গ্রাফিতি : বিপ্লবের এক নতুন কণ্ঠস্বর
- আসিফ আহমদ
- ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪:৩০, আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:২০
বিপ্লবের আত্মপ্রকাশের ভাষা হিসেবে যুগে যুগে নানান মাধ্যম অবলম্বন করে এসেছে। তা কখনো কবিতা রূপে, কখনো বা গান নাটক গল্প উপন্যাস কিংবা চলচ্চিত্র অবলম্বনে। ২০২৪ এ ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে উজ্জীবিত করতে এবারো বিপ্লবের এক নব্য স্বরের উত্থান ঘটে। গ্রাফিতি। এর উৎপত্তি প্রাচীন সভ্যতা থেকে খুঁজে পাওয়া গেলেও এর আধুনিক পুনরাবৃত্তি বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বিশেষ করে নিউইয়র্ক সিটিতে প্রাধান্য লাভ করে। গ্রাফিতি গ্যালারির পরিবর্তে পাবলিক স্পেসে বিদ্যমান হয়। শিল্পের ঐতিহ্যগত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। বাংলাদেশে এর প্রচলন আগে সৌন্দর্যবর্ধনে হলেও প্রতিবাদী বিপ্লবী কণ্ঠস্বর হিসেবে এই প্রথম। জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে যখন শিক্ষার্থীরা মাঠে নামে তখন পুলিশ ও আওয়ামী পাণ্ডারা ছাত্রদের ওপর একের পর এক অতর্কিত হামলা চালায়। ছাত্রদের নিরঙ্কুশ সাহস এবং ঐক্যবদ্ধতার সম্মুখে টিকে না তাদের অমানসিক দমন-পীড়ন।
১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদের সেই আইকনিং মৃত্যু সবার মনে থাকা অবশিষ্ট ভয়কে দুমড়েমুচড়ে দেয়। সবাই তখন চাইত আবু সাঈদের মতো বন্দুকের নলের সামনে দু’হাত উঁচিয়ে দাঁড়াতে, তোয়াক্কা করে না আর তারা কোনো কিছু। এর মধ্যে যায় অগণিত প্রাণ, আহত হয় শতাধিক। পরে ১৮ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে পানি বিতরণকালে মৃত্যুবরণ করে মীর মুগ্ধ। এই সব মৃত্যু ছাত্রদের মনে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। স্বৈরাচারী সরকার সেই রেশ সহ্য করতে না পেরে কারফিউ জারি করতে বাধ্য হয়। একই সাথে বিচ্ছিন্ন করে ইন্টারনেট। এর মধ্যে ২৭ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ককে হেফাজতে নিয়ে যায় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। এমন প্রেক্ষাপটে ২৮ জুলাই রোববার সারা দেশের দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখন কর্মসূচির ঘোষণা দেয় অন্য তিনজন সমন্বয়ক। ঠিক তখন থেকেই বাংলাদেশে গ্রাফিতির অবলম্বনে এক নতুন বিপ্লবী ভাষার প্রকাশ ঘটে। রাস্তার দু’ধার ছেয়ে যায় হৃদয় কম্পিত গ্রাফিতে। নজরে পড়ে এমন দৃশ্যও সন্তানদের সাথে মা-বাবাও যোগদান করে সেই কর্মসূচিতে।
সেদিনের গ্রাফিতিতে থাকা আলোচিত স্লোগানগুলো হলো- ‘হামার বেটাক মারলু কেনে?’ ‘ছাত্র যদি ভয় পাইতো বন্দুকের গুলি, উর্দু থাকতো রাষ্ট্রভাষা, উর্দু থাকতো বুলি’, ‘দেশ স্বাধীন হলে আমরা আবার ছাদে উঠব’, ‘তুমি কে আমি কে, বিকল্প বিকল্প’, ‘লোহার টুপি মানুষের মগজ খায়’, ‘মেধা শহীদ’, ‘আমি মেট্রোরেল হতে চেয়েছিলাম, খোদা আমাকে ছাত্র বানালো,’ ‘বায়ান্ন দেখিনি চব্বিশ দেখেছি,’ ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার, ‘জেন-জি’, ‘আমার ভাইয়ের রক্তের বিচার চাই,’ ‘আসছে ফাগুন আমরা দ্বিগুণ হবো’, ‘বুকের ভেতর দারুণ ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’ প্রভৃতি।
মীর মুগ্ধের ছবি এঁকে পানি পানের সেই দৃশ্যটি সবার দৃষ্টি সম্মুখে তুলে ধরতে সচেষ্টা হয়, যখন টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় জর্জরিত হয়েও অন্যকে পানিপান করার জন্য বলে চলছিল, ‘ভাই পানি লাগবে কারো, পানি?’ বিশ্বাস করুন সেই ভিডিও যারা দেখেছে তারা কেউ অশ্রু ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। আজো যখন পথে বের হয়ে নগরীর কোনো দেয়ালে মুগ্ধের সেই গ্রাফিতি দেখি। অজান্তেই চোখের সামনে ভেসে উঠে উষ্কখুষ্ক চুল ওয়ালা ছেলেটি, ঘামে ভেজা গেঞ্জি টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় বিভু নিভু চোখ, হাতে পানির বোতল। আর বলে চলছে অনর্গল- ‘ভাই, পানি লাগবে কারো পানি?’
অবশেষে ৫ আগস্ট আমাদের বিপ্লব সফল হয়, স্বৈরাচারী হাসিনা নিজ জান বাঁচাতে হেলিকপ্টারে করে উড়াল দেয় ভারতের উদ্দেশে। সেই আনন্দ পুলকবোধ বলে বুঝানো অসম্ভব। গণভবনে ছাত্র-জনতার প্রবেশে তৈরি হয় এক ঐতিহাসিক দৃশ্য। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সেদিনই প্রথম।
পরে শুরু হয় গ্রাফিতিতেও এক নয়া সংযোজন।
স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি না কেবল প্রতিটি এলাকায় জনপদের মোড়ে ছাত্রদের হাতে অঙ্কিত হয়। গ্রাফিতিতে দেশ সংস্কারের বার্তা।
‘ক্ষমতা নয় সমতা চাই, বিকল্প কে? আপনি’, এখন দরকার জনগণের সরকার, ‘বায়ান্ন দেখিনি একাত্তর দেখিনি চব্বিশ দেখেছি,; ‘পিণ্ডির গোলামির জিঞ্জির ছিন্ন করেছি দিল্লিøর দাসত্ব মানি না মানব না,’ ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ,’ ‘শিক্ষক রাজনীতি নিপাত যাক মেধা পাচার থেমে যাক,’ ‘মেধার বিজয়, শহীদের রক্ত হবে নাকো ব্যর্থ,’ ‘আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেইনি,’ ‘আমার স্বাধীন বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই,’ ‘লাখো শহীদের রক্তে কেনা দেশটা কারো বাপের না।’
এ ছাড়া শহীদ আবু সাঈদের সেই আইকনিক দৃশ্য বন্দুকের নলের সামনে হাত উঁচিয়ে দাঁড়ানো, এই চিত্রটিও বাংলার দেয়ালে দেয়ালে ছেয়ে রয়েছে। যেন বারবার মনে করিয়ে দেয় এই স্বাধীনতার পেছনে এক রক্তক্ষয়ী ইতিহাসের কথা। সেই সূত্রে বলতে হয়- গ্রাফিতি একটি সফল ও কার্যকরী বিপ্লবী কণ্ঠস্বর।
যা কিশোর থেকে বয়োবৃদ্ধ সবার মনে নাড়া দিতে সক্ষম।
প্রাচীন রোমান ধ্বংসাবশেষে, মধ্য আমেরিকার মায়ান শহর টিকালের ধ্বংসাবশেষে, ১৬ শতকে স্পেনের পাথরে এবং মধ্যযুগীয় ইংরেজ গির্জাগুলোতে গ্রাফিতির কিছু চিহ্ন পাওয়া যায়। বিংশ শতাব্দীতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে গ্রাফিতিগুলো নানান গ্যাংয়ের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল, তারা এটিকে ব্যবহার করত বিভিন্ন উদ্দেশ্যে। অঞ্চল শনাক্তকরণ বা দখলদারিত্ব দাবির জন্য। এ ছাড়াও মৃত গ্যাং সদস্যদের অনানুষ্ঠানিকভাবে স্মরণ রাখার জন্য। গোটা বিশ্বের নগর কেন্দ্রগুলোতে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে গ্রাফিতি বিশেষভাবে জনপ্রিয় ছিল। ১৯৯০ সালে গ্রাফিতির একটি নতুন রূপ আবির্ভূত হয়। কোনো অঞ্চলকে চিহ্নিত করার জন্য একটি বিশেষ চিহ্ন বারবার ব্যবহৃত হয়েছিল। সর্বাধিক মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য, এ ধরনের গ্রাফিতি সাধারণত নগরকেন্দ্রেও আঁকা হতো।
সমকালীন বেশ বিদ্রƒপ করে কিছু গ্রাফিতি অঙ্কিত হয়েছে, ‘এখানে যে ময়লা ফেলবে সে হাউন আঙ্কেল।’
আবার আলোচিত উপস্থাপিকা দীপ্তি চৌধুরীর সেই সংলাপ, ‘উত্তেজিত হবেন না প্লিজ’। এতে করে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান করা হচ্ছে। আবার সম্প্রতি নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হওয়া কিছু মিম ও গ্রাফিতি জায়গা করে নিয়েছে, ‘নাটক কম করো পিও,’ ‘ওই মামা না প্লিজ’ ইত্যাদি।
চলতি পথের দেয়ালজুড়ে যখন রাজনৈতিক রঙবেরঙের পোস্টার। একঘেয়েমি ছবির সাথে অমুক ভাইয়ের সালাম নিন তমুক মার্কায় ভোট দিন টাইপের সস্তা স্লোগান। (যদিও তারা ভোটের জন্য মায়াকান্না করলেও পরে গিয়ে ভোটকেন্দ্রেই প্রবেশের অনুমতি দেয়নি যেন আমরাই গায়ে পড়ে ভোটের অধিকার ফলাতে এসেছি। সেটি আলাদা বিষয়) তার প্রত্যাবর্তে নগরীর দেয়লগুলোতে সয়লাব ঐক্য ও সমতার বার্তা। যেই দেশবাসীকে নানান সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করে পৃথক করার চেষ্টা করা হয়েছে এতগুলো বছর সেই দেশবাসী এখন বলে- ‘ধর্ম যার যার দেশ সবার’। কবে কোন কালে এমন কথা কর্ণপাত হয়েছিল মনে আসে না তা। পরিশেষে এই এটুকু বলতে চাই, এই বিপ্লবের নতুন কণ্ঠ গ্রাফিতিতে ছেয়ে যাক সমতার বার্তা। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’।