২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

লাকী যুগের পর প্রথম সভায় বসছে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন

-

লিয়াকত আলী লাকী যুগের অবসানের পর পুনর্গঠন ও আগামী নির্বাচন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে জরুরি সভায় বসছে দেশের নাট্যচর্চা তথা থিয়েটার আন্দোলনের অভিভাবক সংগঠন বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন। আগামী ২৫ অক্টোবর দুপুর ১২টায় ঢাকার শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালা মিলনায়তনে এ সভা হবে বলে ফেডারেশনের জ্যেষ্ঠ প্রেসিডিয়াম সদস্য (কেন্দ্র) লাকী ইনামের সই করা এক চিঠির সূত্রে জানা গেছে। ফেডারেশনের পুনর্গঠন এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারে নির্বাহী পরিষদ এবং সাধারণ সদস্যদেরকে সভায় উপস্থিত হয়ে মতামত ও পরামর্শ দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। ফেডারেশনের প্রেসিডিয়াম সদস্য (কেন্দ্র) অনন্ত হিরা বলেন, ‘তিন বছর মেয়াদে ফেডারেশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে বসে সাড়ে ছয় বছর ধরে পদ আঁকড়ে থেকেছেন লিয়াকত আলী লাকী। তার এই স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে বিভিন্ন সময় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নাট্যকর্মীরা। এই পরিস্থিতিতে ফেডারেশনের জ্যেষ্ঠ প্রেসিডিয়াম সদস্য (কেন্দ্র) লাকী ইনাম এই সভাটি আহ্বান করেছেন।’ ফেডারেশনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, চেয়ারম্যানের পরই লাকী ইনামের অবস্থান উল্লেখ করে অনন্ত হিরা বলেন, ‘নিয়মতান্ত্রিকভাবেই সভাটি আহ্বান করা হয়েছে। সেখানে সারা দেশের নাট্যদলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে ফেডারেশনের সংস্কার এবং আগামী নির্বাচনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হবে।’
২০১৮ সালে ফেডারেশনের ২৩তম ত্রিবার্ষিক জাতীয় সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন লোকনাট্য দলের (সিদ্ধেশ্বরী) লিয়াকত আলী লাকী এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ঢাকা থিয়েটারের কামাল বায়েজিদ। তিন বছর মেয়াদে দায়িত্ব পালন করার কথা থাকলেও লাকী নির্বাচন না দিয়ে সাড়ে বছর ধরে পদ দখলে রাখেন। একই সাথে শিল্পকলার মহাপরিচালকের দায়িত্বও পালন করেন। ফেডারেশনের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির ‘স্বেচ্ছাচারিতা, অগঠনতান্ত্রিক ও অবৈধ কার্যক্রমের অভিযোগ তুলে গত বছর সাধারণ নাট্যকর্মীবৃন্দ’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম থেকে লাকীর পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনেও নামেন থিয়েটারকর্মীরা। মামুনুর রশীদ, রামেন্দু মজুমদার, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, আহমেদ ইকবাল হায়দার, মলয় ভৌমিকসহ দেশের অগ্রজ নাট্যজনেরা ফেডারেশনে দ্রুত নির্বাচন দিয়ে গণতান্ত্রিক ধারা ফেরানোর আহ্বান জানিয়ে প্রতিবাদ করেন। কিন্তু লাকী তাতে কর্ণপাত না করে বরং অগ্রজ নাট্যজনদের নিয়েও নেতিবাচক মন্তব্য করেন। গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ১২ অগাস্ট শিল্পকলার মহাপরিচালকের পদ ছাড়েন লাকী। তবে ফেডারেশন থেকে পদত্যাগ করেননি; বরং অনুগত কয়েকজনকে নিয়ে তিনি অনলাইনে ফেডারেশনের নির্বাহী পরিষদ সভা করেছেন বলেও গুঞ্জন শোনা যায়। এই প্রেক্ষিতে এবার ফেডারেশন সংস্কারের ডাক দিয়ে সভা আহ্বান করলেন ফেডারেশনের জ্যেষ্ঠ প্রেসিডিয়াম সদস্য (কেন্দ্র) লাকী ইনাম। এই সভায় লাকী উপস্থিত থাকবেন কিনা জানতে চাইলে অনন্ত হিরা বলেন, ‘সারা দেশের প্রেসিডিয়াম সদস্যদের নিয়ে আমরা একটি অনলাইন সভা করেছি। সেই সভা থেকে লিয়াকত আলী লাকীকে পদত্যাগ করার একটি বার্তা দিয়েছি। কিন্তু তিনি পদত্যাগ করেননি। এ জন্যই এবার সব স্তরের সদস্যদের নিয়ে সভা করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।’
সম্প্রতি লাকী তার অনুগত কয়েক জনকে নিয়ে অনলাইনে সভা করেছেন বলে নাট্যাঙ্গনের একাধিক সূত্র নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে লাকীর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে লোকচক্ষুর আড়ালে রয়েছেন লাকী।
ফেডারেশনে ভাঙন যেভাবে প্রকাশ্যে
ফেডারেশনের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা প্রকাশ্যে আসে ২০২২ সালে। ওই বছরের ২২ জানুয়ারি ফেডারেশনের সম্পাদক (প্রচার) মাসুদ আলম বাবুর স্বাক্ষরে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ‘আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ ও সাংগঠনিক স্বেচ্ছাচারিতার দায়ে’ সাধারণ সম্পাদক কামাল বায়েজীদ ও অর্থ সম্পাদক রফিকুল্লাহ সেলিমকে অব্যাহতি দেয়ার বিষয়টি জানানো হয়। পরে সংবাদ সম্মেলন করে কামাল বায়েজীদ তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, এভাবে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কাউকে অব্যাহতি দেয়া ‘অগণতান্ত্রিক’। ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নাট্যকর্মীদের উদ্দেশে ২০২২ সালের ২৩ জানুয়ারি খোলা চিঠি লেখেন ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রামেন্দু মজুমদার। নাট্যকর্মীদের কাছে লেখা চিঠিটি থিয়েটার বিষয়ক পত্রিকার ‘ক্ষ্যাপা’ ফেসবুক পেজে প্রকাশ করেন তিনি। চিঠিতে রামেন্দু মজুমদার বলেছিলেন, বর্তমানে ফেডারেশনের কর্তাব্যক্তিদের এই বিরোধ জনসমক্ষে নাট্যকর্মীদের ভাবমর্যাদাকে চরমভাবে কালিমালিপ্ত করেছে। এর দায় নাট্যকর্মীরা কেন নেবেন তারা সুন্দর পরিবেশে নাটক করতে চান, নোঙরা রাজনীতি চান না। তিনি অনির্দিষ্টকালের জন্য ফেডারেশানের কর্মকাণ্ড স্থগিত এবং ব্যাংক হিসাব স্থগিত করার পরামর্শও দেন। এরপর রামেন্দু মজুমদারের চিঠিকে গুরুত্ব না দিয়ে ফেডারেশনে লিয়াকত আলী লাকীর অনুসারীরা রামেন্দু মজুমদারকেও হেয় করে নানা মন্তব্য করেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। ফেডারেশন জানায়, তারা গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে।
কারো ডাকেই সাড়া দেননি লাকী
২০২২ সালের ২৩ জুলাই রাজধানীর মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে ‘সাধারণ নাট্যকর্মীদের’ ব্যানারে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতি লিয়াকত আলী লাকীকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। অগ্রজ প্রায় সব নাট্যজন সেখানে বক্তব্য দিলেও লাকী সেখানে যাননি। ওই সভায় বক্তব্য দিয়েছিলেন রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, মফিদুল হক, আসাদুজ্জামান নূর, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, আহমেদ ইকবাল হায়দার, মোহাম্মদ বারী, আজাদ আবুল কালাম, কামাল বায়েজীদ, রফিকুল্লাহ সেলিম প্রমুখ। কামাল বায়েজীদকে বহিষ্কারের প্রতিক্রিয়ায় ২০২৩ সালের ২২ মার্চ ফেডারেশনের সভাপতি লিয়াকত আলী লাকীকে লেখা এক চিঠিতে ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক নাসির উদ্দীন ইউসুফ সংগঠন ছাড়ার সিদ্ধান্ত জানান। নাসির উদ্দীন ইউসুফ তখন বলেছিলেন, ‘অগঠনতান্ত্রিকভাবে কামাল বায়েজীদকে তার পদ থেকে অব্যাহতি দেয়ার প্রতিবাদে ফেডারেশন থেকে সদস্যপদ প্রত্যাহার করেছে ঢাকা থিয়েটার।’ ঢাকা থিয়েটারের সংগঠন ছাড়ায় ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করে ২০২৩ সালের ১৩ এপ্রিল ফেডারেশনের সভাপতি লিয়াকত আলী লাকীকে চিঠি দেন দেশের শীর্ষ চার নাট্যসংগঠনের প্রধান, যারা বিভিন্ন মেয়াদে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন। তাদের মধ্যে আছেন ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রামেন্দু মজুমদারও। এ ছাড়া ‘নাট্যচক্রের’ পক্ষে ম হামিদ, ‘আরণ্যকের’ পক্ষে মামুনুর রশীদ এবং ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের’ পক্ষে সারা যাকের চিঠিতে সই করেন। এমন পরিস্থিতিতে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের বর্তমান নেতৃত্ব নিয়ে অনাস্থা এবং সংগঠনের অচলাবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে থিয়েটার চর্চার সঙ্কট সমাধানের আহ্বান জানিয়ে ৬৭ জন নাট্যকার, নির্দেশক ও সংগঠকও বিবৃতি দিয়েছিলেন।


আরো সংবাদ



premium cement