ভোটার উপস্থিতি কমলেও ব্যয় বাড়ছে উপজেলা নির্বাচনে, কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা?
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৯ মে ২০২৪, ১৯:৩৪, আপডেট: ২৯ মে ২০২৪, ২১:২২
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর অনুষ্ঠিত হচ্ছে চার ধাপের উপজেলা নির্বাচন। প্রতি দফা নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কমতির দিকে থাকলেও বাজেট বাড়ছে নির্বাচন কমিশনের।
এমন অবস্থায় নির্বাচন বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন, ‘নিয়ম রক্ষার এই নির্বাচনে’ শত শত কোটি কোটি টাকা খরচ করে লাভ কী হচ্ছে?
অবশ্য নির্বাচন কমিশন বলছে, আইন অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা তাদের কাজ। বাজেটের চিন্তা তাদের না।
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বিবিসি বাংলাকে বলেন, আমাদের আইনে এমন কোনো সুযোগ দেয়া নাই যেখানে ভোটার কমে গেলে নির্বাচন আয়োজন বন্ধ করে দেয়া যায়।
বিরোধী দলহীন একতরফা নির্বাচন ও ভোটে একদলের প্রার্থীদের লড়াইকে ভোটার কমার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, গত ১০ বছরে দেশের নির্বাচনি সংস্কৃতিতে বেশ বড় একটা পরিবর্তন এসেছে। সে কারণে সাধারণ ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যেতে চায় না।
নির্বাচন বিশ্লেষক ড. তোফায়েল আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, হাতে গোনা দুই একটি ভোট ছাড়া গত ১০ বছরে নির্বাচনগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নির্বাচন কর্মকর্তারা সরকারি দলের পক্ষে কাজ করছে। যে কারণে শুধু ভোটার না, আগ্রহ হারাচ্ছেন সাধারণ প্রার্থীরাও।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসির প্রাথমিক বাজেট ছিল দেড় হাজার কোটি টাকা, যেটি পরবর্তীতে আরো বেড়েছিল। এর চার মাসের মাথায় উপজেলা নির্বাচনে প্রায় ১৭ শ’ কোটি টাকা বাজেট প্রস্তাব করেছে ইসি।
অর্থনীতিবিদদের মতে, নির্বাচনী খাতে সরকারের ব্যয় বাড়লেও তাতে সাধারণ মানুষের কোনো লাভ হচ্ছে না।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রশাসনিক ও সামরিক বাহিনীর পেছনে ব্যয় বৃদ্ধি করতে সরকার কোনো কার্পণ্য করছে না। কারণে এতে করে তাদের গদি কিংবা পদ ঠিক থাকছে।
এমন ভোটে সাধারণ মানুষের আগ্রহ কমলেও সরকারের কিছু যায় আসে না বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
আগ্রহ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ওই বছরই অনুষ্ঠিত হয় তৃতীয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন।
নির্বাচন কমিশন বলছে, বাংলাদেশের তৃতীয় ওই উপজেলা নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৬৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ। পাঁচ বছরের মাথায় ২০১৪ সালের চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনে সারাদেশে ভোট পড়ে প্রায় ৬১ শতাংশ।
সর্বশেষ, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে ২০১৯ সালের পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিরোধী দল বিএনপি। ওই নির্বাচনে ভোটের হার কমে দাড়ায় প্রায় ৪০ শতাংশে।
চলতি মে মাসের ৮ তারিখ থেকে শুরু হয়ে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে গত ৮ মে ভোট পড়েছে ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ, এরপর ২১ মে দ্বিতীয় ধাপে ৩৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
তৃতীয় দফায় বুধবারের নির্বাচনেও একই ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা গেছে। দুপুর পর্যন্ত এই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ২০ শতাংশের নিচে, যদি শেষ পর্যন্ত ৩৫ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
গত দেড় দশকের মধ্যে স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে এবারই সবচেয়ে কম ভোটের হার দেখা যাচ্ছে।
উপজেলা নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি যে কমছে তা মানছে নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, গত দুটি জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে এই প্রবণতা আরো বেশি দেখা যাচ্ছে।
স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলছেন, একসময় স্থানীয় সরকারের ভোট নিয়ে মানুষের মাঝে আগ্রহ উদ্দীপনা থাকতো। ভোটটাকে মানুষ এন্টারটেইনমেন্ট মনে করতো। উৎসাহ নিয়ে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে আবার ফেরত আসতো।
এখন সেই আগ্রহ দেখা না গেলেও এভাবে এই নির্বাচন আয়োজন গণতন্ত্রের জন্য কতটুকু লাভজনক সেটি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এই স্থানীয় সরকার বিশ্লেষক।
নির্বাচন কমিশনার মো: শাহনেওয়াজ বিবিসি বাংলাকে বলেন, গত কয়েক বছর ধরে লাগাতার একপক্ষীয় নির্বাচন হচ্ছে। এ কারণে মানুষেরও নির্বাচনের প্রতি আগ্রহ থাকছে না, ভোটের হার কমে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক উপজেলা নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে নির্বাচন কমিশন বলছে, ভোটার উপস্থিতি কম থাকলেও ভোট আয়োজন করতে তারা বাধ্য।
ইসির অতিরিক্ত সচিব দেবনাথ বিবিসি বাংলাকে বলেন, এমন তো কোনো নিয়ম নাই এত ভোট না পেলে কেউ জিতবে না। নিয়ম হলো প্রদত্ত ভোটের মধ্যে যে বেশি পাবে সে জিতবে। আমরা আইন মেনে ভোট আয়োজন করতে বাধ্য।
যে সব কারণে কমছে ভোটার উপস্থিতি
গত দেড় দশকের মধ্যে এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটের হার সর্বনিম্ন। জাতীয় নির্বাচনের পর থেকেই ভোটার উপস্থিতি নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যেও এক ধরনের অস্বস্তি দেখা গেছে। ।
যে কারণে এবারের উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না দিয়ে প্রার্থিতা উন্মুক্ত করেছিল আওয়ামী লীগ। এরপরও উপজেলা নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়েনি, বরং কমেছে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের চেয়েও।
স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হওয়ার পরও ভোটার উপস্থিতি কেন এত কম হচ্ছে এ নিয়ে বেশ কিছু কারণকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকদের বেশিরভাগই মনে করেন, বাংলাদেশের সাধারণ ভোটারদের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি দলের সমর্থক সবচেয়ে বেশি। সে কারণে বিএনপি যখন নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে স্বাভাবিকভাবে ভোটারদের বড় একটা অংশ আর নির্বাচনমুখী হন না।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার শাহনেওয়াজ বিবিসি বাংলাকে বলেন, স্বাভাবিকভাবে বিএনপি ছাড়া প্রতিপক্ষ একটি দল থেকেই যখন প্রার্থী হয়, তখন ভোটারদের মধ্যে আর আগ্রহ থাকে না কেন্দ্রে যাওয়ার।
রাজনৈতিক দলের প্রতি ভোটারদের সমর্থনের বাইরেও আরো বেশ কিছু কারণকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর ইদানিং সরকারি দলের একটা বড় প্রভাব থাকার কারণে মানুষ আর কেন্দ্রমুখী হচ্ছেন না। যে কারণে কমছে ভোটার উপস্থিতি।
স্থানীয় সরকার বিশ্লেষক ড. তোফায়েল আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, নির্বাচনে জিততে প্রার্থীরা এখন আর ভোটারদের কাছে যাচ্ছে না। তারা যাচ্ছে সরকারি দল কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। এ কারণে ভোটাররাও গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে।
তার মতে, ভোটের প্রতি মানুষের এই আগ্রহ একদিনে কমেনি। সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে অনিয়মের কারণে আস্তে আস্তে নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের খুব ক্ষোভ আর অনীহা তৈরি হয়েছে।
ভোটার খরার নির্বাচনে খরচ কতো?
ভোট আয়োজনে নির্বাচনি কর্মকর্তা, নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি অনেকেই দায়িত্ব পালন করেন। এর বাইরে ভোটের সরঞ্জাম, ইভিএম’র ভোটে টেকিনক্যাল টিম ছাড়াও বিপুল পরিমাণ জনবল নিয়োগ করতে হয়।
এর পাশাপাশি ব্যালট পেপার ছাপানোর পেছনেও ব্যয় হয় বড় একটা অংশ। সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে দেখা গেছে আগের চেয়ে বহুগুণ খরচ বাড়ছে। যার বড় একটা অংশ ব্যয় হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পেছনে।
গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হওয়া দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের পেছনেই ব্যয় হয়েছিল ৫০ হাজার টাকা।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার শাহনেওয়াজ বিবিসি বাংলাকে বলেন, আমরা ছোটবেলায় অনেক নির্বাচন দেখেছি। সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এত মোতায়েন করতে দেখিনি। এখন ভোটার না থাকলেও আয়োজনে কমতি থাকছে না।
এত বিশাল আয়োজন করে তাতে কতটুকু লাভ হচ্ছে সেই প্রশ্নও করেন সাবেক এই কমিশনার।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট হয় মাত্র একটি ব্যালটে। কিন্তু উপজেলা নির্বাচনে তিনটি পদে ভোট হওয়ার কারণে তিন ধরনের ব্যালট ছাপতে হয় ইসিকে। এই ব্যালট ছাপার পেছনেও একটা বড় অংশ ব্যয় হয়।
তিন দফার উপজেলা নির্বাচনে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, যেসব ব্যালট ছাপা হচ্ছে তার ৬০ শতাংশের বেশিই অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। অর্থাৎ ভোটার না আসলেও কোটি কোটি বাড়তি ব্যালট ছাপতে হচ্ছে ইসিকে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, মাত্র একজন ভোটার আসলেও ভোট আয়োজনে যে খরচ, শতভাগ ভোটার উপস্থিতি হলেও খরচ ঠিক তার সমান। ভোটার কম আসলে খরচ বাঁচানোর কোনো সুযোগ নাই।
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন প্রার্থীদের আচরণের কারণেও এই বাজেট বাড়ে অনেক সময়।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার শাহনেওয়াজ বলছেন, সাধারণত সরকারি দল কিংবা শক্তিশালী প্রার্থীরা নির্বাচনে জয় পেতে বিভিন্ন সহিংসতা ও তৎপরতা চালায়। যে কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বেশি ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দিতে হয়। বাজেটও বেড়ে যায়।
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে প্রাথমিকভাবে দেড় হাজার কোটি টাকা বাজেট প্রস্তাব করেছিল নির্বাচন কমিশন। পরে আবার সেই বাজেট বেড়েছে।
এ অবস্থায় মে থেকে শুরু হওয়া উপজেলা নির্বাচন করতে ইসি সরকারের কাছে প্রায় ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বাজেট চেয়েছে।
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে ব্যয় ঠিকই হচ্ছে, কিন্তু নির্বাচন হচ্ছে একতরফা, ভোটারদের অংশগ্রহণ ঠিকমতো হচ্ছে না।
জৌলুসহীন এসব নির্বাচনে এত বিশাল পরিমাণ বাজেট খরচের পেছনে যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন বিশ্লেষকরা।
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব মি. দেবনাথ বলেন, আমাদের যে আইন আছে সেখানে একজন ভোটার আসলেও ভোট আয়োজন করতে হবে। এ কারণে বাজেটের দিকে তাকানোর সুযোগ আমাদের নেই।
সাম্প্রতিক নির্বাচন নিয়ে মানুষের যে অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে তা বন্ধ করতে হলে নির্বাচনী সংস্কৃতিকে ঢেলে সাজাতে হবে। নিরপেক্ষ আচরণের মাধ্যমে ভোটে আগ্রহ বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা