা নিয়েই বললেন, ‘বাহ, দারুণ হয়েছে তো। দে সুর করি।’ কাগজটা নিয়ে হারমোনি টান দিয়ে বসেই সুর করে ফেললেন। আমি বললাম, ‘আনোয়ার পারভেজ আসছে। আপনি বসেন।’ পরে আনোয়ার পারভেজ এলো, আলাউদ্দিন আলী এলো, জব্বার, শাহিন। সবাই মিলে দেখলাম গানটি তৈরি হলো। এর সুর-সঙ্গীত করল আনোয়ার পারভেজ। শাহিন আর জব্বার গাইল। সঙ্গে আরো অনেক শিল্পী ছিলেন। গান তৈরি করে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে গেলাম। তিনি শুনে খুব পছন্দ করলেন। বললেন এই গান দিয়েই যাত্রা করবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। আর গান প্রকাশ হতেই রাতারাতি সবার মুখে মুখে চলে গেল ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’। তিনি ২০০২ সালে একুশে পদক এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য স্বাধীন দেশের সর্বপ্রথম পুরস্কার ‘বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। এছাড়া পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, একাধিকবার বাচসাস পুরস্কার, বিজেএমই অ্যাওয়ার্ড, ডেইলি স্টার কর্তৃক লাইফ টাইম অ্যাওয়ার্ডসহ তার অর্জিত পুরস্কারের সংখ্যা ১১০। বিবিসি বাংলার জরিপে সর্বকালের সেরা ২০টি বাংলা গানের তালিকায় তার লেখা তিনটি গান রয়েছে। তার লেখা আরো কালজয়ী কিছু গান হলো ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘গানের খাতায় স্বরলিপি লিখে’, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’, ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’, ‘ও পাখি তোর যন্ত্রণা’, ‘ইশারায় শীষ দিয়ে’, ‘চোখের নজর এমনি কইরা’, ‘এই মন তোমাকে দিলাম’ প্রভৃতি। গাজী মাজহারুল আনোয়ার ১৯৬৪ সাল থেকে রেডিও পাকিস্তানে গান লেখা শুরু করেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকেই নিয়মিত গান ও নাটক রচনা করেন। প্রথম চলচ্চিত্রের জন্য গান লিখেন ১৯৬৭ সালে আয়না ও অবশিষ্ট চলচ্চিত্রের জন্য। ১৯৬৭ সালে চলচ্চিত্রের সাথে যুক্ত হওয়ার পর থেকে কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও গান লিখাতেও দক্ষতা দেখান তিনি। তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘নান্টু ঘটক’ ১৯৮২ সালে মুক্তি পায়। তার পরিচালিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা ৪১টি। উল্লেখ্য, গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মেয়ে দেশের বাইরে ছিলেন। তিনি গতকালই বিকেল ৫টায় ঢাকায় ফিরেছেন।


আরো সংবাদ



premium cement