২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সেরা নির্বাচনে কানে যা গুরুত্ব পেয়েছে এবার

সেরা নির্বাচনে কানে যা গুরুত্ব পেয়েছে এবার -

বিশ্ব চলচ্চিত্র তারকাদের মিলনমেলা ভাঙার পর কানের পালে দ্য ফেস্টিভাল ভবন এখন ফাঁকা। সিনেমা সংশ্লিষ্টদের পাশাপাশি নানা দেশ থেকে আসা সাংবাদিকরাও যে যার গন্তব্যে রওনা হয়েছেন। এমন এক সময় এবার ৭৫তম কান চলচ্চিত্র উৎসব হলো, যখন এই পৃথিবীর মানুষ মহামারী-পরবর্তী নয়া বাস্তবতায় বাঁচতে শিখে গেছে। ১৭ থেকে ২৮ মে, এই ১২ দিনে বিশ্ব চলচ্চিত্রের এই বিপুল যজ্ঞে এরই মধ্যে সবাই জেনে গেছেন কে জিতেছে স্বর্ণপত্র। ২১টি ছবিকে ডিঙিয়ে সর্বোচ্চ সম্মাননাটি পান রুবেন অস্টল্যান্ডের ‘ট্রায়াঙ্গেল অব স্যাডনেস’। উৎসবের মূল বিচারকদের এই ছবিটিকে যোগ্য মনে করার কারণ, এটি আধুনিক যুগের পুঁজিবাদকে ব্যঙ্গ করেছে।
প্রতিযোগিতার ছবি ছাড়াও নানা ধরনের ছবিকে উৎসবে জায়গা করে দেয়া হয়, তাতে এর বৈচিত্র্য বাড়ে। বিশেষ প্রদর্শনী, প্রিমিয়ার, ধ্রুপদি শাখা, সমুদ্রসৈকতে দেখানোর ছবি, তরুণদের নিরীক্ষাধর্মী ছবি, চলচ্চিত্র স্কুলের শিক্ষার্থীদের ছবি- এমন আরো বহু শাখা-প্রশাখা রয়েছে কান উৎসবের। এসব আয়োজনের পাশাপাশি একটি সমান্তরাল আয়োজনও থাকে কানের। সেই আয়োজনে রয়েছে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সমালোচক সপ্তাহ ও পরিচালকদের পাক্ষিক আয়োজন। এসব বিভাগ থেকে ফিপরেসি পুরস্কার দেয় তিনটি বিভাগে- মূল প্রতিযোগিতা, আঁ সার্তে রিগা ও প্যারালাল সেকশনে। স্বাধীন সংস্থা হিসেবে ফিপরেসি এবারো বিভিন্ন দেশের সমালোচক ও সাংবাদিকদের সমন্বয়ে গঠিত জুরিবোর্ড করে এবং সেই বোর্ড ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে নিজেদের কাজ সম্পন্ন করে।
প্যারালাল সেকশনে এবার বিচারক হিসেবে কাজ করেছেন বাংলাদেশের বিধান রিবেরু। আগে তার ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে কাজের অভিজ্ঞতা ছিল। সেই সূত্র ধরেই কান পর্যন্ত চলে আসা। তার কাছে জানতে চেয়ে ছিলাম দুই জায়গায় কাজের মৌলিক পার্থক্যের কথা। বিধান বিরেরু বলেন, ঢাকা আন্তর্জাতিক উৎসবে একটি রুমে দরজা বন্ধ করে বিচারকরা টানা বেশ কয়েক দিন সিনেমা দেখতে হয়েছে আমাদের। আর কানে এসে প্রতিটা সিনেমা দেখতে হয়েছে দর্শকদের সাথে বসে। তাই এখানে সেরা সিনেমা নির্বাচন একটু কঠিন ছিল।


তিনি বলেন, প্রতিযোগিতায় থাকা ২৮টি ছবিই আমাদের দেখতে হয়েছে। এর বাইরেও মূল প্রতিযোগিতা ও আঁ সার্তে রিগায় থাকা ছবিও আমরা দেখেছি। আমি ১১ দিনে দেখেছি মোট ৩৭টি ছবি। শেষের দিন, অর্থাৎ ২৮ মে ছবি দেখার সুযোগ হয়নি। কারণ, সেদিন পুরস্কার প্রদানের আনুষ্ঠানিকতা আর বিদায় নিতে নিতে সময় পেরিয়ে যায়।
বিধান রিবেরু বলেন, আমাদের হাতে অনেক ভালো ছবি ছিল, কিন্তু একাধিক ভালো ছবির থেকে একটিকে বেছে নেয়া কঠিন কাজ। সে ক্ষেত্রে আমাদের মনোযোগ দিতে হয়েছে বিষয়ের দিকে এবং বিষয়কে পরিচালক কতটুকু নৈপুণ্যের সাথে তুলে ধরেছেন তার দিকে, অর্থাৎ ছবির সিনেমাটোগ্রাফি, সম্পাদনা, সংলাপ, শব্দ ইত্যাদি ছিল আমাদের বিবেচ্য বিষয়। আমরা প্রথমে একটি ছোট তালিকা তৈরি করি। সেই তালিকার ভেতর স্থান পায় ১৯৭৬, দালভা/ লাভ একর্ডিং টু ডালভা, এল অ্যাগুয়া, ফ্যালকন লেইক, গডস ক্রিয়েচার্স, নেক্সট সহি, লা হাউরিয়া, আন ভ্যারন, নো সেখেমনি/সামার স্কার্স, পামফির ও মেতসুরিন তারিনা/ দ্য উড কাটার স্টোরি- এই ১১টি ছবি। এসব ছবি থেকে তিনটি ছবি নিয়ে আরো সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করি আমরা- ১৯৭৬, দালভা ও ফ্যালকন লেইক। পাকা দুদিন এই তিন ছবি নিয়ে আমরা সময় কাটাই।
‘১৯৭৬’ ছবিটি চিলির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বানানো হলেও এতে রাজনীতি সরাসরি আসেনি। একজন আগন্তুকের চোখ দিয়ে চিলির রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিপ্লবকে দেখার চেষ্টা হয়েছে। সত্তরের দশকের শুরুর দিকে গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে জান্তা সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তখন সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ শুধু নয়, রাজনৈতিক কর্মীদের কঠোর হাতে দমন করেন পিনোশে। সে সময়েরই এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আখ্যান এই ‘১৯৭৬’। ম্যানুয়েলা মারতেলির এটি প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ ছবি। আমরা আলাপ করে দেখলাম, বিপ্লব ও রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির সম্পৃক্ততা খুব একটা নতুন বিষয় নয় চলচ্চিত্রের দুনিয়ায়।


অপর দিকে, ‘ফ্যালকন লেইকে’-এর বিষয়টিও নতুন কিছু নয়, উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের ভেতর প্রেম ও কল্পজগৎ, অতঃপর মৃত্যুর করুণ সুর। শার্লট লো বোঁ পরিচালিত এই ছবিতে দেখা যায় গ্রামীণ পরিবেশে এক বালকের সাথে তারই সমবয়সী এক আত্মীয় মেয়ের বন্ধুত্ব হয়। তারপর সেটি ধীরে ধীরে আরো ঘন হয়ে ওঠে। কিন্তু এই সম্পর্কে চিরতরে ছেদ ঘটে শহুরে ছেলেটি যখন হ্রদের পানিতে ডুবে মারা যায়। পরিচালকের পরিমিতি বোধ এখানে দেখার মতো। তিনি প্রতিটি দৃশ্য ধারণ করেছেন প্রয়োজন অনুসারে। সংলাপ ছিল শ্রুতিমধুর। তারপরও এই ছবিকে আমরা একটু পিছিয়ে রাখি বিষয়ের কারণে। আর ‘দালভা’কে আমরা এগিয়ে রাখি সাহসী বিষয় এবং সেটিকে দক্ষতার সাথে চিত্রায়িত করার জন্য।
বেলজিয়ান পরিচালক ইম্মানুয়েল নিকোট ‘দালভা’তে ১২ বছরের এক বালিকার কথা বলেছেন। ছবিতে দালভা (জেলদা স্যামসন) ভালোবাসাকে জেনেছে বাবার চোখ দিয়ে। কিন্তু সে জানা ভুল শুধু নয়, এই সমাজের চোখে অপরাধও বটে। নাবালিকা দালভা শিখেছে বাবার সাথেও ভালোবাসার সম্পর্ক হতে পারে এবং সেখানে যৌনতা স্বাভাবিক। কিন্তু তাকে কেউ বলেনি সভ্য সমাজে এটি অজাচার। আর তার বাবা একজন শিশুকামী। প্রতিবেশী একজন বিষয়টি আঁচ করতে পেরে পুলিশকে জানায়। ছবি শুরু হয় দালভার বাবাকে গ্রেফতারের সময় পুলিশের সাথে ধস্তাধস্তি দিয়ে। পুলিশ যখন দালভাকে একটি আশ্রুয়কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়, তখনো সে জানে না সমাজে কোন ভালোবাসাকে স্বাভাবিক বলে ধরা হয়। অথচ অস্বাভাবিক ও বিকৃত যৌনাচারকেই সে বুঝতে শিখেছে ভালোবাসা হিসেবে। ‘প্রেমিক বাবা’কে দেখার জন্য দালভা পালিয়ে যায় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে।
ভুক্তভোগী নিজেই বুঝতে পারছে না সে কি ভয়াবহ অপরাধের শিকার। শেষ পর্যন্ত কারাগারে তার সাথে দেখা করানোর ব্যবস্থা করা হয়। দালভা সেখানে নারীদের মতো সেজেগুজে যায়। বাবা সে সময় স্বীকার করে সে দোষী। তারপরও দালভার প্রেম অটুট থাকে। বাচ্চা মেয়ের এমন আচরণে দর্শক একদিকে যেমন চমকে ওঠে, তেমনি তাদের মন এক ধরনের সংপ্রশ্নবিদ্ধও হয়, এমন মানসিকতা ছোট একটি মেয়ের ভেতর কি করে গড়ে ওঠা সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর পরিচালক ছবিতে দিয়েছেন। তবে তাতে দর্শকের অস্বস্তি কাটে না, বরং বাড়ে।
একপর্যায়ে দালভার সাথে বাবার সম্পর্কের বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায় এবং লোকজনের মুখরোচক আলাপের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। দালভাকে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে যে স্কুলে পাঠানো হয়, সেখানেও বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে, সেখানে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে দালভার জন্য। আশ্রয়কেন্দ্রে দালভার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে একটি মেয়ের সাথে। এই বন্ধু ও কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের সহায়তায় এক সুস্থ জীবনের স্বাদ পেতে শুরু করে দালভা। একদিকে কেন্দ্রে চলতে থাকে দালভার পড়ালেখা, থেরাপি, অন্যদিকে আদালতে চলতে থাকে বাবার বিচারকাজ। নাবালিকা দালভার সঙ্গে তত দিনে ডিভোর্সি মায়ের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়। এবং সে বুঝতে শুরু করে তাকে এত দিন ভুল বোঝানো হয়েছে, সে আপন বাবার দ্বারা প্রতারিত।

 


আরো সংবাদ



premium cement