০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১, ৩০ জিলহজ ১৪৪৫
`

প্রত্যয় স্কিম : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কেন এটি বাস্তবায়নের বিরোধিতা করছেন

- ছবি : ইউএনবি

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বা ক্লাস বর্জনের কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উত্তেজনা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। কিন্তু ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান অচলাবস্থার পেছনে এবার ভিন্ন কারণ রয়েছে।

এবারের এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে নতুন পেনশন স্কিমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে শিক্ষক ও কর্মচারীদের অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের কারণে।

‘প্রত্যয়’ স্কিমে কী আছে এবং কেন এই নতুন প্রকল্পটি নিয়ে প্রতিবাদ হচ্ছে?

নতুন প্রকল্প সম্পর্কে কী বলছে সরকার

অর্থ মন্ত্রণালয় ২০২৪ সালের ২০ মার্চ একটি বিজ্ঞপ্তিতে ঘোষণা করেছিল স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত এবং সংবিধিবদ্ধ বা অনুরূপ সংস্থা এবং তাদের অধীনস্থ সংস্থায় ২০২৪ সালের ১ জুলাই বা তার পরে চাকরিতে যোগ দেওয়া কর্মী, তাদের সর্বজনীন পেনশন প্রকল্পের আওতায় প্রত্যয় স্কিমের অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “চলতি বছরের ১ জুলাই এবং তার পরে নতুন যোগদানকারী কর্মকর্তা, কর্মচারীদের ভবিষ্যতের আর্থিক সুরক্ষা ‘প্রত্যয়’ প্রকল্পে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে নিশ্চিত করা হবে কারণ তারা অবসরকালীন মাসিক পেনশনের অধিকারী হবেন।”

এই ধরনের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বেশিরভাগ কর্মচারী গ্র্যাচুইটি এবং কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ডের (সিপিএফ) আওতাভুক্ত। সেই ব্যবস্থায়, কর্মচারীরা চাকরি শেষে অবসর সুবিধা হিসেবে একসঙ্গে টাকা পাবেন, তবে কোনো মাসিক পেনশন নেই।

'প্রত্যয়' পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারীর মূল বেতনের ১০ শতাংশ অথবা সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা, বা এর চেয়ে কম কর্তন করা হবে এবং প্রকল্পে অংশগ্রহণের জন্য সমপরিমাণ অর্থ প্রতিষ্ঠান দেবে।

এরপর উভয় অর্থ জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় উক্ত কর্মকর্তা/কর্মচারীর পরিমাণ অ্যাকাউন্টে জমা হবে।

উদাহরণস্বরূপ, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠান থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত টাকা জমা দিলে ৬০ বছর বয়সে অবসর গ্রহণের পর প্রতি মাসে ৬২ হাজার ৩৩০ টাকা পেনশন পাবেন।

এক্ষেত্রে ৩০ বছর মেয়াদে কর্মচারীর নিজস্ব বেতন থেকে পরিশোধিত মোট চাঁদার পরিমাণ ৯ লাখ টাকা (প্রতি মাসে ২৫০০ টাকা জমা) এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান/প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিশোধিত চাঁদার মোট পরিমাণ ৯ লাখ টাকা।

প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট কর্মীদের জন্য মোট চাঁদার পরিমাণ হবে ১৮ লাখ টাকা। উপকারভোগী ৭৫ বছর বয়সে মারা গেলে ওই ব্যক্তি ১৫ বছরে ১ কোটি ১২ লাখ টাকা বা তার বেশি পেনশন পাবেন, যা কর্মচারীর নিজস্ব আমানতের ১২ দশমিক ৪৭ গুণ।

সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, অবসর পরবর্তী জীবনে কর্মীদের আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষা দিতে বর্তমান ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে 'প্রত্যয় স্কিম' চালু করা হয়েছে।

এই স্কিমে নিবন্ধিত কর্মচারী পেনশনযোগ্য বয়সে পৌঁছানোর পরের মাস থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মাসিক পেনশনের পরিমাণ পাবেন। মোবাইল এসএমএসের মাধ্যমেও তাকে এ বিষয়ে জানানো হবে।

এক্ষেত্রে তাকে ন্যাশনাল পেনশন অথরিটি বা অন্য কোনো অফিসে গিয়ে কোনো ধরনের প্রমাণ দাখিল করতে হবে না।

এর বিরুদ্ধে শিক্ষকদের অবস্থান

মার্চ মাসে এই প্রকল্প সম্পর্কে ঘোষণার পরে শিক্ষকরা এটি প্রত্যাখ্যান করেন এবং তাদের এটি থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানান। তারা বেশ কয়েকদিন আংশিক কর্মবিরতি পালন করার পর ৩০ জুন আল্টিমেটাম দেন যে, এটি বাতিল না করা হলে ১ জুলাই থেকে তারা কর্মবিরতিতে যাবেন।

সরকার অনড় থাকায় এবং ১ জুলাই থেকে প্রত্যয় স্কিম কার্যকর হওয়ায় বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি পালন করছেন।

এছাড়া স্কিমটি বাতিলের দাবিতে একযোগে কর্মবিরতি শুরু করলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যা বলছেন

গত ৩০ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আমাদের আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন।’

এতে বলা হয়, ‘বৈষম্যমূলক ও অবমাননাকর পেনশন স্কিম থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বাদ দেওয়া, শিক্ষকদের জন্য ব্যক্তি বেতন স্কেল প্রবর্তন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রতিশ্রুত 'সুপার গ্রেডে' অন্তর্ভুক্ত করার দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই সর্বাত্মক কর্মবিরতি অব্যাহত থাকবে।’

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, প্রত্যয় পেনশন স্কিম সম্পূর্ণ বৈষম্যমূলক।

তিনি বলেন, ‘এটিতে কাউকে সুবিধা দেবে আবার কাউকে বঞ্চিত করা হবে। এই পেনশন প্রকল্প আমাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছে এবং আমাদের আর্থিক বিষয় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে।’

শিক্ষকদের এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা গেলে তারা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন।

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এখানে এসেছি আমাদের অধিকারের জন্য নয়, আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকারের জন্যে এসেছি। শিক্ষকদের পেনশন প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হলে অনেকেই এ পেশায় আসতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হুমকি? আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হতে দিতে পারি না।’

বৃহস্পতিবার(৪ জুলাই) বিকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে শিক্ষকদের বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও পরে তা স্থগিত করা হয়। সূত্র : ইউএনবি


আরো সংবাদ



premium cement