২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

দেশের বিনোদন অঙ্গনের সঙ্কট কাটেনি

দেশের বিনোদন অঙ্গনের সঙ্কট কাটেনি -

দেশের বিনোদন অঙ্গন এমনিতেই সঙ্কটকাল পার করছিল। এর মধ্যে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক উত্তাপ। এর কারণে ব্যবসায়িকভাবে বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছে ঢালিউড। দেশের চলমান অস্থিরতায় হুমকির মুখে পড়েছে চলচ্চিত্র শিল্প। লোকসানের শঙ্কায় এখন পর্যন্ত নতুন কোনো ছায়াছবি মুক্তি দেয়া হয়নি। তবে আগামী শুক্রবার কুসুম সিকদারের ‘শরতের জবা’ মুক্তির কথা রয়েছে। এর মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে অভিষেক ঘটবে কুসুম সিকদারের। যদিও পুরোনো প্রযোজক-পরিচালকরা নতুন সিনেমা মুক্তির সাহস দেখাচ্ছেন না এখনো। দেশে স্থিতিশীলতা না আসা পর্যন্ত প্রেক্ষাগৃহে দর্শক আশাব্যঞ্জক হবে কিনা সেই দুশ্চিন্তায় আছেন তারা।
গত জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে মুক্তির পরিকল্পনায় থাকা কয়েকটি ছায়াছবি অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে গেছে। এ তালিকায় রয়েছে এম রাহিম পরিচালিত ‘জংলি’ (সিয়াম আহমেদ, শবনম বুবলী, দীঘি), মিঠু খান পরিচালিত ‘নীল চক্র’ (আরিফিন শুভ, মন্দিরা চক্রবর্তী), কুসুম সিকদারের ‘শরতের জবা’ (ইয়াশ রোহান), রায়হান রাফী পরিচালিত ‘নূর’ (আরিফিন শুভ, ঐশী), শোয়াইবুর রহমান পরিচালিত ‘নন্দিনী’ (নাজিরা মৌ, ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত), আশরাফ শিশিরের ‘৫৭০’ (বাপ্পি চৌধুরী), সাদেক সিদ্দিকী পরিচালিত ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ (পপি, আমিন খান, ইমন), মনতাজুর রহমান আকবর পরিচালিত ‘অমানুষ হলো মানুষ’ (ডিপজল), মির্জা সাখাওয়াৎ হোসেনের ‘হৈমন্তীর ইতিকথা’।
গত ঈদুল আজহায় ‘তুফান’সহ পাঁচ সিনেমা মুক্তির প্রায় এক মাস পর সর্বশেষ গত ১২ জুলাই মুক্তি পেয়েছিল শবনম ফেরদৌসী পরিচালিত ‘আজব কারখানা’। কিন্তু পাঁচ দিন না যেতেই কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে যায়।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময় পেরিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে প্রেক্ষাগৃহ খুললেও দর্শক উপস্থিতি নেই বললেই চলে। বেশির ভাগ একক-প্রেক্ষাগৃহ প্রায় দর্শকশূন্য। মাল্টিপ্লেক্স প্রেক্ষাগৃহে দর্শক উপস্থিতি একেবারেই কমে গেছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি আরো স্বাভাবিকের দিকে না যাওয়া পর্যন্ত প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের আগ্রহী হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জ্বল জানান, বেশির ভাগ একক-প্রেক্ষাগৃহে এখন পুরোনো ছায়াছবি চলছে। তার মতে, ‘এমনিতেই দেশে একক-প্রেক্ষাগৃহ ধুঁকে ধুঁকে চলছে, তার ওপর এতবড় ধাক্কা। দুই ঈদ ছাড়া বছরের বেশির ভাগ সময় খরচ উঠাতেই হিমশিম খেতে হয় প্রেক্ষাগৃহ-মালিকদের।’
প্রদর্শক সমিতি সূত্রে জানা যায়, সরকার পতনের পরপরই দেশের তিনটি সিনেপ্লেক্সে হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে। এগুলো হলো রাজশাহী নগরীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্কের জয় সিলিকন টাওয়ারে স্টার সিনেপ্লেক্সের একটি শাখা, সিরাজগঞ্জ শহরের রুটস সিনেপ্লেক্স ও নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার আনন্দ সিনেপ্লেক্স। এগুলো আবারো কবে চালু হবে সেই নিশ্চয়তা নেই।
স্টার সিনেপ্লেক্সের বাকি সাতটি শাখা বিভিন্ন শপিংমলের উপরিভাগে অবস্থিত। ফলে সেগুলোর তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। স্টার সিনেপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক (গণমাধ্যম ও বিপণন) মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের রাজশাহী শাখা ভাঙচুরের কারণে বড় অঙ্কের ক্ষতি হলো। পর্দা থেকে শুরু করে স্পিকার, আসন, টিকিট কাউন্টার, কাচের দরজা, ফুড কাউন্টারসহ সবকিছু তছনছ করেছে হামলাকারীরা। কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরুর পর কারফিউ ও অরাজকতার কারণে দুই দফা আমাদের কার্যক্রম বন্ধ রেখেছিলাম। গত ৯ আগস্ট থেকে আমরা আবারো সব চালু করেছি। তবে গত মাস থেকে টিকিট বিক্রি হ্রাস পেতে শুরু করে। বর্তমানে কেবল ১০-২০ শতাংশ দর্শক উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। বলা যায়, এখনো মন্দাবস্থা কাটেনি।’ ‘পরাণ’, ‘হাওয়া’, ‘সুড়ঙ্গ’, ‘প্রিয়তমা’র ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ গত ঈদুল আজহায় ‘তুফান’ দেখতে দর্শকদের আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মতো। এর দেদার টিকিট বিক্রি হওয়ায় লাভের মুখ দেখে সংশ্লিষ্টদের দারুণ সময় কাটছিল। কিন্তু আন্দোলনের পটভূমিতে দর্শকদের প্রেক্ষাগৃহমুখী হওয়ার অভ্যস্ততায় ছন্দপতন ঘটেছে। এখন দর্শক-খরার কারণে ব্যবসায় নিয়ে প্রেক্ষাগৃহ-মালিকদের কপালে ভাঁজ পড়েছে।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জ্বল বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সারা দেশে জানমালের যে ক্ষতি হয়েছে, তাতে ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে। সিনেমা তো একটা বিনোদন, মানুষের মনে আনন্দ না থাকলে তারা বিনোদন উপভোগের কথা ভাববে কখন? আশা করি, নতুন সরকার দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে।’
প্রদর্শক সমিতির এই নেতার আশা- রায়হান রাফী পরিচালিত ‘তুফান’ যেভাবে দর্শক টেনেছে, এমন ভালো মানের সিনেমা মুক্তি পেলে দর্শক আবারো প্রেক্ষাগৃহমুখী হবে। একই অভিমত স্টার সিনেপ্লেক্সের কর্মকর্তা মেসবাহ উদ্দিন আহমেদের, ‘নতুন ও ভালো একটি বাংলা সিনেমা যদি আসে, তাহলে আবারো দর্শক ফিরবে। কারণ, বাংলা সিনেমার দর্শক বরাবরই বেশি। এবারের কোরবানি ঈদেও আমরা এমনটি লক্ষ করেছি। তখন প্রচুর দর্শক সমাগম হয়েছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরুর আগ পর্যন্ত দর্শক উপস্থিতি ভালো ছিল। সব মিলিয়ে দারুণ ব্যবসা হচ্ছিল আমাদের।’
প্রদর্শকরা মনে করছেন, ঢালিউড তারকা শাকিব খান অভিনীত ‘দরদ’ হতে পারে সেই কাক্সিক্ষত চলচ্চিত্র। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আগামী সেপ্টেম্বরে এটি মুক্তি দেয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে। আগামী ২৯ আগস্ট সেই ঘোষণা আসতে পারে। তেমনটাই জানালেন পরিচালক অনন্য মামুন। তার আশা, ‘দেশের সব শ্রেণীর মানুষ ভাবছে, দুঃশাসনের বেড়াজাল ভেঙে নতুন দিন এসেছে। তারা প্রেক্ষাগৃহে ভিড় করে এই আনন্দ উদযাপন করতে পারে। আর দর্শকদের সুবিধার্থে নতুন সরকার দেশের প্রেক্ষাগৃহগুলোর সংস্কারে ভূমিকা রাখবে আশা করি।’ বাংলাদেশে নাটক, ওটিটি ও সঙ্গীতের মতো বিনোদনমূলক কনটেন্ট উপভোগের জন্য দর্শক-শ্রোতারা এখন পুরোপুরি ইন্টারনেটনির্ভর বলা যায়। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে টানা পাঁচ দিন দেশজুড়ে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকা এবং পরে আরো কয়েক দিন পুরোদমে (মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড) চালু না হওয়ায় ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দেশমানুস্ট্রমিং প্ল্যাটফর্ম চরকি, বঙ্গ বিডি, বিঞ্জ, আই স্ক্রিন, দীপ্ত প্লে, বায়োস্কোপ, সিনেম্যাটিক, বাংলাফ্লিক্স, টফি, টেলিফ্লিক্স এবং সিনেস্পট ছাড়াও বাংলাদেশে দেখা যায় বিদেশি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম ভিডিও, হইচই, আড্ডা টাইমস, ডিজনি প্লাস হটস্টার প্রভৃতি। এটি পেইড সাবস্ক্রিপশন-নির্ভর ব্যবসায়। এতে নতুন নতুন কনটেন্ট থাকলে প্রতিদিন সাবস্ক্রাইবার বাড়ে। দুই মাস ধরে নতুন কনটেন্ট না দিতে পারায় পুরোনো সাবস্ক্রাইবার ফেরানো ও নতুনদের যুক্ত করা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন ওটিটি প্ল্যাটফর্মের কর্মকর্তারা। নতুন সাবস্ক্রাইবার না পাওয়ার শঙ্কা ও সাবস্ক্রাইবার কমে যাওয়া নিয়েও শঙ্কিত তারা। চরকি গত জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে রেজাউর রহমান পরিচালিত ওয়েব ফিল্ম ‘থার্টিসিক্স টোয়েন্টিফোর থার্টিসিক্স’ (দীঘি, সৈয়দ জামান শাওন, কারিনা কায়সার) মুক্তির পরিকল্পনা থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুরোদমে প্রচারণা চালিয়েছে। কিন্তু আন্দোলনের ডামাডোলে ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ায় সেটি থমকে গেছে। এ বিষয়ে চরকির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রেদওয়ান রনি বলেন, ‘ওটিটিতে প্রতিটি কনটেন্ট মুক্তি দেয়ার আগে বেশ কিছু পূর্বপরিকল্পনা ও বিপণন কৌশল থাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক-দুই মাস প্রচারণা চালাতে হয়। সে ক্ষেত্রে কনটেন্টের প্রচারণা শুরু করেও সেটি মুক্তি দিতে না পারা আমাদের জন্য বড় একটি ক্ষতি। আমরা প্রতি মাসে একটি করে কনটেন্ট মুক্তি দিয়ে থাকি, কিন্তু জুলাইতে পারিনি। আগস্টে এসেও পারছি না। দুই মাস কনটেন্ট মুক্তি দিতে না পারায় ব্যবসার প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হয়েছে, এটি কাটিয়ে ওঠা কঠিন। অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে। সব কিছু মিলিয়ে আমাদের অনেক কঠিন সময় পাড়ি দিতে হচ্ছে।’
হইচই বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার সাকিব আর খান জানান, তাদের প্ল্যাটফর্মে গত ৮ আগস্ট অনম বিশ্বাস পরিচালিত ‘রঙিলা কিতাব’ (পরীমণি) সিরিজটি মুক্তি দেয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত ছিল। কিন্তু তা আর হয়নি। এ ছাড়া আশফাক নিপুনের ‘জিম্মি’ (জয়া আহসান), ভিকি জাহেদের ‘মিথ্যাবাদী’ (মেহজাবীন চৌধুরী) ও অমিতাভ রেজা চৌধুরীর ‘বোহেমিয়ান ঘোড়া’ (মোশাররফ করিম) সিরিজ তিনটির শুটিং শুরু হওয়ার কথা ছিল এই আগস্টেই। কিন্তু দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সেসব স্থগিত করতে হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement