২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

এফডিসিতে সিনেমা কম, সমিতি আর দল বেশি

এফডিসিতে সিনেমা কম, সমিতি আর দল বেশি -

সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সিনেমা নির্মাণ করতে পারছেন না আমাদের দেশের পরিচালকরা। প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দর্শক জীবনঘনিষ্ঠ গল্প পান না। এতে ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, সিনেমার বাজারও পড়ে গেছে। প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা দুই হাজার থেকে কমে চলে এসেছে শতকের ঘরে। এফডিসিতে এসব নিয়ে কোনো আলোচনা নেই, গবেষণাও নেই। সিনেমাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান সময় এমন এক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে যে চলচ্চিত্র শিল্প নিয়ে এখন মানুষের মাথাব্যথা নেই, অনেকেই ব্যস্ত দল গঠন নিয়ে। চলচ্চিত্রকারদের কাছে এখন মুখ্য বিষয় সিনেমা নয়; বরং কীভাবে নেতা হওয়া যায়, নেতৃত্বে গিয়ে কতটা ফায়দা হাসিল করা যায়, এগুলোই তাদের প্রধান চিন্তা।
বিগত দিনে চলচ্চিত্র সমিতি নামে সিনেমার স্বার্থসংশ্লিষ্ট কাজ বাদ দিয়ে নতুন নতুন দল তৈরিতে ব্যস্ত সবাই। এভাবে এতদিন ধরে প্রায় ১৯টি সংগঠনের জন্ম দিয়েছে তারা। আবার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন দল গঠনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে অনেকে। এরই মধ্যে বৈষম্যবিরোধী চলচ্চিত্র স্বার্থ সংরক্ষণ কমিটি নামে আরো একটি সংগঠন হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে পুরোনো এফডিসি ছিল ফাঁকা, কিন্তু গত সরকারের পতনের পর এর চিত্র পাল্টে গেছে। এফডিসিতে এখন সংগঠনগুলোর কার্যক্রম নিয়ে মুখর চলচ্চিত্রের কিছু মানুষ। এফডিসিতে চলচ্চিত্রাঙ্গনের ১৯টি সংগঠন থাকার পরও কেন আরো সংগঠন দরকার, এ নিয়ে রয়েছে চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের প্রশ্ন। এ দেশের মতো ছোট একটি দেশে চলচ্চিত্র আর সিনেমার পরিমাণ কম হলেও চলচ্চিত্র সমিতি ও দলের কোনো অভাব নেই। এফডিসিতে প্রদর্শক সমিতির অফিস ছাড?া অন্য সব সমিতির অফিস রয়েছে। জানা যায়, চলচ্চিত্রকাররা এখন এফডিসিতে যান রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও গালগল্প করতে। সিনিয়র চলচ্চিত্রকাররা জানিয়েছেন, কর্মশূন্য এফডিসিতে সবাই এখন কাজের চেয়ে সংগঠন আর একে অন্যের ওপর রেষারেষি করা নিয়েই ব্যস্ত বলা যায়। স্বাধীনতা লাভের পর এখানে কাজের পরিধি যত বেশি ছিল, সমিতি আর দল তত কম ছিল। কিন্তু এখন হয়েছে উল্টো। সিনেমা কম, সমিতি আর দল বেশি। চিত্রনায়ক ও প্রযোজক আলমগীর মনে করেন, ‘শিল্পীদের কার ছবির সংখ্যা কত বেশি, কে কত বেশি কাজ পাব, সেদিকে নজর না দিয়ে আমরা অন্যদিকে বেশি নজর দিচ্ছি।’ শাকিব খান মনে করেন, সমিতি দিয়ে চলচ্চিত্রশিল্প টিকে থাকবে না। শিল্পীকে বাঁচতে হলে কিংবা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে টিকিয়ে রাখতে হলে ছবির কাজ নিয়ে ভাবতে হবে। মানসম্মত কাজ দিয়ে দর্শকের মন জয় করতে হবে। এ নিয়ে এক সময়ের জনপ্রিয় নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘নেতা হতে গেলে সংগঠনের দরকার। সংগঠন বানালে নেতা হওয়া যায়, তখন একেকজন সংগঠনের প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি হয়। তাদের আবার সরকারি সংস্থাগুলো ডাকে। তাই একটি সংগঠন বানালে মনে করতে পারে তার মূল্য আছে। শুধু আমাদের দেশেই নয়। বাঙালিরা লন্ডনে গিয়েও পাড়ায় পাড়ায় সংগঠন করে।’
বিগত দিনে এফডিসিতে গড়ে ওঠা ১৯টি সমিতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘১৯টি সংগঠন ছিল, কারণ এখানে যারা কাজ করেন তাদের পেশাদারত্বের স্বার্থে একেকজন একেকটি সংগঠন করেন। আমাদের এখানে প্রযোজক, পরিচালক, ক্যামেরাম্যান, শিল্পী, মেকআপম্যান, সহকারী পরিচালক প্রত্যেক পেশার সংগঠন আছে। এ ছাড়া প্রডাকশন বয়দেরও একটি সংগঠন আছে, তাদের যে ম্যানেজার তাদেরও আছে। এ রকম মিলিয়ে ১৯টি আলাদা সংগঠন হয়েছে। তাদের প্রত্যেকে মনে করেন, নিজস্ব সংগঠন থাকলে তারা নিজেদের দাবি-দাওয়া-পাওনা আদায় করতে সুবিধা। ফলে তারা সহজে নিজেদের দাবি আদায় করতে পারবে। এ কারণেই সংগঠনগুলো গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি কিছু সংগঠন আছে, যেগুলো রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য গড়ে ওঠে। চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি, গার্মেন্ট, শিল্প কারখানা, পরিবহনসহ আরো নানা খাতে রাজনৈতিক দলগুলোর থেকে সুযোগ-সুবিধা, ভবিষ্যতে এমপি-মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ-সুবিধা, অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা, ভাবসাব ক্ষমতা প্রদর্শন এবং অবৈধ আয়েরও একটি ব্যাপার আছে। যে কারণে রাজনৈতিক ভাবধারায় কিছু সংগঠন গড়ে ওঠে। দেশের স্বার্থ, দেশের মানুষের স্বার্থ বা যে কাজ করলে দেশ ও দেশের মানুষ উপকৃত হবে, সেদিকে এদের কোনো নজর নেই। এখানে ব্যক্তিস্বার্থ, গ্রুপস্বার্থ- এ সব কারণেও কিছু সংগঠন গড়ে ওঠে।’
দেশের বাইরে কলকাতার চলচ্চিত্র সমিতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি যতটুকু জানি দেশের বাইরে ভারতের কলকাতায় মেকআপম্যান থেকে শুরু করে পরিচালক সমিতি, অ্যাসিস্ট্যান্ট পরিচালক, প্রযোজক, শিল্পীসহ আরো সমিতি আছে। তবে কলকাতার এসব সমিতি অনেক শক্তিশালী। কারো টাকা মেরে দিয়ে কেউ কাজ করতে পারবে না। আমাদের এখানে সমিতি আছে, কিন্তু তারা পরস্পরের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে কাজ করে না। কলকাতায় কোনো প্রযোজক যদি কোনো শিল্পীর টাকা না দেয়, তাহলে ওই টাকা পরিশোধ না করে নতুন সিনেমা করতে পারবে না। ঠিক তেমনি একজন মেকআপম্যানের টাকা পরিশোধ না করে অন্য আরেকজনকে নিতে পারবে না।’ এফডিসিতে সমিতির প্রয়োজন আছে, এমনটিই বললেন পরিচালক সমিতির মহাসচিব শাহীন সুমন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সমষ্টিবদ্ধ থাকার কারণেই সমিতি হয়। দাবি-দাওয়া আদায় করার জন্য সমিতি হয়। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে সিনেমাসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলার জন্য সমিতির দরকার হয়। চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আর্থিক সমস্যা, তাদের চিকিৎসাও সন্তানদের পড়াশোনাসহ মানবিক সামাজিক নানা সমস্যার সমাধানের জন্য এসব সমিতি কাজ করে। নিজেদের অধিকার আদায়ে আন্দোলন-সংগ্রাম তৈরি করতে হলে সমিতির প্রয়োজন আছে। প্রতিটি সমিতিরই দরকার আছে এবং তাদের নিজস্ব ভূমিকা রয়েছে। চলচ্চিত্রে এ সমিতিগুলো আজকের নয়, দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে।’


আরো সংবাদ



premium cement