২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪ পৌষ ১৪৩১, ২৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ঢালিউডে ২০২৪ : ব্যর্থতা, হতাশা আর কিছু প্রশংসিত ছবি

ঢালিউডে ২০২৪ : ব্যর্থতা, হতাশা আর কিছু প্রশংসিত ছবি -


২০২৪ সালে ঢালিউডে ছিল এক অস্থির বছর, যেখানে বেশ কয়েকটি ছবি বক্স অফিসে ব্যর্থতার মুখে পড়লেও কিছু চলচ্চিত্র প্রশংসিত হয়েছে দর্শক ও সমালোচকদের কাছে। বছরের শুরু থেকেই একের পর এক সিনেমা দর্শক টানতে ব্যর্থ হয়, আর প্রেক্ষাগৃহে নেমে আসে হতাশা। তবে ঈদ ও বিশেষ সময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘তুফান’ ও ‘রাজকুমার’ সফল হলেও, অন্যান্য সিনেমা ব্যবসায়িক দিক থেকে সফলতা অর্জন করতে পারেনি। তবে সব কিছু মিলে কিছু প্রশংসিত কাজ যেমন ‘দেয়ালের দেশ’ ও ‘প্রিয় মালতী’ আলোচনায় উঠে এসেছে। ঢালিউডে ২০২৪ ছিল হতাশা, ব্যর্থতা আর সাফল্যের মিশ্রণ, যেখানে কিছু সিনেমা দাগ রেখে গেছে, আর বাকিগুলো বিস্মৃতির গহ্বরে চলে গেছে। চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর গত শুক্রবার পর্যন্ত দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে ৫০টি ছবি। এখানে বাণিজ্যিক ছবির পাশাপাশি গল্পনির্ভর সিনেমাও আছে।

ব্যর্থতা দিয়ে বছর শুরু
বছরের শুরুতেই আছর করে ব্যর্থতার ভূত। বাংলা সিনেমার কাঁধে চেপে বসে সিন্দাবাদের দৈত্য হয়ে। তাকে তাড়ানোর মতো এমন কোনো মদিরা তৈরি সম্ভব হয়নি; বরং জানুয়ারিতে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শেষ বাজি’, ‘কাগজের বউ’, ‘রুখে দাঁড়ও’ ছবি তিনটি দিয়েছে আসকারা। রোজার ঈদ পর্যন্ত মুক্তি পায় আরো চার ছবি। সেগুলো হলো- প্রার্থনা ফারদিন দীঘি অভিনীত ‘শ্রাবণ জোৎস্নায়’, অপু বিশ্বাস অভিনীত ‘ট্র্যাপ’ ও ‘ছায়াবৃক্ষ’ এবং জয়া আহসানের ‘পেয়ারার সুবাস’। একটিও দর্শক টানতে পারেনি। উল্টো গলার কাঁটা হয়েছিল হল মালিকদের। কোনোটা বিদ্যুৎ বিলও তুলতে হয় ব্যর্থ। কোনোটি হাতেগোনা দর্শক পেলেও পূর্ণ সময় ধরে রাখার সক্ষমতা দেখাতে পারেনি। ‘পেয়ারার সুবাস’-এর প্রিমিয়ারে এসে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন অভিনেতা আহমেদ রুবেল। যা বেদনার উপাখ্যান রচনা করে। যদিও হলে সুবাস ছড়াতে পারেনি ‘পেয়ারার সুবাস’। ফলে ব্যর্থতার দৈত্যকে কাঁধে নিয়ই হাঁটতে হয় ঢালিউডকে।

ঈদের কাঁধে ভর করেও ভরাডুবি
ঈদ ব্যতীত হলে দর্শক টানা আর ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা আজকাল যেন একই। তাই লোকসান এড়াতে বিভিন্ন সময় নির্মিত একগুচ্ছ সিনেমা মুক্তির জন্য সংশ্লিষ্টরা বেছে নিয়েছিলেন চলতি বছরের রোজার ঈদ। কিন্তু লাভের গুড় আসেনি। উল্টো লোকসানের পিঁপড়ার কামড়ে লাল হতে হয়েছে। মুক্তিপ্রাপ্ত এক ডজন ছবির মধ্যে ব্যবসার দিকে তুলনামূলক রাজকীয় অবস্থানে ছিল শাকিব খান-হিমেল আশরাফ জুটির ‘রাজকুমার’। হিমেলের প্রত্যাশা ছিল ‘প্রিয়তমা’কে ছাড়ানোর। ছুঁতেও পারেনি। তবে প্রযোজনা সংস্থার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ছবিটি ব্যবসায় সফল হয়েছে। রইল বাকি ১০। এর মধ্যে ‘দেয়ালের দেশ’, ‘ওমর’, ‘কাজল রেখা’ ব্যবসায়িকভাবে সফল না হলেও প্রশংসিত হয়।

তবে বাকি আট সিনেমা ‘সোনার চর’, ‘মেঘনা কন্যা’, ‘আহারে জীবন’, ‘গ্রিন কার্ড’, ‘মোনা : জিন-২’, ‘মায়া : দ্য লাভ’, ‘পটু’, ‘লিপস্টিক’-ব্যবসায়িক দিক থেকে কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি।
‘সোনার চর’ সোশ্যাল মিডিয়ায় কটাক্ষ ও হাসির রসদ জুগিয়েছে। ‘গ্রিন কার্ডে’র মাধ্যমে বহুদিন পর পর্দায় ফেরেন কাজী মারুফ। কাজী হায়াতের হাত ধরে শুরুটা সুন্দর হলেও প্রত্যাবর্তনে পুত্রের রক্ষাকবচ হতে পারেননি বিজ্ঞ এ নির্মাতা। মুক্তির তিন দিনের মাথায় নামিয়ে দেয়া হয় ছবিটি। এতে হতাশ মারুফ জানান, তিনি আর সিনেমা-ই বানাবেন না। মুক্তির আগে ‘মোনা : জিন-২’ পুরস্কার ঘোষণাসহ বিভিন্নভাবে আলোচনায় এলেও হলের চিত্র ছিল টানাটানির সংসারের মতো। ‘দরদ’-এর ওপর গল্প চুরির দায় চাপিয়ে ‘লিপস্টিক’কে কেঁদেকেটে আলোচনায় এনেছিলেন আদর আজাদ।

বড় ঈদে বড় ছবি
কোরবানির ঈদকে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় ‘বড় ঈদ’। এ ঈদে মুক্তি পায় শাকিব খান অভিনীত এবং রায়হান রাফী পরিচালিত ‘তুফান’। ছবিটি হলে বসন্ত ফিরিয়েছে। ইন্ডাস্ট্রি হিট তকমা পেয়েছে। ওই জায়গা থেকে বলা যায়, বড় ঈদে এসেছে বছরের সবচেয়ে বড় ছবি ‘তুফান’। তবে ‘তুফান’ তাণ্ডব চালালেও মুক্তিপ্রাপ্ত বাকি চার ছবি ‘ময়ূরাক্ষী’, ‘ডার্ক ওয়ার্ল্ড’, ‘রিভেঞ্জ’, ‘আগন্তুক’-কোনোটিই কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। যদিও ট্রেলার, পোস্টার ও বিষয়বস্তু দিয়ে কৌতূহল জাগিয়েছিল ‘ময়ূরাক্ষী’। ইয়ামিন হক ববিও নজর কেড়েছিলেন। তবে আলোচনার টেবিলে জ্বলে উঠলেও হলে ছিল নিভু নিভু। মুক্তির মিছিলে হঠাৎ যোগ দেয়া ‘আগন্তুক’ও পায়নি দর্শকের আপ্যায়ন। তবে হাসির খোরাক জুগিয়ে আলোচনায় ছিল ‘ডার্ক ওয়ার্ল্ড’ ও ‘রিভেঞ্জ’। রোজার ঈদে ‘দেয়ালের দেশ’-এর মাধ্যমে প্রশংসিত হলেও ‘রিভেঞ্জে’র কারণে বুবলী হন নিন্দিত। অন্যদিকে কলকাতা থেকে উড়ে আসা কৌশানী সেনগুপ্তও ‘ডার্ক ওয়ার্ল্ড’ দেখাতে পারেননি আলোর দিশা।
দুই ঈদের মধ্যে মুক্তি পাওয়া ‘শ্যামাকাব্য’, ‘ডেডবডি’, ‘ফাতিমা’, ‘ময়নার শেষ কথা’, ‘সুস্বাগতম’, ‘আন্তঃনগর’ দেখতে গাঁটের টাকা খরচ করেননি দর্শক। ফলে সিনেমাগুলো নাম লেখায় ফ্লপের তালিকায়।

স্থবিরতা
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও বন্যায় স্থবিরতা আসে দেশের সিনেমা অঙ্গনে। কেননা, দর্শক না পেলেও নিয়ম করে যাওবা সিনেমা মুক্তি পেতো তা-ও বন্ধ হয়ে যায়। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মোটে দু’টি সিনেমা মুক্তি পায়। এগুলো হলো- ‘আজব কারখানা’ ও ‘অমানুষ হলো মানুষ’। পাঁচ মাল্টিপ্লেক্সে মুক্তি পাওয়া ‘আজব কারখানা’-এর মাধ্যমে ঢালিউডে ক্যারিয়ারের খাতা খোলেন দেশের সুপার মডেল শাবনাজ সাদিয়া ইমি। সাথে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। দুইজনে মিলেও সিনেমাটির গতি করতে পারেননি। মনোয়ার হোসেন ডিপজল অভিনীত ‘অমানুষ হলো মানুষ’ ছবিটিও গাঁটের পয়সা খরচ করে দেখতে যাননি দর্শক।

হতাশার প্রদীপে আশার আলো জ্বালতে পারেননি শাকিবও
অক্টোবর থেকে ফের সিনেমা মুক্তি শুরু হয়। তবে তা হল মালিকদের আশার সলতে প্রজ্বলিত করতে পারেনি। অবশ্য শেষে এসে তারা অসহায়ের সহায় ভেবেছিলেন ‘দরদ’কে। ধারণা করেছিলেন ঈদের বাইরেও ত্রাতার ভূমিকা নেবেন কিং খান। তবে হতাশার গল্পে আশার আলো জ্বালতে পারেননি শাকিব। দুই ঈদে সিনেমা দিয়ে হল মালিকদের মুখে হাসি ফোটালেও সাদামাটা সময়ে ‘দরদ’ দিয়ে দর্শক ফেরাতে পারেননি।

হতাশায়-ই বছর শেষ
অক্টোবর থেকে এই প্রতিবেদন লেখাকালীন ‘দরদ’ বাদে সিনেমা মুক্তি পেয়েছে ১৫টি। এগুলো হচ্ছে- ‘জিম্মি’, ‘শরতের জবা’, ‘বাদশা দ্য কিং’, ‘হৈমন্তীর ইতিকথা’, ‘চরিত্র’, ‘রংঢং’, ‘৩৬ ২৪ ৩৬’, ‘ভয়াল’, ‘দুনিয়া, ‘নয়া মানুষ’, ‘৮৪০’, ‘হুরমতি’, ‘ডেঞ্জার জোন’, ‘মাকড়শার জাল’, ‘প্রিয় মালতী’। সিনেমাগুলোর প্রতি আগ্রহ দেখাননি দর্শক। তবে গেল ২০ ডিসেম্বর মুক্তিপ্রাপ্ত মেহজাবীন চৌধুরী অভিনীত ‘প্রিয় মালতী’ এখন পর্যন্ত সামাজিক মাধ্যমে প্রশংসা পাচ্ছে। গল্প ভিত্তিক সিনেমা এটি। আগামী ২৭ ডিসেম্বর মুক্তিপ্রতীক্ষিত ‘নকশী কাঁথার জমিন’ নিয়েও কোনো আশা নেই। এরকম জানিয়েছেন হল মালিকরা। ফলে হতাশা নিয়েই বছর শেষ হচ্ছে ঢালিউডে।

আমদানিতে হতাশা
২০২৪ সালে আমদানি করা হয় চারটি সিনেমা (প্রযোজক পরিবেশক সমিতির তালিকা অনুযায়ী দু’টি)। এগুলো হলো- ‘হুব্বা’, ‘মি. অ্যান্ড মিসেস মাহি’, ‘ক্রু’ ও ‘স্ত্রী-২’। প্রদর্শক সমিতির সাথে কথা বলে জানা যায়, ভারতে ভালো করলেও দেশে ব্যবসায় করতে পারেনি।

সেরার ঘরে তিন
চলতি বছর মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা ছবির সংখ্যা ৫০। এর মধ্য থেকে সেরা ছবি বাছাই করাটা মুশকিল। ঢালিউডে বক্স অফিস না থাকায় ব্যবসার সঠিক তথ্য জানা সম্ভব হয় না। যার ফলে সৃষ্টি হয় ধোঁয়াশা। তারপরও চলচ্চিত্রের বিভিন্ন মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও ঢাকা মেইলের পর্যালোচনায় বছরের সেরা দুই ছবি ‘তুফান’ ও ‘রাজকুমার’। এর মধ্যে ‘তুফান’কে এগিয়ে রাখছেন সবাই। এরপর রাখছেন ‘রাজকুমার’কে। দর্শক ও বোদ্ধা মহলের প্রশংসার ওপর ভিত্তি করে ‘দেয়ালের দেশ’ও সেরার ঘরে জায়গা করে নিয়েছে।
চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস রেখে নয়া দিগন্তকে বলেন, “এ বছর শাকিব খানের ‘তুফান’ ও ‘রাজকুমার’ ছাড়া কোনো ছবিই লাভের মুখ দেখেনি। শেষ আশা ছিল ‘দরদ’ নিয়ে। তবে সেটি চরমভাবে হতাশ করেছে।’’

প্রশংসিত যে সিনেমাগুলো
কিছু সিনেমা আছে লগ্নিকৃত অর্থ ঘরে আনতে না পারলেও মুগ্ধতা ছড়াতে সক্ষম হয়। প্রতি বছরের মতো এ বছরও এরকম কিছু সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। ‘দেয়ালের দেশ’ ছাড়াও এ তালিকায় আছে ‘কাজলরেখা’। ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে নির্মিত ছবিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বছর শেষে এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে ‘প্রিয় মালতী’।


আরো সংবাদ



premium cement