২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

দেশে যেভাবে সিনেমা হলের যাত্রা শুরু হয়েছিল

-

এখন বিকল্প মাধ্যমে সিনেমা দেখার ব্যাবস্থা আছে। হাতে থাকা মোবাইলে ইন্টারনেট সংযোগ থাকলে পছন্দের ছবি দেখা যায় যেকোনো সময়, যেকোনো প্রান্তে বসে। তবে সিনেমা দেখার জন্য হলের বড় পর্দার আবেদন এতটুকুও ফুরায়নি। প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সিনেমা হলের আধুনিকায়ন হয়েছে। আর এই আধুনিকতাই সিনেমা হলের অতীত জানার আগ্রহ বাড়িয়েছে। ১৯১৫ থেকে ১৯৭০ সাল নাগাদ রাজধানী ঢাকার বাসিন্দাদের স্মৃতিতে গেঁথে আছে এ দেশের সিনেমা আর সিনেমা হলের মধুর যত অভিজ্ঞতা।
১৮৯৮ সালের ১৭ এপ্রিল সদরঘাটের পাটুয়াটুলি এলাকার ক্রাউন থিয়েটারে ঢাকার প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। ’২০ শতকে ঢাকা শহর দাঁপিয়ে বেড়ানো সিনেমা হলগুলো সময়ের ব্যবধানে এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার হয়ে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে প্রায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। তবে দেশের সিনেমা হলের যাত্রার সময়টা ছিল বেশ জাঁকজমকপূর্ণ।
শাবিস্তান সিনেমা হল
বাংলাদেশের প্রথম সিনেমা হল শাবিস্তানের পূর্ব নাম ছিল পিকচার হাউজ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় লেজার নামক একজন ইংরেজ আরমানিটোলায় প্রতিষ্ঠা করেন এই হল। গ্রেটাগার্বোর একটি ছবি দিয়ে এই সিনেমা হলের যাত্রা শুরু হয়। হারিকেন আর লণ্ঠন দিয়ে সিনেমা প্রদর্শন করা হতো প্রথম দিকে। প্রতিদিন দু’টি করে ছবি দেখানো হতো এবং সাপ্তাহিক ছুটির দিন রোববারে দেখানো হতো তিনটি করে সিনেমা। আলাউদ্দিন ও আশ্চর্য প্রদীপ, দ্য কিড, মাই ড্যাডি, মহব্বত এমন সব বিখ্যাত সিনেমা দেখানো হয়েছিল শাবিস্তানে। একুশ শতকের শুরুতে এই হল বন্ধ হয়ে যায়।
সিনেমা প্যালেস (রূপমহল)
বাংলাদেশের দ্বিতীয় সিনেমা হল সিনেমা প্যালেস সদরঘাটের বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর দিকে ১৯২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। কারো মতে, এই হলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রূপলাল দাস, কেউ বলেন ধীরেন দাশ। মালিকানা পরিবর্তনের সূত্রে এই হলের নামকরণ হয় মতিমহল। আরো পরে মুড়াপাড়ার জমিদার মুকুল ব্যানার্জীর মালিকানায় চলে গেলে হলের নতুন নাম হয় রূপমহল। এই রূপমহলেই ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট মুক্তি পেয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এ সিনেমা প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন।
প্যারাডাইস টকিজ
১৯৩৮ সালে পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় জেলখানা এলাকার আলী দেউড়ির সাত রওয়াজায় স্থাপিত হওয়া প্যারাডাইজ টকিজ সিনেমা হল পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে পরিচিত হয় ‘প্যারাডাইস’ সিনেমা হল নামে। ফয়েজুদ্দীন নামের এক ব্যক্তি ছিলেন এই হলের প্রতিষ্ঠাকালীন মালিক। ১৯৫৪ সালে আবার হলের নাম পাল্টিয়ে রাখা হয় নিউ প্যারাডাইস। এই হলে প্রদর্শিত প্রথম ছবি ছিল ‘জেলার’। বর্তমানে হলটি বিলুপ্ত।
গুলিস্তান সিনেমা হল
ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের (পরে এই স্টেশন কমলাপুর স্থানান্তর হয়) উত্তরে ঢাকা জেলা ক্রীড়া মিলনায়তন ও পল্টন মাঠের পাশে ১৯৫৩ সালে স্থাপিত হয় গুলিস্তান সিনেমা হল। কলকাতার চিত্র ব্যবসায়ী খান বাহাদুর ফজল আহমদ দেশভাগের পর এই হল প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে এই হলের নাম ছিল লিবার্টি, পরে রাখা হয় গুলিস্তান। শুধু এই হলের নামের কারণেই এলাকাটি পরিচিত হয় গুলিস্তান নামে এবং তারই সাথে গড়ে উঠে এক জমজমাট চলচ্চিত্র ব্যবসা। মূলত এটি ছিল ঢাকার শিক্ষিত শ্রেণীর জন্য এক আকর্ষণীয় সিনেমা হল। ইংরেজি ছবি প্রদর্শন ছাড়াও অন্যান্য সব রুচিশীল সিনেমাও এখানে প্রদর্শন করা হতো। ১৯৫৩ সালে এখানে দেখানো হয় ডাচ ম্যান, বাবলা, রাজরানী; ১৯৫৪ সালে প্রদর্শিত হয় দ্য এনসার, আনমোল ঘড়ি; ১৯৫৫ সালে কুইন অব শিবা, অন্নদাতা, অপবাদ এবং ১৯৫৬ সালে প্রদর্শিত হয় পথের পাঁচালী। ১৯৫৯ সালে এফডিসির সহায়তায় নির্মিত চলচ্চিত্র ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ সিনেমার প্রিমিয়াম অনুষ্ঠিত হয় এই হলে।
লায়ন সিনেমা হল
মহারানী ভিক্টোরিয়ার ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ঢাকার ইসলামপুরে ১৮৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় লায়ন সিনেমা হল। প্রতিষ্ঠাকালীন এই হলের নাম ছিল ডায়মন্ড জুবিলী থিয়েটার। ১৯২০ সালে মির্জা আবদুল সর্দার নামের এক ব্যক্তির অধীনে চলে যায় এই হল। প্রথম দিকে নাটকের পাশাপাশি সিনেমা দেখানো হলেও ১৯২৭ সাল থেকে শুধুই সিনেমা প্রদর্শন হতে শুরু করে।
ব্রিটানিয়া সিনেমা হল
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গুলিস্তান মাজারের পাশে নির্মিত হয় ব্রিটানিয়া সিনেমা হল। এখানে শুধু ইংরেজি সিনেমা দেখানো হতো। যার কারণে ঢাকার শিক্ষিত শ্রেণীর চাহিদার তুঙ্গে ছিল এ হল। সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সিনেমাগুলো প্রদর্শিত হতো। তাজমহল : ঢাকার মৌলভীবাজার এলাকার দুই ভাই মোখলেছুর রহমান ও আরিফুর রহমান ১৯২৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন তাজমহল নামে এ সিনেমা হল। ১৯৮০ সালে এ হল ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়।
আজাদ সিনেমা হল
পুরান ঢাকার জনসন রোডে জীর্ণশীর্ণ এ হল কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুড়াপাড়ার জমিদার মুকুল ব্যানার্জীর নামানুসারে প্রথম দিকে এর নাম ছিল মুকুল টকিজ। ১৯২৯ সালে ঢাকায় নির্মিত হওয়া প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র ‘দ্য লাস্ট কিস’ এই হলে প্রদর্শিত হয়। এই তালিকায় আছেন শামসুর রাহমান, কাইয়ূম চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম, সৈয়দ শামসুল হকও। ১৯৩০ সালে এই হলে দেখানো হয় চণ্ডিদাস, গোরা, ফেয়ারওয়েল টু আর্মস ইত্যাদি বিখ্যাত সব ছবি। বর্তমানে হলটি কোনোরকমে টিকে আছে।
মধুমিতা সিনেমা হল
১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠা হয় মধুমিতা সিনেমা হল। ইফতেখার উদ্দিন নওশাদের শিল্পপতি বাবা নিজের ভালো লাগা থেকে গড়ে তোলেন এ সিনেমা হল। এখানে প্রথম প্রদর্শিত ছবি হচ্ছে ‘ক্লিওপেট্রা’। ১৯৮১ সালের ২৭ মার্চ থেকে ২ এপ্রিলব্যাপী চলা ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধন হয় এই সিনেমা হলে। ৫০ বছর পার করে মধুমিতা এখন হারিয়ে বসে আছে তার অতীত জৌলুস।
মানসী সিনেমা হল
ঢাকার বংশালে অবস্থিত মানসী সিনেমা হল ’২০ শতকের তৃতীয় দশকে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মালিক ছিলেন বালিয়াটি জমিদার পরিবারের সদস্যরা। বর্তমানে কোনোরকমে টিকে আছে এই হলটি।


আরো সংবাদ



premium cement