২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির এখন কী অবস্থা

চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির এখন কী অবস্থা -

গত সরকারের সময় সংস্কৃতিক অঙ্গনে সবচেয়ে আলোচনা ও সমালোচনার জায়গা ছিল চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি। নতুন সিনেমায় অভিনয়ের চেয়ে শিল্পীদের কাছে এই সমিতির চেয়ার দখলই যেন মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল। বিষয়টি শুধু সামাজিক মাধ্যম, শিক্ষার্থী আর সাধারণ মানুষের সমালোচনার মধ্যে আটকে ছিল, তা নয়। এর উত্তাপ ছড়িয়েছিল আদালত পারায়ও।
২০২২-২৪ মেয়াদে জায়েদ-নিপুণ, পরবর্তী সময়ে ডিপজল-নিপুণের দ্বন্দ্বে বিরক্ত ছিলেন অভিনয় শিল্পীরাও। কোনো সমালোচনাই থামাতে পারছিল না তাদের। চেয়ার দখলের যুদ্ধ হাস্যরসের জন্ম দিয়েছে সাধারণ মানুষের মাঝেও। কেউ বলতে পারছিলেন না চেয়ার দখলের এ লড়াইয়ের শেষ হবে কবে। তবে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বদলে গেছে দৃশ্যপট। শিল্পী সমিতির অফিসে সাধারণ সম্পাদকের চেয়ারটি আগের জায়গায় রয়ে গেলেও চেয়ারের পেছনে ছুটতে থাকা মানুষগুলোকে আর দেখা যাচ্ছে না। বিশেষ করে সরকার পরিবর্তনের পর এফডিসিতে শুটিংও কমে গেছে। শনিবার দুপুরে এফডিসি ঘুরতে ঘুরতে কথা হয় কর্মকর্তা, কর্মচারী ও কয়েকজন পরিচালকের সঙ্গে। তারা জানালেন, আজ কোনো শুটিং নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাসখানেক ধরে এফডিসিতে তেমন কোনো শুটিং হয়নি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শেষে শেখ হাসিনা সরকারের পতন, এরপর অর্ন্তর্বতী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের দুই মাস হতে চলছে, তারপরও যেন নিষ্প্রাণ এফডিসি। ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা আড়াইটা। এফডিসির প্রধান ফটকের দায়িত্বে দুই নিরাপত্তারক্ষী। কথা বলে ঢোকার মুখে কড়ইতলা। অসংখ্য ছবির শুটিং এই কড়ইতলায় হয়েছে। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে গাছটি। নিরাপত্তারক্ষী জানালেন, ‘অনেক দিন শুটিং হয় না। আমরা আমাদের মতো করে কাজ করে যাচ্ছি।’ হাঁটতে হাঁটতে ক্যানটিনের দিকে যেতেই পথে দেখা হয় প্রবীণ পরিচালক সাইদুর রহমানের সঙ্গে। পরে ৬ নম্বর ফ্লোরের রূপসজ্জার কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। জানালেন, দেশে একটা পরিবর্তন এসেছে। নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। এফডিসির পরিবেশটাও একটু অন্যরকম। সবাই যেন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। প্রযোজক আসতে হবে, শুটিং শুরু করতে হবে। ক্যানটিনের সামনে কয়েকজন টেকনিশিয়ান দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। নতুন ছবির নিয়ে কথা বলছেন। আলাপে প্রাধান্য ছিল রাজনীতির নানা বিষয়ও। ক্যানটিনের পাশে কক্ষে কয়েকজন দাঁড়িয়ে ক্যারম খেলায় ব্যস্ত। ক্যারম খেলার পাশাপাশি সেখানেও রাজনীতি নিয়ে আলাপ।
এরপর হাঁটতে হাঁটতে হাজির হলাম শিল্পী সমিতির অফিসের সামনে। শুটিং থাকলেই শিল্পীরা প্রায়ই এসে ঢুঁ মারেন শিল্পী সমিতিতে। আড্ডা দেন। শনিবার দুপুর থেকে বিকেলের চিত্র একেবারে ভিন্ন। সমিতির কার্যালয়ে ঢুকতেই দেখা যায়, একজন নারী কর্মচারী বসে খবর দেখছেন। কী দেখছেন, জানতে চাইলে বললেন, ‘আমেরিকার নির্বাচনের খবর দেখি।’ ভেতরে কেউ আছেন কিনা, জিজ্ঞেস করতেই বললেন, শিল্পীরা কেউ নেই। তবে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন কর্মচারীদের দুজন। খেতে খেতে জানালেন, আজ কেউ আসেননি। তবে এর মধ্যে জয় চৌধুরী, সুব্রতসহ কয়েকজন এসেছিলেন। সভাপতি মিশা সওদাগর আছেন দেশের বাইরে। আর সাধারণ সম্পাদক ডিপজল সরকার পতনের পর আসেননি।’ বের হতে দেখা অভিনয়শিল্পী জাদু আজাদের সঙ্গে। খুব উচ্ছ্বসিত দেখাল তাকে। হাসিখুশি জাদু আজাদ জানালেন, নতুন একটি সিনেমার কাজ হাতে নিয়েছেন। নাম জিজ্ঞেস করতেই হাসতে হাসতে বললেন, ‘হারুনের ভাতের হোটেল। সেই হবে ছবিটা।’ আসলে শিল্পী ও পরিচালকদের সব সময় এমন প্রাণ চঞ্চলই থাকার কথা। কিন্তু নোংরামি শুরু হয় সমিতির নির্বাচন নিয়ে। বিশেষ করে ২০২২-২৪ মেয়াদের শিল্পী সমিতির নির্বাচনের সময় থেকেই শুরু হয় সাধারণ সম্পাদকের চেয়ার দখলের লড়াই। সেই নির্বাচনে ১৩ ভোটে নিপুণ আক্তারকে হারিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন জায়েদ খান। ভোটে হেরে গেলেও নির্বাচনের আপিল বোর্ডের কাছে জায়েদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ করেন নিপুণ। ফল প্রকাশের পরদিন বিকেলে এফডিসির বাগানে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে জায়েদ খানের প্রার্থিতা বাতিল করে নিপুণকে জয়ী ঘোষণা করে নির্মাতা সোহানুর রহমান সোহানের নেতৃত্বাধীন আপিল বোর্ড। শপথ নিয়ে চেয়ারে বসলেও স্বস্তিতে থাকতে পারেননি নিপুণ। বিচার চেয়ে আদালতে যান জায়েদ। হাইকোর্ট জায়েদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বোর্ডের সিদ্ধান্ত বাতিল করে সাধারণ সম্পাদকের পদে স্থিতাবস্থা জারি করেন। সেখানেই থেমে থাকেননি জায়েদ। ভুয়া কাগজ দেখিয়ে সমিতির সভাপতির কাছ থেকে শপথও নেন। পরে আদালতে হাজির হন নিপুণ। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের দেওয়া রায় স্থগিত করেন আপিল বিভাগ। সেই সুযোগে চেয়ারে বসেন নিপুণ। এক দিকে নিপুণ দায়িত্ব পালন করতে থাকেন, আরেক দিকে আদালতে মামলা চলতে থাকে। পাশাপাশি দুজনের মধ্যে চলমান থাকে বাগযুদ্ধ। আদালতে মামলা নিষ্পত্তি না হলেও শেষ হয়ে যায় কমিটির মেয়াদ।
২০২৪-২৬ মেয়াদে নিপুণ এবার পরাজিত হন মনোয়ার হোসেন ডিপজলের কাছে। ফল ঘোষণার সময় ডিপজলকে ফুল দিয়ে বরণ করে নিলে অনেকেই মনে করেছিলেন শেষ হলো চেয়ারের যুদ্ধ। তবে এক মাস না পেরোতেই পুরোনো রূপে ফেরেন নিপুণ। তার করা রিটে সাধারণ সম্পাদক পদে মনোয়ার হোসেন ডিপজলের দায়িত্ব পালনে নিষেধাজ্ঞা দেন হাইকোর্ট। এরপর ডিপজল ও নিপুণ মেতে ওঠেন একে অপরের সমালোচনায়। ডিপজলকে ‘অশিক্ষিত’ বলে কটাক্ষ করেন নিপুণ। অন্যদিকে, ‘নিপুণের পেছনে বড় শক্তি আছে’ বলে অভিযোগ করেন ডিপজল। নিপুণের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। দু’জনের কথার যুদ্ধে শামিল হতে দেখা যায় জায়েদ খানকেও। পরবর্তী সময়ে আট সপ্তাহের জন্য ডিপজলের সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালনে নিষেধাজ্ঞাবিষয়ক হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করেন আপিল বিভাগ। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের সব মাধ্যমেই পরিবর্তনের ছোঁয়া লক্ষ করা যাচ্ছে। বদল এসেছে শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদকের চেয়ার-যুদ্ধের দৃশ্যপটেও। গত ৫ আগস্টের পর থেকে আড়ালে রয়েছেন ডিপজল, নিপুণ ও জায়েদ। তিনজনই জড়িয়েছেন বিতর্কে। ডিপজল ও জায়েদ খানের বিরুদ্ধে করা হয়েছে হত্যা মামলা। আর এক আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছেন নিপুণ। জানা গেছে, জায়েদ ও নিপুণ দুজনেই এখন আছেন দেশের বাইরে। অন্যদিকে, দেশে থাকলেও এখনো এফডিসিতে পা রাখেননি ডিপজল।
ডিপজল, নিপুণ ও জায়েদ আড়ালে চলে গেলেও থেমে নেই শিল্পী সমিতির কর্মকাণ্ড। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা ও বন্যার্তদের সহায়তায় তহবিল সংগ্রহেও সরব ছিল সংগঠনটি। তবে ফাঁকা পড়ে আছে সাধারণ সম্পাদকের বহুল আলোচিত চেয়ারটি। এদিকে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফডিসি) নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দিয়েছেন অতিরিক্ত সচিব দিলীপ কুমার বণিক। দেড় মাসের বেশি সময় ধরে তিনি নিয়মিত অফিস করছেন। এর আগে গত ৩০ জানুয়ারি এফডিসির এমডির অপসারণসহ তিন দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন করেছিলেন চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট সংগঠন। ওই সময় ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন নুজহাত ইয়াসমিন। দীর্ঘ সময় ধরে তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ করে আসছিলেন চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।


আরো সংবাদ



premium cement